মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বিরাটপর্ব/গোহরণপর্বাধ্যায়

॥ গোহরণপর্বাধ্যায়॥

১০। দুর্যোধনাদির মন্ত্রণা

 পাণ্ডবরা কোথায় অজ্ঞাতবাস করছেন তা জানবার জন্য দুর্যোধন নানা দেশে চর পাঠিয়েছিলেন। তারা এখন হস্তিনাপরে ফিরে এসে তাঁকে বললে, মহারাজ, আমরা দুর্গম বনে ও পর্বতে, জনাকীর্ণ দেশে ও নগরে বহু অন্বেষণ ক’রেও পাণ্ডবদের পাই নি। তাঁদের সারথিরা দ্বারকায় গেছে, কিন্তু তাঁরা সেখানে নেই। পাণ্ডবগণ নিশ্চয় বিনষ্ট হয়েছেন। একটি প্রিয় সংবাদ এই—মৎস্যরাজ বিরাটের সেনাপতি দুরাত্মা কীচক যিনি ত্রিগর্ত দেশীয় বীরগণকে বার বার পরাজিত করেছিলেন—তিনি আর জীবিত নেই, অদৃশ্য গন্ধর্বগণ রাত্রিযোগে তাঁকে এবং তাঁর ভ্রাতাদের বধ করেছে।

 দুর্যোধন সভাস্থ সকলকে বললেন, পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের আর অল্পকালই অবশিষ্ট আছে, এই কালও যদি তারা অতিক্রম করে তবে তাদের সত্য রক্ষা হবে এবং তার ফল কৌরবদের পক্ষে দুঃখজনক হবে। এখন এর প্রতিকারের জন্য কি করা উচিত তা আপনারা শীঘ্র স্থির করুন। কর্ণ বললেন, আর একদল অতি ধূর্ত গুপ্তচর পাঠাও, তারা সর্বত্র গিয়ে অন্বেষণ করুক। দুঃশাসন বললেন, আমারও সেই মত; পাণ্ডবরা হয়তো নিগূঢ় হয়ে আছে, বা সমুদ্রের অপর পারে গেছে, বা মহারণ্যে হিংস্র পশুগণ তাদের ভক্ষণ করেছে, অথবা অন্য কোনও বিপদের ফলে তারা চিরকালের জন্য বিনষ্ট হয়েছে।

 দ্রোণাচার্য বললেন, পাণ্ডবদের ন্যায় বীর ও বুদ্ধিমান পুরুষরা কখনও বিনষ্ট হন না; আমি মনে করি তাঁরা সাবধানে আসন্নকালের প্রতীক্ষা করছেন। তোমরা বিশেষরূপে চিন্তা করে যা যুক্তিসঙ্গত তাই কর। ভীষ্ম বললেন, দ্রোণাচার্য ঠিক বলেছেন, পাণ্ডবগণ কৃষ্ণের অননুগত, ধর্মবলে ও নিজবীর্যে রক্ষিত, তাঁরা উপযুক্ত কালের প্রতীক্ষা করছেন। তাঁদের অজ্ঞাতবাস সম্বন্ধে অন্য লোকের যে ধারণা, আমার তা নয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যে দেশেই থাকুন সেই দেশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হবে, কোনও গুপ্তচর তাঁর সন্ধান পাবে না। কৃপাচার্য বললেন, পাণ্ডবদের আত্মপ্রকাশের কাল আসন্ন, সময় উত্তীর্ণ হ’লেই তাঁরা নিজ রাজ্য অধিকারের জন্য উৎসাহী হবেন। দুর্যোধন, তুমি নিজের বল ও কোষ বৃদ্ধি কর, তার পর অবস্থা বুঝে সন্ধি বা বিগ্রহের জন্য প্রস্তুত হয়ো।

 ত্রিগর্তদেশের অধিপতি সুশর্মা দুর্যোধনের সভায় উপস্থিত ছিলেন, মৎস্য ও শাল্ব দেশীয় যোদ্ধারা তাঁকে বহুবার পরাজিত করেছিল। তিনি দুর্যোধনকে বললেন, মৎস্যরাজ বিরাট আমার রাজ্যে অনেক বার উৎপীড়ন করেছেন, কারণ মহাবীর কীচক তাঁর সেনাপতি ছিলেন। সেই নিষ্ঠুর দুরাত্মা কীচককে গন্ধর্বরা বধ করেছে, তার ফলে বিরাট এখন অসহায় ও নিরুৎসাহ হয়েছেন। আমার মতে এখন বিরাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা উচিত। আমরা তাঁর ধনরত্ন, গ্রামসমূহ বা রাষ্ট্র অধিকার করব, বহু সহস্র গো হরণ করব। কিংবা তাঁর সঙ্গে সন্ধি ক’রে তাঁর পৌরুষ নষ্ট করব, অথবা তাঁর সমস্ত সৈন্য সংহার ক’রে তাঁকে বশে আনব; তাতে আপনার বলবৃদ্ধি হবে।

 কর্ণ বললেন, সুশর্মা কালোচিত হিতবাক্য বলেছেন। আমাদের সেনাদল একত্র বা বিভক্ত হয়ে যাত্রা করুক। অর্থহীন বলহীন পৌরুষহীন পাণ্ডবদের জন্য আমাদের ভাববার প্রয়োজন কি, তারা অন্তর্হিত হয়েছে অথবা যমালয়ে গেছে। এখন আমরা নিরুদ্‌বেগে বিরাটরাজ্য আক্রমণ ক’রে গো এবং বিবিধ ধনরত্ন হরণ করব।

 কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর দিন সুশর্মা সসৈন্যে বিরাটরাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উপস্থিত হলেন। পরদিন কৌরবগণও গেলেন।

১১। দক্ষিণগোগ্রহ[] ― সুশর্মার পরাজয়

 পাণ্ডবগণের নির্বাসনের ত্রয়োদশ বর্ষ যেদিন পূর্ণ হ’ল সেই দিনে সুশর্মা বিরাটের বহু গোধন হরণ করলেন। একজন গোপ বেগে রাজসভায় গিয়ে বিরাটকে বললে, মহারাজ, ত্রিগর্তদেশীয়গণ আমাদের নির্জিত ক’রে শতসহস্র গো হরণ করেছে। বিরাট তখনই তাঁর সেনাদলকে প্রস্তুত হ’তে আজ্ঞা দিলেন। বিরাট, তাঁর ভ্রাতা শতানীক এবং জ্যেষ্ঠ রাজপত্রে শঙ্খ রত্নভূষিত অভেদ্য বর্ম পরে সজ্জিত হলেন। বিরাট বললেন, কঙ্ক বল্লব তন্তিপাল ও গ্রন্থিক এঁরাও বীর্যবান এবং যুদ্ধ করতে সমর্থ, এঁদেরও অস্ত্রশস্ত কবচ আর রথ দাও। রাজার আজ্ঞানুসারে শতানীক যুধিষ্ঠিরাদিকে অস্ত্র রথ ইত্যাদি দিলেন, তাঁরা আনন্দিত হয়ে মৎস্যরাজের বাহিনীর সঙ্গে যাত্রা করলেন। মধ্যাহ্ন অতীত হ’লে মৎস্যসেনার সঙ্গে ত্রিগর্তসেনার স্পর্শ হ’ল।

