মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বিরাটপর্ব/কীচকবধপর্বাধ্যায়

॥ কীচকবধপর্বাধ্যায়॥

৫। কীচক, সুদেষ্ণা ও দ্রৌপদী

 পাণ্ডবরা মৎস্য রাজধানীতে দশ মাস অজ্ঞাতবাসে কাটালেন। একদিন বিরাটের সেনাপতি কীচক তাঁর ভগিনী রাজমহিষী সুদেষ্ণার গৃহে পদ্মাননা দ্রৌপদীকে দেখতে পেলেন। তিনি কামাবিষ্ট হয়ে সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে যেন হাসতে হাসতে বললেন, বিরাটভবনে এই রমণীকে আমি পূর্বে দেখি নি। মদিরা যেমন গন্ধে উন্মত্ত করে এই রমণীর রূপ সেইপ্রকার আমাকে উন্মত্ত করেছে। এই মনোহারিণী সুন্দরী কে, কোথা থেকে এসেছে? এ আমার চিত্ত মথিত করেছে, এর সঙ্গে মিলন ভিন্ন আমার রোগের অন্য ঔষধ নেই। তোমার এই পরিচারিকা যে কর্ম করছে তা তার যোগ্য নয়, সে আমার গৃহে এসে আমার সমস্ত সম্পত্তির উপর কর্তৃত্ব এবং গৃহ শোভিত করুক।

 শৃগাল যেমন মৃগেন্দ্রকন্যার কাছে যায় সেইরূপ কীচক দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, সুন্দরী, তোমার রূপ ও প্রথম বয়স বৃথা নষ্ট হচ্ছে, পুরুষে যদি ধারণ না করে তবে পুষ্পমালা শোভা পায় না। চারুহাসিনী, আমার পুরাতন স্ত্রীদের আমি ত্যাগ করব, তারা তোমার দাসী হবে, আমি তোমার দাস হব। দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, সূতপত্র, আমি নিম্নবর্ণের সৈরিন্ধ্রী, কেশসংস্কাররূপ হীন কার্য করি, আপনার কামনার যোগ্য নই। আমি পরের পত্নী, বীরগণ আমাকে রক্ষা করেন। যদি আমাকে পাবার চেষ্টা করেন তবে আমার গন্ধর্ব পতিগণ আপনাকে বধ করবেন। অবোধ বালক যেমন নদীর এক তীরে থেকে অন্য তীরে যেতে চায়, রোগার্ত যেমন কালরাত্রির প্রার্থনা করে, মাতৃক্রোড়স্থ শিশু যেমন চন্দ্র চায়, আপনি সেইরূপ আমাকে চাচ্ছেন।

 দ্রৌপদী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে কীচক সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে বললেন, সৈরিন্ধ্রী যাতে আমাকে ভজনা করে সেই উপায় কর, তবেই আমার জীবনরক্ষা হবে। সুদেষ্ণা তাঁর ভ্রাতা কীচকের অভিলাষ, নিজের ইষ্ট, এবং দ্রৌপদীর উদ্‌বেগ সম্বন্ধে চিন্তা করে বললেন, তুমি কোনও পর্বের উপলক্ষ্যে নিজের ভবনে সুরা ও অন্নাদি প্রস্তুত করাও, আমি সুরা আনবার জন্য সৈরিন্ধ্রীকে তোমার কাছে পাঠাব, তখন তুমি নির্জন স্থানে তাকে চাটুবাক্যে সম্মত করিও।

 উত্তম মদ্য, ছাগ শূকর প্রভৃতির মাংস, এবং অন্যান্য খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত করিয়ে কীচক রাজমহিষীকে নিমন্ত্রণ করলেন। সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি কীচকের গৃহ থেকে পানীয় নিয়ে এস, আমার বড় পিপাসা হয়েছে। দ্রৌপদী বললেন, রাজ্ঞী, আমি কীচকের কাছে যাব না, তিনি নির্লজ্জ। আমি ব্যভিচারিণী হতে পারব না, আপনার কর্মে নিযুক্ত হবার কালে যে সময় (শর্ত) করেছিলাম তা আপনি জানেন। আপনার অনেক দাসী আছে, তাদের কাকেও পাঠান। সুদেষ্ণা বললেন, আমি তোমাকে পাঠালে কীচক তোমার কোনও অনিষ্ট করবেন না। এই ব’লে তিনি দ্রৌপদীকে একটি ঢাকনিযুক্ত স্বর্ণময় পানপাত্র দিলেন।

