মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বিরাটপর্ব/বৈবাহিকপর্বাধ্যায়
॥ বৈবাহিকপর্বাধ্যায়॥
১৬। পাণ্ডবগণের আত্মপ্রকাশ ― উত্তরা-অভিমন্যুর বিবাহ
তিন দিন পরে পঞ্চপাণ্ডব স্নান করে শুক্ল বসন প’রে রাজযোগ্য আভরণে ভূষিত হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে পুরোবর্তী কবে বিরাট রাজার সভায় গিয়ে রাজাসনে উপবিষ্ট হলেন। বিরাট রাজকার্য করবার জন্য সভায় এসে তাঁদের দেখে সরোষে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, কঙ্ক, তোমাকে আমি সভাসদ্ করেছি, তুমি রাজাসনে বসেছ কেন? অর্জুন সহাস্যে বললেন, মহারাজ, ইনি ইন্দ্রের আসনেও বসবার যোগ্য। ইনি মূর্তিমান ধর্ম, ত্রিলোকবিখ্যাত রাজর্ষি, ধৈর্যশীল সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়। ইনি যখন কুরুদেশে ছিলেন তখন দশ সহস্র হস্তী এবং কাঞ্চনমালাভূষিত অশ্বযুক্ত ত্রিশ সহস্র রথ এঁর পশ্চাতে যেত। ইনি বৃদ্ধ অনাথ অঙ্গহীন পঙ্গু প্রভৃতিকে পুত্রের ন্যায় পালন করতেন। এঁর ঐশ্বর্য ও প্রতাপ দেখে দুর্যোধন কর্ণ শকুনি প্রভৃতি সন্তপ্ত হতেন। সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির রাজার আসনে বসবেন না কেন?
বিরাট বললেন, ইনি যদি কুন্তীপত্র যুধিষ্ঠির হন তবে এঁর ভ্রাতা ভীম অর্জুন নকুল সহদেব কাঁরা? যশস্বিনী দ্রৌপদীই বা কে? দ্যূতসভায় পাণ্ডবদের পরাজয়ের পর থেকে তাঁদের কোনও সংবাদ আমরা জানি না। অর্জুন বললেন, মহারাজ, সন্তান যেমন মাতৃগর্ভে বাস করে আমরা তেমনই আপনার ভবনে অজ্ঞাতবাস করেছি। এই ব’লে তিনি নিজেদের পরিচয় দিলেন।
উত্তর পাণ্ডবগণকে একে একে দেখিয়ে বললেন, এই যে শোধিত স্বর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ বিশালকায় পুরুষ দেখছেন, যাঁর নাসিকা দীর্ঘ, চক্ষু তাম্রবর্ণ, ইনিই কুরুরাজ যুধিষ্ঠির। মত্ত গজেন্দ্রের ন্যায় যাঁর গতি, যিনি তপ্তকাঞ্চনবর্ণ স্থূলস্কন্ধ মহাবাহু, ইনিই বৃকোদর, এঁকে দেখুন, দেখুন। এঁর পার্শ্বে যে শ্যামবর্ণ সিংহস্কন্ধ গজেন্দ্রগামী আয়তলোচন যুবা রয়েছেন, ইনিই মহাধনুর্ধর অর্জুন। কুরুরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকটে বিষ্ণু ও ইন্দ্রের ন্যায় যে দুজনকে দেখছেন, রূপে বলে ও চরিত্রে যাঁরা অতুলনীয়, এঁরাই নকুল-সহদেব। আর যাঁর কান্তি নীলোৎপলের ন্যায়, মস্তকে স্বর্ণাভরণ, যিনি মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় পাণ্ডবগণের পার্শ্বে রয়েছেন, ইনিই কৃষ্ণা।