 দুই সৈন্যদলে তুমুল যুদ্ধ হ’তে লাগল। সুশর্মা ও বিরাট দ্বৈরথ যুদ্ধে নিযুক্ত হলেন। বহক্ষণ যুদ্ধের পর সুশর্মা বিরাটকে পরাজিত করলেন এবং তাঁকে বন্দী ক’রে নিজের রথে তুলে নিয়ে দ্রুতবেগে চললেন। মৎস্যসেনা ভয়ে পালাতে লাগল। তখন যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, মহাবাহু, তুমি বিরাটকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত কর, আমরা তাঁর গৃহে সুখে সসম্মানে বাস করেছি, তার প্রতিদান আমাদের কর্তব্য। ভীম একটি বিশাল বৃক্ষ উৎপাটন করতে যাচ্ছেন দেখে যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি বৃক্ষ নিয়ে যুদ্ধ ক’রো না, লোকে তোমাকে চিনে ফেলবে, তুমি ধনু খড়্‌গ পরশু প্রভৃতি সাধারণ অস্ত্র নাও।

 পাণ্ডবগণ রথ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন দেখে বিরাটের সৈন্যরাও ফিরে এসে যুদ্ধ করতে লাগল। যুধিষ্ঠির ভীম নকুল সহদেব সকলেই বহুশত যোদ্ধাকে বিনষ্ট করলেন। তার পর যুধিষ্ঠির সুশর্মার প্রতি ধাবিত হলেন। ভীম সুশর্মার অশ্ব সারথি ও পৃষ্ঠরক্ষকদের বধ করলেন। বন্দী বিরাট সুশর্মার রথ থেকে লাফিযে নামলেন এবং সুশর্মার গদা কেড়ে নিয়ে তাঁকে আঘাত করলেন। বিরাট বৃদ্ধ হ’লেও গদাহস্তে যুবকের ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন। ভীম সুশর্মার কেশাকর্ষণ ক’রে ভূমিতে ফেলে তাঁর মস্তকে পদাঘাত করলেন, সুশর্মা মূর্ছিত হলেন। ত্রিগর্তসেনা ভয়ে পালাতে লাগল।

 সুশর্মাকে বন্দী ক’রে এবং গরু উদ্ধার করে পাণ্ডবরা বিরাটের কাছে গেলেন। ভীম ভাবলেন, এই পাপী সুশর্মা জীবনলাভের যোগ্য নয়, কিন্তু আমি কি করতে পারি, রাজা যুধিষ্ঠির সর্বদাই দয়াশীল। রথের উপরে অচেতনপ্রায় সুশর্মা বন্ধ হয়ে ছটফট করছেন দেখে যুধিষ্ঠির সহাস্যে বললেন, নরাধমকে মুক্তি দাও। ভীম বললেন, মূঢ়, যদি বাঁচতে চাও তবে সর্বত্র বলবে—আমি বিরাট রাজার দাস। যুধিষ্ঠির বললেন, এ তো দাস হয়েছেই, দুরাত্মাকে এখন ছেড়ে দাও। সুশর্মা, তুমি অদাস হয়ে চলে যাও, এমন কার্য আর ক’রো না। সুশর্মা লজ্জায় অধোমুখ হয়ে নমস্কার ক’রে চলে গেলেন।

 পাণ্ডবগণ যুদ্ধস্থানের নিকটেই সেই রাত্রি যাপন করলেন। পরদিন বিরাট তাঁদের বললেন, বিজয়িগণ, আপনাদের আমি সালংকারা কন্যা, বহু ধন এবং আর যা চান তা দিচ্ছি, আপনাদের বিক্রমেই আমি মুক্ত হয়ে নিরাপদে আছি, আপনারাই এখন মৎস্যরাজ্যের অধীশ্বর। যুধিষ্ঠিরাদি কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার বাক্যে আমরা আনন্দিত হয়েছি, আপনি যে মুক্তিলাভ করেছেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। বিরাট পুনর্বার যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনি আসুন, আপনাকে রাজপদে অভিষিক্ত করব। হে বৈয়াঘ্রপদ্য-গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, আপনার জন্যই আমার রাজ্য ও প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যরাজ, আপনার মনোজ্ঞ বাক্যে আমি আনন্দিত হয়েছি, আপনি অনিষ্ঠুর হয়ে প্রসন্নমনে প্রজাপালন করুন, আপনার বিজয়সংবাদ ঘোষণার জন্য সত্বর রাজধানীতে দূত পাঠান।

১২। উত্তরগোগ্রহ — উত্তর ও বৃহন্নলা

 বিরাট যখন ত্রিগর্তসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যান সেই সময়ে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে দুর্যোধন মৎস্যদেশে উপস্থিত হলেন এবং গোপালকদের তাড়িয়ে দিয়ে ষাট হাজার গরু হরণ[] করলেন। গোপগণের অধ্যক্ষ রথে চড়ে দ্রুতবেগে রাজধানীতে এল এবং বিরাটের পত্র ভূমিঞ্জয় বা উত্তরকে সংবাদ দিয়ে বললে, রাজপুত্র, আপনি শীঘ্র এসে গোধন উদ্ধার করুন, মহারাজ আপনাকেই এই শূন্য রাজধানীর রক্ষক নিযুক্ত ক’রে গেছেন।

 উত্তর বললেন, যদি অশ্বচালনে দক্ষ কোনও সারথি পাই তবে এখনই ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধে যেতে পারি। আমার যে সারথি ছিল সে পূর্বে এক মহাযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তুমি শীঘ্র একজন সারথি দেখ। উপযুক্ত অশ্বচালক পেলে আমি দুর্যোধন ভীষ্ম কর্ণ কৃপ দ্রোণ প্রভৃতিকে বিনষ্ট করে মুহূর্তমধ্যে গরু উদ্ধার ক’রে আনব। আমি সেখানে ছিলাম না বলেই কৌরবরা গোধন হরণ করেছে। কৌরবরা আজ আমার বিক্রম দেখে ভাববে, স্বয়ং অর্জুন আমাদের আক্রমণ করলেন নাকি?

 দ্রৌপদী উত্তরের মুখে বার বার এইরূপ কথা এবং অর্জুনের উল্লেখ সইতে পারলেন না। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, রাজপুত্র, বৃহন্নলা পূর্বে অর্জুনের সারথি ও শিষ্য ছিলেন, তিনি অশ্ববিদ্যায় অর্জুনের চেয়ে কম নন। আপনার কনিষ্ঠা ভগিনী উত্তরা যদি বলেন তবে বৃহন্নলা নিশ্চয় আপনার সারথি হবেন। ভ্রাতার অনুরোধে উত্তরা তখনই নৃত্যশালায় গিয়ে অর্জুনকে সকল ঘটনা জানিয়ে বললেন, বৃহন্নলা, তুমি আমার ভ্রাতার সারথি হয়ে যাও, তোমার উপর আমার প্রীতি আছে সেজন্য একথা বলছি, যদি না শোন তবে আমি জীবন ত্যাগ করব। অর্জুন উত্তরের কাছে গিয়ে বললেন, যুদ্ধস্থানে সারথ্য করতে পারি এমন কি শক্তি আমার আছে? আমি কেবল নৃত্য-গীত-বাদ্য জানি। উত্তর বললেন, তুমি গায়ক বাদক নর্তক যাই হও, শীঘ্র আমার রথে উঠে অশ্বচালনা কর।