 দ্রৌপদী শঙ্কিতমনে সরোদনে কীচকের আবাসে গেলেন এবং ক্ষণকাল সূর্যের আরাধনা করলেন। সূর্যের আদেশে এক রাক্ষস অদৃশ্যভাবে দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে লাগল।

৬। কীচকের পদাঘাত

 দ্রৌপদীকে দেখে কীচক আনন্দে ব্যস্ত হয়ে উঠে বললেন, সুকেশী, আজ আমার সুপ্রভাত, তুমি আমার অধীশ্বরী, তোমাকে সুবর্ণহার শাঁখা কুণ্ডল কেয়ূর মণিরত্ন ও কৌষেয় বস্ত্রাদি দেব। তোমার জন্য দিব্য শয্যা প্রস্তুত আছে, সেখানে চল, আমার সঙ্গে মধুমাধবী (মধুগ্ধজাত মদ্য) পান কর। দ্রৌপদী বললেন, রাজমহিষী আমাকে সুরা আনবার জন্য পাঠিয়েছেন। কীচক বললেন, দাসীরা তা নিয়ে যাবে। এই ব’লে তিনি দ্রৌপদীর হাত এবং উত্তরীয় বস্ত্র ধরলেন, দ্রৌপদী ঠেলা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দিলেন। কীচক সবলে আবার ধরলেন, দ্রৌপদী কম্পিতদেহে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে প্রবল ধাক্কা দিলেন, পাপাত্মা কীচক ভূমিতে প’ড়ে গেলেন। দ্রৌপদী দ্রুতবেগে বিরাট রাজার সভায় এলেন, কীচক সঙ্গে সঙ্গে এসে রাজার সমক্ষেই দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ ক’রে তাঁকে পদাঘাত করলেন। তখন সেই সূর্যনিযুক্ত রাক্ষস বায়ুবেগে ধাবিত হয়ে কীচককে আঘাত করলে, কীচক ঘুরতে ঘুরতে ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় ভূপতিত হলেন।

 রাজসভায় যুধিষ্ঠির ও ভীম উপস্থিত ছিলেন। দ্রৌপদীর অপমান দেখে কীচককে বধ করবার ইচ্ছায় ভীম দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করতে লাগলেন। পাছে লোকে তাঁদের জেনে ফেলে এই ভয়ে যুধিষ্ঠির নিজের অঙ্গুষ্ঠ ভীমের অঙ্গুষ্ঠে ঠেকিয়ে তাঁকে নিবারণ করলেন। দ্রৌপদী তাঁদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত ক’রে রুদ্রনয়নে বিরাট রাজাকে যেন দগ্ধ করে বললেন, যাঁদের শত্রু বহুদূরদেশে বাস ক’রেও ভয়ে নিদ্রা যায় না, তাঁদেরই আমি মানিনী ভার্যা, সেই আমাকে সূতপুত্র পদাঘাত করেছে! যাঁরা শরণাপন্নকে রক্ষা করেন সেই মহারথগণ আজ কোথায় আছেন? বিরাট যদি কীচককে ক্ষমা ক’রে ধর্ম নষ্ট করেন তবে আমি কি করতে পারি? রাজা আপনি কীচকের প্রতি রাজবৎ আচরণ করছেন না, আপনার ধর্ম দস্যুর ধর্ম, তা এই রাজসভায় শোভা পাচ্ছে না। কীচক ধর্মজ্ঞ নয়, মৎস্যরাজও ধর্মজ্ঞ নন, যে সভাসদ্‌গণ তাঁর অনুবর্তী তাঁরাও ধর্মজ্ঞ নন।