বিরাট তাঁর পুত্রকে বললেন, আমি যুধিষ্ঠিরকে প্রসন্ন করতে ইচ্ছা করি, যদি তোমার মত হয় তবে অর্জুনকে আমার কন্যাদান করব। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির, আমরা না জেনে যে অপরাধ করেছি তা ক্ষমা করুন। আমার এই রাজ্য এবং যা কিছু আছে সমস্তই আপনাদের। সব্যসাচী ধনঞ্জয় উত্তরাকে গ্রহণ করুন, তিনিই তার যোগ্য ভর্তা।
যুধিষ্ঠির অর্জুনের দিকে চাইলেন। অর্জুন বললেন, মহারাজ, আপনার দুহিতাকে আমি পত্রবধূ রূপে গ্রহণ করব, এই সম্বন্ধ আমাদের উভয় বংশেরই যোগ্য হবে। বিরাট বললেন, আপনাকে আমার কন্যা দিচ্ছি, আপনিই তাকে ভার্যা রূপে নেবেন না কেন? অর্জুন বললেন, অন্তঃপুরে আমি সর্বদাই আপনার কন্যাকে দেখেছি, সে নির্জনে ও প্রকাশ্যে আমাকে পিতার ন্যায় বিশ্বাস করেছে। নৃত্যগীত শিখিয়ে আমি তার প্রীতি ও সম্মানের পাত্র হয়েছি, সে আমাকে আচার্যতুল্য মনে করে। আমি এক বৎসর আপনার বয়স্থা কন্যার সঙ্গে বাস করেছি, আমি তাকে বিবাহ করলে লোকে অন্যায় সন্দেহ করতে পারে; এই কারণে আপনার কন্যাকে আমি পত্রবধূ রূপে চাচ্ছি, তাতে লোকে বুঝবে যে আমি শুদ্ধস্বভাব জিতেন্দ্রিয়, আপনার কন্যারও অপবাদ হবে না। পুত্র বা ভ্রাতার সঙ্গে বাস যেমন নির্দোষ, পুত্রবধূ ও দুহিতার সঙ্গে বাসও সেইরূপ। আমার পুত্র মহাবাহু অভিমন্যু, কৃষ্ণের ভাগিনেয়, দেববালকের ন্যায় রূপবান, অল্প বয়সেই অস্ত্রবিশারদ, সে আপনার উপযুক্ত জামাতা।
অর্জুনের প্রস্তাবে বিরাট সম্মত হলেন, যুধিষ্ঠিরও অনুমোদন করলেন। তার পর সকলে বিরাটরাজ্যের অন্তর্গত উপপ্লব্য নগরে গেলেন এবং আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে পাঠালেন। দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ বলরাম কৃতবর্মা ও সাত্যকি সুভদ্রা ও অভিমন্যুকে নিয়ে এলেন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি ভৃত্যরাও পাণ্ডবদের রথ নিয়ে এল। এক অক্ষৌহিণী সৈন্য সহ দ্রুপদ রাজা, দ্রৌপদীর পঞ্চপউত্র, শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্নও এলেন। মহাসমারোহে বিবাহের উৎসব অনুষ্ঠিত হ’ল। শত শত মৃগ ও অন্যান্য পবিত্র পশু নিহত হ’ল, লোকে নানাপ্রকার মদ্য প্রচুর পান করতে লাগল। সর্বাঙ্গসুন্দরী সভূষিতা নারীগণ বিরাটমহিষী সুদেষ্ণার সঙ্গে বিবাহসভায় এলেন, রূপে যশে ও কান্তিতে দ্রৌপদী সকলকেই পরাস্ত করলেন। জনার্দন কৃষ্ণের সম্মুখে অভিমন্যু-উত্তরার বিবাহ যথাবিধি সম্পন্ন হ’ল। বিরাট অভিমন্যুকে সাত হাজার দ্রুতগামী অশ্ব, দুই শত উত্তম হস্তী, এবং বহু ধন যৌতুক দিলেন। কৃষ্ণ যা উপহার দিলেন যুধিষ্ঠির সেই সকল ধনরত্ন, বহু সহস্র গো, বিবিধ বস্ত্র, ভূষণ যান শয্যা এবং খাদ্য-পানীয় ব্রাহ্মণগণকে দান করলেন।