 অর্জুন তখন উত্তরার সম্মুখে অনেক প্রকার কৌতুকজনক কর্ম করলেন। তিনি উলটো ক’রে কবচ পরতে গেলেন, তা দেখে কুমারীরা হেসে উঠল। তখন উত্তর স্বয়ং তাঁকে মহামূল্য কবচ পরিয়ে দিলেন। যাত্রাকালে উত্তরা ও তাঁর সখীরা বললেন, বৃহন্নলা, তুমি ভীষ্ম-দ্রোণাদিকে জয় করে আমাদের পুত্তলিকার জন্য বিচিত্র সূক্ষ্ম কোমল বস্ত্র এনো। অর্জুন সহাস্যে বললেন, উত্তর যদি জয়ী হন তবে নিশ্চয় সুন্দর সুন্দর বস্ত্র আনব।

 অর্জুন বায়ুবেগে রথ চালালেন। কিছুদূর গিয়ে শ্মশানের নিকটে এসে উত্তর দেখতে পেলেন, বহু বৃক্ষসমন্বিত বনের ন্যায় বিশাল কৌরবসৈন্য ব্যূহ রচনা ক’রে রয়েছে, সাগরগর্জনের ন্যায় তাদের শব্দ হচ্ছে। ভয়ে রোমাঞ্চিত ও উদ্‌বিগ্ন হয়ে উত্তর বললেন, আমি কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করব না, ওদের মধ্যে অনেক মহাবীর আছেন যাঁরা দেবগণেরও অজেয়। আমার পিতা সমস্ত সৈন্য নিয়ে গেছেন, আমার সৈন্য নেই, আমি বালক, যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। বৃহন্নলা, তুমি ফিরে চল।

 অর্জুন বললেন, রাজপুত্র, তুমি যাত্রা করবার সময় স্ত্রী আর পুরুষদের কাছে অনেক গর্ব করেছিলে, এখন পশ্চাৎপদ হচ্ছ কেন? তুমি যদি অপহৃত গোধন উদ্ধার না করে ফিরে যাও তবে সকলেই উপহাস করবে। সৈরিন্ধ্রী আমার সারথ্য কর্মের প্রশংসা করেছেন, আমি কৃতকার্য না হয়ে ফিরব না। উত্তর বললেন, কৌরবরা সংখ্যায় অনেক, তারা আমাদের ধন হরণ করুক, স্ত্রীপুরুষেও আমাকে উপহাস করুক। এই ব’লে উত্তর রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং মান দর্প ও ধনুর্বাণ ত্যাগ করে বেগে পালালেন। অর্জুন তাঁকে ধরবার জন্য পিছনে ছটলেন।

 রক্তবর্ণ বস্ত্র প’রে দীর্ঘ বেণী দুলিয়ে অর্জুনকে ছুটতে দেখে কয়েকজন সৈনিক হাসতে লাগল। কৌরবগণ বললেন, ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় এই লোকটি এর রূপ কতকটা পুরুষের কতকটা স্ত্রীর মত। এর মস্তক গ্রীবা বাহু ও গতি অর্জুনের তুল্য। বোধ হয় বিরাটের পুত্র আমাদের দেখে ভয়ে পালাচ্ছে আর অর্জুন তাকে ধরতে যাচ্ছেন।

 অর্জন এক শ পা গিয়ে উত্তরের চুল ধরলেন। উত্তর কাতর হয়ে বললেন, কল্যাণী সুমধ্যমা বৃহন্নলা, তুমি কথা শোন, রথ ফেরাও, বেঁচে থাকলেই মানুষের মঙ্গল হয়। আমি তোমাকে শত স্বর্ণমুদ্রা, স্বর্ণে গ্রথিত আটটি বৈদূর্য মণি, স্বর্ণধ্বজযুক্ত অশ্বসমেত একটি রথ এবং দশটি মত্ত মাতঙ্গ দেব, তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। অর্জুন সহাস্যে উত্তরকে রথের কাছে টেনে এনে বললেন, তুমি যদি না পার তবে আমিই যুদ্ধ করব, তুমি আমার সারথি হও। ভয়ার্ত উত্তর নিতান্ত অনিচ্ছায় রথে উঠলেন এবং অর্জুনের নির্দেশে শমীবৃক্ষের দিকে রথ নিয়ে চললেন।


 কৌরবপক্ষীয় বীরগণকে দ্রোণাচার্য বললেন, নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বায়ু বালুকাবর্ষণ করছে, আকাশ ভস্মের ন্যায় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েছে, অস্ত্রসকল কোষ থেকে স্থলিত হচ্ছে। তোমরা ব্যূহিত হয়ে আত্মরক্ষা কর, গোধন রক্ষা কর, মহাধনুর্ধর পার্থই ক্লীববেশে আসছেন তাতে সন্দেহ নেই।

 কর্ণ বললেন, আপনি সর্বদা অর্জুনের প্রশংসা আর আমাদের নিন্দা করেন, অর্জুনের শক্তি আমার বা দুর্যোধনের ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। দুর্যোধন বললেন, ওই লোক যদি অর্জুন হয় তবে আমাদের কার্য সিদ্ধ হয়েছে, আমরা জানতে পেরেছি সেজন্য পাণ্ডবদের আবার দ্বাদশ বৎসর বনে যেতে হবে। আর যদি অন্য কেউ হয় তবে তীক্ষ্ণ শরে ওকে ভূপাতিত করব।


 শমীবৃক্ষের কাছে এসে অর্জুন উত্তরকে বললেন, তুমি শীঘ্র এই বৃক্ষে উঠে পাণ্ডবদের ধনু শর ধ্বজ ও কবচ নামিয়ে আন। তোমার ধনু আমার আকর্ষণ সইতে পারবে না, শত্রুর হস্তী বিনষ্ট করতেও পারবে না। উত্তর বললেন, শুনেছি এই বৃক্ষে একটা মৃতদেহ বাঁধা আছে, আমি রাজপত্রে হয়ে কি ক’রে তা ছোঁব? অর্জুন বললেন, ভয় পেয়ো না, ওখানে মৃতদেহ নেই, যা আছে তা ধনু প্রভৃতি অস্ত্র, তুমি স্পর্শ করলে পবিত্র হবে। তোমাকে দিয়ে আমি নিন্দিত কর্ম করাব কেন? অর্জুনের আজ্ঞানুসারে উত্তর শমীবৃক্ষ থেকে অস্ত্রসমূহ নামিয়ে এনে বন্ধন খুলে ফেললেন এবং সূর্যতুল্য দীপ্তিমান সর্পাকৃতি ধনুসকল দেখে ভয়ে রোমাঞ্চিত হলেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন বললেন, এই শতস্বর্ণবিন্দুযুক্ত সহস্রগোধাচিহ্নিত ধনু অর্জুনের, এরই নাম গাণ্ডীব, খাণ্ডবদাহকালে বরুণের নিকট অর্জুন এই ধনু পেয়েছিলেন। এই ধনু যার ধারণস্থান স্বর্ণময়, ভীমের; ইন্দ্রগোপচিহ্নিতে এই ধনু যুধিষ্ঠিরের; সুবর্ণ সূর্য চিহ্নিত এই ধনু নকুলের; স্বর্ণময় পতঙ্গচিহ্নিত এই ধনু সহদেবের। তাঁদের বাণ তূণীর খড়্‌গ প্রভৃতিও এই সঙ্গে আছে।