 সাশ্রুনয়না দ্রৌপদীর তিরস্কার শুনে বিরাট বললেন, সৈরিন্ধ্রী, আমার অজ্ঞাতে তোমাদের কি বিবাদ হয়েছে তা আমি জানি না। তথ্য না জেনে আমি কি করে বিচার করব? সভাসদ্‌গণ দ্রৌপদীর প্রশংসা এবং কীচকের নিন্দা করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী যাঁর ভার্যা তিনি মহাভাগ্যবান। এরূপ বরবর্ণিনী মনুষ্যলোকে সুলভ নয়, বোধ হয় ইনি দেবী।

 ক্রোধে যুধিষ্ঠিরের ললাট ঘর্মাক্ত হ’ল। তিনি বললেন, সৈরিন্ধ্রী, তুমি এখানে থেকো না, দেবী সুদেষ্ণার গৃহে যাও। আমার মনে হয় তোমার গন্ধর্ব পতিদের বিবেচনায় এই কাল ক্রোধের উপযুক্ত নয়, নতুবা তাঁরা প্রতিশোধের জন্য দ্রুতবেগে উপস্থিত হতেন। তুমি আর এখানে নটীর ন্যায় রোদন ক’রো না, তাতে এই রাজসভায় যাঁরা দ্যূতক্রীড়া করছেন তাঁদের বিঘ্ন হবে। তুমি যাও, গন্ধর্বগণ তোমার দুঃখ দূর করবেন।

 দ্রৌপদী বললেন, যাঁদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্যূতাসক্ত সেই অতীব দয়ালুদের জন্যই আমাকে ব্রতচারিণী হ’তে হয়েছে। আমার অপমানকারীদের বধ করাই তাঁদের উচিত ছিল। দ্রৌপদী অন্তঃপুরে চলে গেলেন। তাঁর রোদনের কারণ শুনে সুদেষ্ণা বললেন, সুকেশী, আমার কথাতেই তুমি কীচকের কাছে সুরা আনতে গিয়ে অপমানিত হয়েছ, যদি চাও তবে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়াব। দ্রৌপদী বললেন, কীচক যাঁদের কাছে অপরাধী তাঁরাই তাকে বধ করবেন, সে আজই পরলোকে যাবে।

 দ্রৌপদী নিজের বাসগৃহে গিয়ে গাত্র ও বস্ত্র ধুয়ে ফেললেন। তিনি দুঃখে কাতর হয়ে স্থির করলেন, ভীম ভিন্ন আর কেউ তাঁর প্রিয়কার্য করতে পারবেন না। রাত্রিকালে তিনি শয্যা থেকে উঠে ভীমের গৃহে গেলেন, এবং দুর্গম বনে সিংহী যেমন সিংহকে আলিঙ্গন করে সেইরূপ ভীমকে আলিঙ্গন করে বললেন, ভীমসেন, ওঠ ওঠ, মৃতের ন্যায় শুয়ে আছ কেন? যে জীবিত, তার ভার্যাকে স্পর্শ ক’রে কোনও পাপী বাঁচতে পারে না। পাপিষ্ঠ সেনাপতি কীচক আমাকে পদাঘাত ক’রে এখনও বেঁচে আছে, তুমি কি করে নিদ্রা যাচ্ছ?

 ভীম জেগে উঠে বললেন, তুমি ব্যস্ত হয়ে কেন এসেছ? সুখ দুঃখ প্রিয় অপ্রিয় যা ঘটেছে সব বল। কৃষ্ণা, তুমি সর্ব কর্মে আমাকে বিশ্বাস ক’রো, আমি তোমাকে সর্বদা বিপদ থেকে মুক্ত করব। তোমার বক্তব্য ব’লে শীঘ্র নিজ গৃহে চলে যাও, যাতে কেউ জানতে না পারে।

৭। ভীমের নিকট দ্রৌপদীর বিলাপ

 দ্রৌপদী বললেন, যুধিষ্ঠির যার স্বামী সে শোক পাবেই। তুমি আমার সব দুঃখ জান, তবে আবার জিজ্ঞাসা করছ কেন? দ্যূতসভায় দুঃশাসন সকলের সমক্ষে আমাকে দাসী বলেছিল, সেই স্মৃতি আমাকে দগ্ধ করছে। বনবাসকালে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ আমার চুল ধরে টেনেছিল, কে তা সইতে পারে? আজ মৎস্যরাজের সমক্ষেই কীচক আমাকে পদাঘাত করেছে, সেই অপমানের পর আমার ন্যায় কোন্ নারী জীবিত থাকতে পারে? বিরাট রাজার সেনাপতি ও শ্যালক দুর্মতি কীচক সর্বদা আমাকে বলে—তুমি আমার ভার্যা হও। ভীম, তোমার দ্যূতাসক্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার জন্যই আমি অনন্ত দুঃখ ভোগ করছি। তিনি যদি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা বা স্বর্ণ রৌপ্য বস্ত্র যান অশ্বাদি পশু পণ রাখতেন তবে বহু বৎসর দিবারাত্র খেললেও নিঃস্ব হতেন না। তিনি খেলায় প্রমত্ত হয়ে ঐশ্বর্য হারিয়েছেন, এখন মূঢ়ের ন্যায় নীরব হয়ে আছেন, মৎস্যরাজের পরিচারক হয়ে নরকভোগ করছেন। তুমি পাচক হয়ে বিরাটের সেবা কর দেখলে আমার মন অবসন্ন হয়। সুদেষ্ণার সমক্ষে তুমি সিংহ-ব্যাঘ্র-মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ কর, তা দেখলে আমি মোহগ্রস্ত হই। আমার সেই অবস্থা দেখে তিনি তাঁর সঙ্গিনীদের বলেন, এক স্থানে বাস করার ফলে এই সৈরিন্ধ্রী পাচক বল্লবের প্রতি অনুরক্ত হয়েছে, সেজন্য তাকে হিংস্র পশুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখলে শোকার্ত হয়; স্ত্রীলোকের মন দুর্জ্ঞেয়, তবে এরা দুজনেই সুন্দর এবং পরস্পরের যোগ্য। দেব দানব ও নাগগণের বিজেতা অর্জুন এখন নপুংসক সেজে শাঁখা আর কুণ্ডল প’রে বেণী ঝুলিয়ে কন্যাদের নৃত্য শেখাচ্ছেন। যাঁকে যত্ন করবার ভার কুন্তী আমাকে দিয়েছিলেন, সেই সৎস্বভাব লজ্জাশীল মিষ্টভাষী সহদেব রক্তবসন প’রে গোপগণের অগ্রণী হয়ে বিরাটকে অভিবাদন করছেন এবং রাত্রিকালে গোবৎসের চর্মের উপর শুয়ে নিদ্রা যাচ্ছেন। রূপবান বুদ্ধিমান অস্ত্রবিশারদ নকুল এখন রাজার অশ্বরক্ষক হয়েছেন। দ্যূতাসক্ত যুধিষ্ঠিরের জন্যই আমি সৈরিন্ধ্রী হয়ে সুদেষ্ণার শৌচকার্যের সহায় হয়েছি। পাণ্ডবগণের মহিষী এবং দ্রুপদের দুহিতা হয়েও আমি এই দুর্দশায় পড়েছি। কুন্তী ভিন্ন আর কারও জন্য আমি চন্দনাদি পেষণ করি নি, নিজের জন্যও নয়, এখন আমার দুই হাতে কত কড়া পড়েছে দেখ। কুন্তী বা তোমাদের কাকেও আমি ভয় করি নি, এখন কিংকরী হয়ে আমাকে বিরাটের সম্মুখে সভয়ে দাঁড়াতে হয়—আমার প্রস্তুত বিলেপন তিনি ভাল বলবেন কিনা এই সংশয়ে; অন্যের পেষা চন্দন আবার তাঁর রোচে না। ভীম, আমি দেবতাদের অপ্রিয় কোনও কার্য করিনি, আমার মরা উচিত, অভাগিনী ব’লেই বেঁচে আছি।