 উত্তর বললেন, মহাত্মা পাণ্ডবগণের অস্ত্রসকল এখানে রয়েছে, কিন্তু তাঁরা কোথায়? দ্রৌপদীই বা কোথায়? অর্জুন বললেন, আমি পার্থ, সভাসদ কঙ্কই যুধিষ্ঠির, পাচক বল্লব ভীম, অশ্বশালা আর গোশালার অধ্যক্ষ নকুল-সহদেব। সৈরিন্ধ্রীই দ্রৌপদী, যাঁর জন্য কীচক মরেছে। উত্তর বললেন, আমি অর্জুনের দশটি নাম শুনেছি, যদি বলতে পারেন তবে আপনার সব কথা বিশ্বাস করব। অর্জুন বললেন, আমার দশ নাম বলছি শোন।—আমি সর্বদেশ জয় ক’রে ধন আহরণ করি সেজন্য আমি ধনঞ্জয়। যুদ্ধে শত্রুদের জয় না ক’রে ফিরি না সেজন্য আমি বিজয়। আমার রথে রজতশুভ্র অশ্ব থাকে সেজন্য আমি শ্বেতবাহন। হিমালয়পৃষ্ঠে উত্তর ও পূর্ব ফল্‌গুনী নক্ষত্রের যোগে আমার জন্ম সেজন্য আমি ফাল্‌গুন। দানবদের সঙ্গে যুদ্ধকালে ইন্দ্র আমাকে সূর্যপ্রভ কিরীট দিয়েছিলেন, সেজন্য আমি কিরীটী। যুদ্ধকালে বীভৎস কর্ম করি না সেজন্য আমার বীভৎসু নাম। বাম ও দক্ষিণ উভয় হস্তেই আমি গাণ্ডীব আকর্ষণ করতে পারি সেজন্য সব্যসাচী নাম। আমার শুভ্র (নিষ্কলঙ্ক) যশ চতুঃসমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত, আমার সকল কর্মও শুভ্র, এজন্য অর্জুন (শুভ্র) নাম। আমি শত্রুবিজয়ী এজন্য জিষ্ণু নাম! সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ বালক সকলের প্রিয়, এজন্য পিতা আমার কৃষ্ণ নাম রেখেছিলেন।

 অর্জুনকে অভিবাদন ক’রে উত্তর বললেন, মহাবাহু, ভাগ্যক্রমে আপনার দর্শন পেয়েছি, আমি না জেনে যা বলেছি তা ক্ষমা করুন। আমার ভয় দূর হয়েছে, আপনি রথে উঠুন, যেদিকে বলবেন সেদিকে নিয়ে যাব। কোন্ কর্মের ফলে আপনি ক্লীবত্ব পেয়েছেন? অর্জুন বললেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশে আমি এক বৎসর ব্রহচর্য ব্রত পালন করছি, আমি ক্লীব নই। এখন আমার ব্রত সমাপ্ত হয়েছে। অর্জুন তাঁর বাহু থেকে বলয় খুলে ফেলে করতলে স্বণর্খচিত বর্ম পরলেন এবং শুভ্র বস্ত্রে কেশ বন্ধন করলেন। তার পর তিনি পূর্বমুখ হয়ে সংযতচিত্তে তাঁর অস্ত্রসমূহকে স্মরণ করলেন। তারা কৃতাঞ্জলি হয়ে বললে, ইন্দ্রপুত্র, কিংকরগণ উপস্থিত। অর্জুন তাদের নমস্কার ও স্পর্শ ক’রে বললেন, স্মরণ করলেই তোমরা এস।

 গাণ্ডীব ধনুতে গুণ পরিয়ে অর্জুন সবলে আকর্ষণ করলেন। সেই বজ্রনাদতুল্য টংকার শুনে কৌরবগণ বুঝলেন যে, অর্জুনেরই এই জ্যানির্ঘোষ।

১৩। দ্রোণ-দুর্যোধনাদির বিতর্ক — ভীষ্মের উপদেশ

 উত্তরের রথে যে সিংহধ্বজ ছিল তা নামিয়ে ফেলে অর্জুন বিশ্বকর্মানির্মিত দৈবী মায়া ও কাঞ্চনময় ধ্বজ বসালেন, যার উপরে সিংহলাঙ্গুল বানর ছিল। অগ্নিদেবের আদেশে কয়েকজন ভূতও সেই ধ্বজে অধিষ্ঠিত হ’ল। তার পর শমীবৃক্ষ প্রদক্ষিণ করে অর্জুন রথারোহণে উত্তর দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁর মহাশঙ্খের শব্দ শুনে রথের অশ্বসকল নতজানু হয়ে বসে পড়ল, উত্তরও সন্ত্রস্ত হলেন। অর্জুন রশ্মি টেনে অশ্বদের ওঠালেন এবং উত্তরকে আলিঙ্গন ক’রে আশ্বস্ত করলেন।

 অর্জুনের রথের শব্দ শুনে এবং নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখে দ্রোণ বললেন, দুর্যোধন, আজ তোমার সৈন্যদল অর্জুনের বাণে প্রপ্রীড়িত হবে, তারা যেন এখনই পরাভূত হয়েছে, কেউ যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করছে না, বহু যোদ্ধার মুখ বিবর্ণ দেখছি। তুমি গরুগুলিকে নিজ রাজ্যে পাঠিয়ে দাও, আমরা ব্যূহ রচনা ক’রে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করি।

 দুর্যোধন বললেন, দ্যূতসভায় এই পণ ছিল যে পরাজিত পক্ষ বার বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করবে। এখনও তের বৎসর পূর্ণ হয় নি অথচ অর্জুন উপস্থিত হয়েছে, অতএব পাণ্ডবদের আবার বার বৎসর বনবাস করতে হবে। হয়তো লোভের বশে পাণ্ডবরা তাদের ভ্রম বুঝতে পারে নি। অজ্ঞাতবাসের কিছুদিন এখনও অবশিষ্ট আছে কিনা অথবা পূর্ণকাল অতিক্রান্ত হয়েছে কিনা তা পিতামহ ভীষ্ম বলতে পারেন। ত্রিগর্ত সেনা সপ্তমীর দিন অপরাহ্নে গোধন হরণ করবে এই স্থির ছিল। হয়তো তারা তা করেছে, অথবা পরাজিত হয়ে বিরাটের সঙ্গে সন্ধি করেছে। যে লোক আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসছে সে বোধ হয় বিরাটের কোনও যোদ্ধা কিংবা স্বয়ং বিরাট। বিরাট বা অর্জুন যিনিই আসুন, আমরা যুদ্ধ করব। আচার্য দ্রোণ আমাদের সৈন্যের পশ্চাতে থাকুন, ইনি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন আর অর্জুনের প্রশংসা করছেন। আচার্যরা দয়ালু হন, সর্বদাই বিপদের আশঙ্কা করেন। এঁরা রাজভবনে আর যজ্ঞসভাতেই শোভা পান, লোকসভায় বিচিত্র কথা বলতে পারেন; পরের ছিদ্র অন্বেষণে, মানুষের চরিত্র বিচারে এবং খাদ্যের দোষগুণ নির্ণয়ে এঁরা নিপুণ। এই পণ্ডিতদের পশ্চাতে রেখে আপনারা শত্রুবধের উপায় স্থির করুন।

 কর্ণ বললেন, মৎস্যরাজ বা অর্জুন যিনিই আসনে আমি শরাঘাতে নিরস্ত করব। জামদগ্ন্য পরশুরামের কাছে যে অস্ত্র পেয়েছি তার দ্বারা এবং নিজের বলে আমি ইন্দ্রের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারি। অর্জুনের ধ্বজস্থিত বানর আজ আমার ভল্লের আঘাতে নিহত হবে, ভূতগণ আর্তনাদ ক’রে পালাবে। আজ অর্জুনকে রথ থেকে নিপাতিত ক’রে আমি দুর্যোধনের হৃদয়ের শল্য সমূলে উৎপাটিত করব।

 কৃপ বললেন, রাধেয়, তুমি নিষ্ঠুরপ্রকৃতি, সর্বদাই যুদ্ধ করতে চাও, তার ফল কি হবে তা ভাব না। শাস্ত্রে অনেক প্রকার নীতির উল্লেখ আছে, তার মধ্যে যুদ্ধকেই প্রাচীন পণ্ডিতগণ সর্বাপেক্ষা পাপজনক বলেছেন। দেশ কাল যদি অনুকূল হয় তবেই বিক্রমপ্রকাশ বিধেয়। অর্জুনের সঙ্গে এখন আমাদের যুদ্ধ করা উচিত নয়। কর্ণ, অর্জুন যেসকল কর্ম করেছেন তার তুল্য তুমি কি করেছ? আমরা প্রতারণা ক’রে তাঁকে তের বৎসর নির্বাসনে রেখেছি, সেই সিংহ এখন পাশমুক্ত হয়েছে, সে কি আমাদের শেষ করবে না? আমরা সকলে মিলিত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু কর্ণ, তুমি একাকী সাহস ক’রো না।

 অশ্বত্থামা বললেন, কর্ণ, আমরা গোহরণ ক’রে এখনও মৎস্যরাজ্যের সীমা পার হই নি, হস্তিনাপুরেও যাই নি, অথচ তুমি গর্বপ্রকাশ করছ। তোমার প্ররোচনায় দুর্যোধন পাণ্ডবদের সম্পত্তি হরণ করেছে, কিন্তু তুমি কি কখনও দ্বৈরথযুদ্ধে তাঁদের একজনকেও জয় করেছ? কোন্ যুদ্ধে তুমি কৃষ্ণাকে জয় করেছ—তোমার প্ররোচনায় যাঁকে একবস্ত্রে রজস্বলা অবস্থায় সভায় আনা হয়েছিল? মানুষ এবং কীট-পিপীলিকাদি পর্যন্ত সকল প্রাণীই যথাশক্তি ক্ষমা করে, কিন্তু দ্রৌপদীকে যে কষ্ট দেওয়া হয়েছে তার ক্ষমা পাণ্ডবগণ কখনই করবেন না। ধর্মজ্ঞরা বলেন, শিষ্য পুত্রের চেয়ে কম নয়, এই কারণেই অর্জুন আমার পিতা দ্রোণের প্রিয়। দুর্যোধন, তোমার জন্যই দ্যূতক্রীড়া হয়েছিল, তুমিই দ্রৌপদীকে সভায় আনিয়েছিলে, ইন্দ্রপ্রস্থরাজ্য তুমিই হরণ করেছ, এখন তুমিই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তোমার মাতুল ক্ষত্রধর্মবিশারদ দুষ্টদ্যূতকার এই শকুনিও যুদ্ধ করুন। কিন্তু জেনো, অর্জুনের গাণ্ডীব অক্ষক্ষেপণ করে না, তীক্ষ্ণ নিশ্চিত বাণই ক্ষেপণ করে, আর সেইসকল বাণ মধ্যপথে থেমে যায় না। আচার্য (দ্রোণ) যদি ইচ্ছা করেন তো যুদ্ধ করুন, আমি ধনঞ্জয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করব না। যদি মৎস্যরাজ এখানে আসতেন তবে তাঁর সঙ্গে আমি যুদ্ধ করতাম।

 ভীষ্ম বললেন, আচার্যপুত্র (অশ্বত্থামা), কর্ণ যা বলেছেন, তার উদ্দেশ্য তোমাকে যুদ্ধে উত্তেজিত করা। তুমি ক্ষমা কর, এ সময়ে নিজেদের মধ্যে ভেদ হওয়া ভাল নয়, আমাদের মিলিত হয়েই যুদ্ধ করতে হবে।

 অশ্বত্থামা বললেন, গুরুদেব (দ্রোণ) কারও উপর আক্রোশের বশে অর্জুনের প্রশংসা করেন নি,

শত্রোরপি গুণা বাচ্যা দোষা বাচ্যা গুরোরপি।
সর্বথা সর্বযত্নেন পুত্রে শিষ্যে হিতং বদেৎ॥

—শত্রুরও গুণ বলা উচিত, গুরুরও দোষ বলা উচিত, সর্বপ্রকারে সর্বপ্রযত্নে পুত্র ও শিষ্যকে হিতবাক্য বলা উচিত।

 দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের নিকট ক্ষমা চাইলেন। কর্ণ ভীষ্ম ও কৃপের অনুরোধে দ্রোণ প্রসন্ন হয়ে বললেন, অজ্ঞাতবাস শেষ না হ’লে অর্জুন আমাদের দর্শন দিতেন না। আজ গোধন উদ্ধার না করে তিনি নিবৃত্ত হবেন না। আপনারা এমন মন্ত্রণা দিন যাতে দুর্যোধনের অযশ না হয় কিংবা ইনি পরাজিত না হন।

 জ্যোতিষ গণনা ক’রে ভীষ্ম বললেন, তের বৎসর পূর্ণ হয়েছে এবং তা নিশ্চিতভাবে জেনেই অর্জুন এসেছেন। পাণ্ডবগণ ধর্মজ্ঞ, তাঁরা লোভী নন, অন্যায় উপায়ে তাঁরা রাজ্যলাভ করতে চান না। দুর্যোধন, যুদ্ধে একান্তসিদ্ধি হয় এমন আমি কদাপি দেখি নি, এক পক্ষের জীবন বা মৃত্যু, জয় বা পরাজয় অবশ্যই হয়। অর্জুন এসে পড়লেন, এখন যুদ্ধ করবে কিংবা ধর্মসম্মত কার্য করবে তা সত্বর স্থির কর।

 দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আমি পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেব না, অতএব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ন। ভীষ্ম বললেন, তা হলে আমি যা ভাল মনে করি তা বলছি শোন।—তুমি সৈন্যের এক-চতুর্থ ভাগ নিয়ে হস্তিনাপুরে যাও, আর এক-চতুর্থাংশ গরু নিয়ে চলে যাক। অবশিষ্ট অর্ধ ভাগ সৈন্য নিয়ে আমরা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব।

 দুর্যোধন একদল সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন, গরু নিয়ে আর একদল সৈন্য গেল। তার পর দ্রোণ অশ্বত্থামা কৃপ কর্ণ ও ভীষ্ম ব্যূহ রচনা ক’রে যথাক্রমে সেনার মধ্যভাগে, বাম পার্শ্বে, দক্ষিণ পার্শ্বে, সম্মুখে ও পশ্চাতে অবস্থান করলেন।

১৪। কৌরবগণের পরাজয়

 দ্রোণ বললেন, অর্জুনের ধ্বজাগ্র দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর শঙ্খধ্বনির সঙ্গে ধ্বজস্থিত বানরও ঘোর গর্জন করছে। অর্জুন তাঁর গাণ্ডীব আকর্ষণ করছেন; এই তাঁর দুই বাণ এসে আমার চরণে পড়ল, এই আর দুই বাণ আমার কর্ণ স্পর্শ ক’রে চ’লে গেল। তিনি দুই বাণ দিয়ে আমাকে প্রণাম করলেন, আর দুই বাণে আমাকে কুশলপ্রশ্ন করলেন। অর্জুন দেখলেন, দ্রোণ ভীষ্ম কর্ণ প্রভৃতি রয়েছেন কিন্তু দুর্যোধন নেই। তিনি উত্তরকে বললেন, এই সৈন্যদল এখন থাকুক, আগে দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করব। নিরামিষ[] যুদ্ধ হয় না, আমরা দুর্যোধনকে জয় ক’রে গোধন উদ্ধার ক’রে আবার এদিকে আসব।

 অজুর্নকে অন্যদিকে যেতে দেখে দ্রোণ বললেন, উনি দুর্যোধন ভিন্ন অন্য কাকেও চান না, চল, আমরা পশ্চাতে গিয়ে ওঁকে ধরব।

 পতঙ্গপালের ন্যায় শরজালে অর্জুন কুরুসৈন্য আচ্ছন্ন করলেন। তাঁর শঙ্খের শব্দে, রথচক্রের ঘর্ঘর রবে, গাণ্ডীবের টংকারে, এবং ধ্বজস্থিত অমানুষ ভূতগণের গর্জনে পৃথিবী কম্পিত হ’ল। অপহৃত গরুর দল ঊর্ধ্বপুচ্ছ হয়ে হম্বারবে মৎস্যরাজ্যের দক্ষিণ দিকে ফিরতে লাগল। গোধন জয় করে অর্জুন দুর্যোধনের অভিমুখে যাচ্ছিলেন এমন সময় কুরুপক্ষীয় অন্যান্য বীরগণকে দেখে তিনি উত্তরকে বললেন, কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চল।

 দুর্যোধনের ভ্রাতা বিকর্ণ এবং আরও কয়েকজন যোদ্ধা কর্ণকে রক্ষা করতে এলেন, কিন্তু অর্জুনের শরে বিধ্বস্ত হয়ে পালিয়ে গেলেন। কর্ণের ভ্রাতা সংগ্রামজিৎ নিহত হলেন, কর্ণও অর্জুনের বজ্রতুল্য বাণে নিপীড়িত হয়ে যুদ্ধের সম্মুখ ভাগ থেকে প্রস্থান করলেন।

 ইন্দ্রাদি তেত্রিশ দেবতা এবং পিতৃগণ মহর্ষিগণ গন্ধর্বগণ প্রভৃতি বিমানে ক’রে যুদ্ধ দেখতে এলেন। তাঁদের আগমনে যদ্ধভূমির ধূলি দূর হ’ল, দিব্যগন্ধ বায়ু বইতে লাগল। অর্জুনের আদেশে উত্তর কৃপাচার্যের কাছে রথ নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর কৃপাচার্যের রথের চার অশ্ব অর্জুনের শরে বিদ্ধ হয়ে লাফিয়ে উঠল, কৃপ প’ড়ে গেলেন। তাঁর গৌরব রক্ষার জন্য অর্জুন আর শরাঘাত করলেন না; কিন্তু কৃপ আবার উঠে অর্জুনকে দশ বাণে বিদ্ধ করলেন, অর্জুনও কৃপের কবচ ধনু রথ ও অশ্ব বিনষ্ট করলেন, তখন অন্য যোদ্ধারা কৃপকে নিয়ে বেগে প্রস্থান করলেন।

 দ্রোণাচার্যের সম্মুখীন হয়ে অর্জুন অভিবাদন ক’রে স্মিতমুখে সবিনয়ে বললেন, আমরা বনবাস সমাপ্ত ক’রে শত্রুর উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছি, আপনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হ’তে পারেন না। আপনি যদি আগে আমাকে প্রহার করেন তবেই আমি প্রহার করব। দ্রোণ অর্জুনের প্রতি অনেকগুলি বাণ নিক্ষেপ করলেন। তখন দুজনে প্রবল যদ্ধ হ’তে লাগল, অর্জুনের বাণবর্ষণে দ্রোণ আচ্ছন্ন হলেন। অশ্বত্থামা বাধা দিতে এলেন। তিনি মনে মনে অর্জুনের প্রশংসা করলেন কিন্তু ক্রুদ্ধও হলেন। অর্জুন অশ্বত্থামার দিকে অগ্রসর হয়ে দ্রোণকে স’রে যাবার পথ দিলেন, দ্রোণ বিক্ষতদেহে বেগে প্রস্থান করলেন।

 অর্জুনের সঙ্গে কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর অশ্বত্থামার বাণ নিঃশেষ হয়ে গেল, তখন অর্জুন কর্ণের দিকে ধাবিত হলেন। দুজনে বহুক্ষণ যুদ্ধের পর অর্জুনের শরে কর্ণের বক্ষ বিদ্ধ হ’ল, তিনি বেদনায় কাতর হয়ে উত্তর দিকে পলায়ন করলেন। তার পর অর্জুন উত্তরকে বললেন, তুমি ওই হিরণ্ময় ধ্বজের নিকট রথ নিয়ে চল, ওখানে পিতামহ ভীষ্ম আমার প্রতীক্ষা করছেন। উত্তর বললেন, আমি বিহ্বল হয়েছি, আপনাদের অস্ত্রক্ষেপণ দেখে আমার বোধ হচ্ছে যেন দশ দিক ঘুরছে, বসা রুধির আর মেদের গন্ধে আমার মূর্ছা আসছে, ভয়ে হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে, আমার আর কশা ও বল্গা ধরবার শক্তি নেই। অর্জুন বললেন, ভয় পেয়ো না, স্থির হও, তুমিও এই যুদ্ধে অদ্ভুত কর্মকৌশল দেখিয়েছ। ধীর হয়ে অশ্বচালনা কর, ভীষ্মের নিকটে আমাকে নিয়ে চল, আজ তোমাকে আমার বিচিত্র অস্ত্রশিক্ষা দেখাব। উত্তর আশ্বস্ত হয়ে ভীষ্মরক্ষিত সৈন্যের মধ্যে রথ নিয়ে গেলেন।

 ভীষ্ম ও অর্জুন পরস্পরের প্রতি প্রাজাপত্য ঐন্দ্র আগ্নেয় বারুণ বায়ব্য প্রভৃতি দারুণ অস্ত্র নিক্ষেপ করতে লাগলেন। পরিশেষে ভীষ্ম শরাঘাতে অচেতনপ্রায় হলেন, তাঁর সারথি তাঁকে যুদ্ধভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তার পর দুর্যোধন রথারোহণে এসে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। তিনি বহুক্ষণ যুদ্ধের পর বাণবিদ্ধ হয়ে রুধির বমন করতে করতে পলায়ন করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, কীর্তি ও বিপুল যশ পরিত্যাগ ক’রে চ’লে যাচ্ছ কেন? তোমার দুর্যোধন নাম আজ মিথ্যা হ’ল, তুমি যুদ্ধ ত্যাগ করে পালাচ্ছ।

 অর্জুনের তীক্ষ্ণ বাক্য শুনে দুর্যোধন ফিরে এলেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতিও তাঁকে রক্ষা করতে এলেন এবং অর্জুনকে বেষ্টন ক’রে সর্বদিক থেকে শরবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন অর্জুন ইন্দ্রদত্ত সম্মোহন অস্ত্র প্রয়োগ করলেন, কুরু পক্ষের সকলের সংজ্ঞা লুপ্ত হ’ল। উত্তরার অনুরোধ স্মরণ করে অর্জুন বললেন, উত্তর, তুমি রথ থেকে নেমে দ্রোণ আর কৃপের শুক্ল বস্ত্র, কর্ণের পীত বস্ত্র, এবং অশ্বত্থামা ও দুর্যোধনের নীল বস্ত্র খুলে নিয়ে এস। ভীষ্ম বোধ হয় সংজ্ঞাহীন হন নি, কারণ তিনি আমার অস্ত্র প্রতিষেধের উপায় জানেন, তুমি তাঁর বাম দিক দিয়ে যাও। দ্রোণ প্রভৃতির বস্ত্র নিয়ে এসে উত্তর পুনর্বার রথে উঠলেন এবং অর্জুনকে নিয়ে রণভূমি থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

 অর্জুনকে যেতে দেখে ভীষ্ম তাঁকে শরাঘাত করলেন, অর্জুন ভীষ্মের অশ্বসকল বধ ক’রে তাঁর পার্শ্বদেশ দশ বাণে বিদ্ধ করলেন। দুর্যোধন সংজ্ঞালাভ ক’রে বললেন, পিতামহ, অর্জুনকে অস্ত্রাঘাত করুন, যেন ও চ’লে যেতে না পারে। ভীষ্ম হেসে বললেন, তোমার বুদ্ধি আর বিক্রম এতক্ষণ কোথায় ছিল? তুমি যখন ধনবাণ ত্যাগ ক’রে নিস্পন্দ হয়ে পড়ে ছিলে তখন অর্জুন কোনও নৃশংস কর্ম করেন নি, তিনি ত্রিলোকের রাজ্যের জন্যও স্বধর্ম ত্যাগ করেন না, তাই তোমরা সকলে এই যুদ্ধে নিহত হও নি। এখন তুমি নিজের দেশে ফিরে যাও, অর্জুনও গরু নিয়ে প্রস্থান করুন। দুর্যোধন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যুদ্ধের ইচ্ছা ত্যাগ ক’রে নীরব হলেন, অন্যান্য সকলেই ভীষ্মের বাক্য অনুমোদন করে দুর্যোধনকে নিয়ে ফিরে যাবার ইচ্ছা করলেন।

 কুরুবীরগণ চ’লে যাচ্ছেন দেখে অর্জুন প্রীত হলেন এবং গুরুজনদের মিষ্টবাক্যে সম্মান জানিয়ে কিছুদূর অনুগমন করলেন। তিনি পিতামহ ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্যকে আনতমস্তকে প্রণাম জানালেন, অশ্বত্থামা কৃপ ও মান্য কৌরবগণকে বিচিত্র বাণ দিয়ে অভিবাদন করলেন, এবং শরাঘাতে দুর্যোধনের রত্নভূষিত মুকুট ছেদন করলেন। তার পর অর্জুন উত্তরকে বললেন, রথের অশ্ব ঘুরিয়ে নাও, তোমার গোধনের উদ্ধার হয়েছে, এখন আনন্দে রাজধানীতে ফিরে চল।

১৫। অর্জুন ও উত্তরের প্রত্যাবর্তন — বিরাটের পুত্রগর্ব

 যেসকল কৌরবসৈন্য পালিয়ে গিয়ে বনে লুকিয়েছিল তারা ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হ’য়ে কম্পিতদেহে অর্জুনকে প্রণাম করে বললে, পার্থ, আমরা এখন কি করব? অর্জুন তাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, তোমাদের মঙ্গল হ’ক. তোমরা নির্ভয়ে প্রস্থান কর। তারা অর্জুনের আয়ু কীর্তি ও যশ বৃদ্ধির আশীর্বাদ করে চ’লে গেল।

 অর্জুন উত্তরকে বললেন, বৎস, তুমি রাজধানীতে গিয়ে তোমার পিতার নিকট এখন আমাদের পরিচয় দিও না, তা হ’লে তিনি ভয়ে প্রাণত্যাগ করবেন। তুমি নিজেই যুদ্ধ ক’রে কৌরবদের পরাস্ত করেছ এবং গোধন উদ্ধার করেছ এই কথা ব’লো। উত্তর বললেন, সব্যসাচী, আপনি যা করেছেন তা আর কেউ পারে না, আমার তো সে শক্তি নেইই। তথাপি আপনি আদেশ না দিলে আমি পিতাকে প্রকৃত ঘটনা জানাব না।

 অর্জুন বিক্ষতদেহে শ্মশানে শমীবৃক্ষের নিকটে এলেন। তখন তাঁর ধ্বজস্থিত মহাকপি ও ভূতগণ আকাশে চ’লে গেল, দৈবী মায়াও অন্তর্হিত হ’ল। উত্তর রথের উপরে পূর্বের ন্যায় সিংহধ্বজ বসিয়ে দিলেন এবং পাণ্ডবগণের অস্থাদি শমীবৃক্ষে রেখে রথ চালালেন। নগরের পথে এসে অর্জুন বললেন, রাজপুত্র, দেখ, গোপালকগণ তোমাদের সমস্ত গরু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখানে অশ্বদের স্নান করিয়ে জল খাইয়ে বিশ্রামের পর অপরাহ্নে বিরাটনগরে যাব। তুমি কয়েকজন গোপকে ব’লে দাও তারা শীঘ্র নগরে গিয়ে তোমার জয় ঘোষণা করুক। অর্জুন আবার বৃহন্নলার বেশ ধারণ করলেন এবং অপরাহ্নে উত্তরের সারথি হয়ে নগরে যাত্রা করলেন।

 ওদিকে বিরাট রাজা ত্রিগর্তদের পরাজিত ক’রে চার জন পাণ্ডবের সঙ্গে রাজধানীতে ফিরে এলেন। তিনি শুনলেন, কৌরবরা রাজ্যের উত্তর দিকে এসে গোধন হরণ করেছে, রাজকুমার উত্তর বৃহন্নলাকে সঙ্গে নিয়ে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ দুর্যোধন ও অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেছেন। বিরাট অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন হয়ে তাঁর সৈন্যদলকে বললেন, তোমরা শীঘ্র গিয়ে দেখ কুমার জীবিত আছেন কিনা; নপুংসক যার সারথি তার বাঁচা অসম্ভব মনে করি। যুধিষ্ঠির সহাস্যে বললেন, মহারাজ, বৃহন্নলা যদি সারথি হয় তবে শত্রুরা আপনার গোধন নিতে পারবে না, তার সাহায্যে আপনার পুত্র কৌরবগণকে এবং দেবাসুর প্রভৃতিকেও জয় করতে পারবেন।

 এমন সময় উত্তরের দূতরা এসে বিজয়সংবাদ দিলে। বিরাট আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে মন্ত্রীদের আজ্ঞা দিলেন, রাজমার্গ পতাকা দিয়ে সাজাও, দেবতাদের পূজা দাও, কুমারগণ যোদ্ধগণ ও সালংকারা গণিকাগণ বাদ্যসহকারে আমার পুত্রের প্রত্যুদ্‌গমন করুক, হস্তীর উপরে ঘণ্টা বাজিয়ে সমস্ত চতুষ্পথে আমার জয় ঘোষণা করা হ’ক, উত্তম বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে বহু কুমারীদের সঙ্গে উত্তরা বৃহন্নলাকে আনতে যাক। তার পর বিরাট বললেন, সৈরিন্ধ্রী, পাশা নিয়ে এস; কঙ্ক, খেলবে এস। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, শুনেছি হৃষ্ট অবস্থায় দ্যূতক্রীড়া অনুচিত। দ্যূতে বহু দোষ, তা বর্জন করাই ভাল। পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে থাকবেন, তিনি তাঁর বিশাল রাজ্য এবং দেবতুল্য ভ্রাতাদেরও দ্যূতক্রীড়ায় হারিয়েছিলেন। তবে আপনি যদি নিতান্ত ইচ্ছা করেন তবে খেলব।

 খেলতে খেলতে বিরাট বললেন, দেখ, আমার পুত্র কৌরববীরগণকেও জয় করেছে। যুধিষ্ঠির বললেন, বৃহন্নলা যার সারথি সে জয়ী হবে না কেন। বিরাট ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, নীচ ব্রাহ্মণ, তুমি আমার পুত্রের সমান জ্ঞান ক’রে একটা নপুংসকের প্রশংসা করছ, কি বলতে হয় তা তুমি জান না, আমার অপমান করছ। নপুংসক কি ক’রে ভীষ্মদ্রোণাদিকে জয় করতে পারে? তুমি আমার বয়স্য সেজন্য অপরাধ ক্ষমা করলাম, যদি বাঁচতে চাও তবে আর এমন কথা ব’লো না। যুধিষ্ঠির বললেন, মহারাজ, ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতি মহারথগণের সঙ্গে বৃহন্নলা ভিন্ন আর কে যুদ্ধ করতে পারেন? ইন্দ্রাদি দেবগণও পারেন না। বিরাট বললেন, বহুবার নিষেধ করলেও তুমি বাক্য সংযত করছ না; শাসন না করলে কেউ ধর্মপথে চলে না। এই বলে বিরাট অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরের মুখে পাশা দিয়ে আঘাত করলেন। যুধিষ্ঠিরের নাক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল, তিনি হাত দিয়ে তা ধ’রে দ্রৌপদীর দিকে চাইলেন। দ্রৌপদী তখনই একটি জলপূর্ণ স্বর্ণ পাত্র এনে নিঃসৃত রক্ত ধরলেন। এই সময়ে দ্বারপাল এসে সংবাদ দিলে যে রাজপুত্র উত্তর এসেছেন, তিনি বৃহন্নলার সঙ্গে দ্বারে অপেক্ষা করছেন। বিরাট বললেন, তাঁদের শীঘ্র নিয়ে এস।

 অর্জুনের এই প্রতিজ্ঞা ছিল যে কোনও লোক যদি যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কারণে যুধিষ্ঠিরের রক্তপাত করে তবে সে জীবিত থাকবে না। এই প্রতিজ্ঞা স্মরণ ক’রে যুধিষ্ঠির দ্বারপালকে বললেন, কেবল উত্তরকে নিয়ে এস বৃহন্নলাকে নয়। উত্তর এসে পিতাকে প্রণাম ক’রে দেখলেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এক প্রান্তে ভূমিতে ব’সে আছেন, তাঁর নাসিকা রক্তাক্ত, দ্রৌপদী তাঁর কাছে রয়েছেন। উত্তর ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজ, কে এই পাপকার্য করেছে? বিরাট বললেন আমি এই কুটিলকে প্রহার করেছি, এ আরও শাস্তির যোগ্য; তোমার প্রশংসাকালে এ একটা নপুংসকের প্রশংসা করছিল। উত্তর বললেন, মহারাজ, আপনি অকার্য করেছেন, শীঘ্র এঁকে প্রসন্ন করুন, ইনি যেন ব্রহ্মশাপে আপনাকে সবংশে দগ্ধ না করেন। পুত্রের কথায় বিরাট যুধিষ্ঠিরের নিকট ক্ষমা চাইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা, আমি পূর্বেই ক্ষমা করেছি, আমার ক্রোধ নেই। যদি আমার রক্ত ভূমিতে পড়ত তবে আপনি রাজ্য সমেত বিনষ্ট হতেন।

 যুধিষ্ঠিরের রক্তস্রাব থামলে অর্জুন এলেন এবং প্রথমে রাজাকে তার পর যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করলেন। বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বিরাট তাঁর পুত্রকে বললেন, বৎস, তোমার তুল্য পুত্র আমার হয় নি, হবেও না। মহাবীর কর্ণ, কালাগ্নির ন্যায় দুঃসহ ভীষ্ম, ক্ষত্রিয়গণের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা, বিপক্ষের ভয়প্রদ কৃপাচার্য, মহাবল দুর্যোধন—এঁদের সঙ্গে তুমি কি ক’রে যুদ্ধ করলে? এইসকল নরশ্রেষ্ঠকে পরাজিত ক’রে তুমি গোধন উদ্ধার করেছ, যেন শার্দূলের কবল থেকে মাংস কেড়ে এনেছ।

 উত্তর বললেন, আমি গোধন উদ্ধার করি নি, শত্রুজয়ও করি নি। আমি ভয় পেয়ে পালাচ্ছিলাম, এক দেবপুত্র আমাকে নিবারণ করলেন। তিনিই রথে উঠে ভীষ্মাদি ছয় রথীকে পরাস্ত ক’রে গোধন উদ্ধার করেছেন। সিংহের ন্যায় দৃঢ়কায় সেই যুবা কৌরবগণকে উপহাস ক’রে তাঁদের বসন হরণ করেছেন। বিরাট বললেন, সেই মহাবাহু দেবপুত্র কোথায়? উত্তর বললেন, পিতা, তিনি অন্তর্হিত হয়েছেন, বোধ হয় কাল বা পরশু দেখা দেবেন।

 বৃহন্নলাবেশী অর্জুন বিরাটের অনুমতি নিয়ে তাঁর কন্যা উত্তরাকে কৌরবগণের মহার্ঘ্য বিচিত্র সূক্ষ্ম বসনগুলি দিলেন। তার পর তিনি নির্জনে উত্তরের সঙ্গে মন্ত্রণা করে যুধিষ্ঠিরাদির আত্মপ্রকাশের উদ্‌যোগ করলেন।

  1. বিরাট রাজ্যের দক্ষিণে যে সব গরু ছিল তাদের গ্রহণ বা হরণ।
  2. এই গোহরণ বা গোগ্রহ বিরাট রাজ্যের উত্তরে হয়েছিল।
  3. যে যুদ্ধে লোভ্য বা আকাঙ্ক্ষিত বস্তু নেই।