 শোকবিহ্বলা দ্রৌপদীর হাত ধ’রে ভীম সজলনয়নে বললেন, ধিক আমার বাহুবল, ধিক অর্জুনের গাণ্ডীব, তোমার রক্তাভ করযুগলে কড়া পড়েছে তাও দেখতে হ’ল! আমি সভামধ্যেই বিরাটের নিগ্রহ করতাম, পদাঘাতে কীচকের মস্তক চূর্ণ করতাম, মৎস্যরাজের লোকদেরও শাস্তি দিতাম, কিন্তু ধর্মরাজ কটাক্ষ ক’রে আমাকে নিবারণ করলেন। কল্যাণী, তুমি আর অর্ধমাস কষ্ট সয়ে থাক, তার পর ত্রয়োদশ বর্ষ পূর্ণ হ’লে তুমি রাজাদের রাজ্ঞী হবে।

 দ্রৌপদী বললেন, আমি দুঃখ সইতে না পেরেই অশ্রুমোচন করছি, রাজা যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করা আমার উদ্দেশ্য নয়। পাছে বিরাট আমার রূপে অভিভূত হন এই আশঙ্কায় সুদেষ্ণা উদ্‌বিগ্ন হয়ে আছেন, তা জেনে এবং নিজের দুর্বুদ্ধিবশে দুরাত্মা কীচক আমাকে প্রার্থনা করছে। তোমরা যদি কেবল অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞা পালনেই রত থাক, তবে আমি আর তোমাদের ভার্যা থাকব না। মহাবল ভীমসেন, তুমি জটাসুরের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলে, জয়দ্রথকে জয় করেছিলে, এখন আমার অপমানকারী পাপিষ্ঠ কীচককে বধ কর, প্রস্তরের উপর মৃৎকুম্ভের ন্যায় তার মস্তক চূর্ণ কর। সে জীবিত থাকতে যদি সূর্যোদয় হয় তবে আমি বিষ আলোড়ন ক’রে পান করব, তার বশীভূত হব না। এই ব’লে দ্রৌপদী ভীমের বক্ষে লগ্ন হয়ে কাঁদতে লাগলেন।

৮। কীচকবধ

 ভীম বললেন, যাজ্ঞসেনী, তুমি যা চাও তাই হবে, আমি কীচককে সবান্ধবে হত্যা করব। তুমি তাকে বল সে যেন সন্ধ্যার সময় নৃত্যশালায় তোমার প্রতীক্ষা করে। কন্যারা সেখানে দিবসে নৃত্য করে, রাত্রিতে নিজের নিজের গৃহে চলে যায়। সেখানে একটি উত্তম পর্যঙ্ক আছে, তার উপরেই আমি কীচককে তার পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাব।

 পরদিন প্রাতঃকালে কীচক রাজভবনে গিয়ে দ্রৌপদীকে বললেন, আমি রাজসভায় বিরাটের সমক্ষে তোমাকে পদাঘাত করেছিলাম, কেউ তোমাকে রক্ষা করে নি, কারণ আমি পরাক্রান্ত। বিরাট কেবল নামেই মৎস্যদেশের রাজা, বস্তুত সেনাপতি আমিই রাজা। সুশ্রোণী, তুমি আমাকে ভজনা কর, তোমাকে শত স্বর্ণমুদ্রা দিচ্ছি। শত দাসী, শত দাস এবং অশ্বতরীযুক্ত একটি রথও তোমাকে দেব। দ্রৌপদী বললেন, কীচক, এই প্রতিজ্ঞা কর যে তোমার সখা বা ভ্রাতা কেউ আমাদের সংগম জানতে পারবে না; আমি আমার গন্ধর্ব পতিদের ভয় করি। কীচক বললেন, ভীরু, আমি একাকীই তোমার শূন্য গৃহে যাব, গন্ধর্বরা জানতে পারবে না। দ্রৌপদী বললেন, রাত্রিতে নৃত্যশালা শূন্য থাকে, তুমি অন্ধকারে সেখানে যেয়ো।

 কীচকের সঙ্গে এইরূপ আলাপের পর সেই দিনের অবশিষ্ট ভাগ দ্রৌপদীর কাছে একমাসের তুল্য দীর্ঘ বোধ হ’তে লাগল। তিনি পাকশালার ভীমের কাছে গিয়ে সংবাদ দিলেন। ভীম আনন্দিত হয়ে বললেন, আমি সত্য ধর্ম ও ভ্রাতাদের নামে শপথ ক’রে বলছি, আমি গুপ্ত স্থানে বা প্রকাশ্যে কীচককে চূর্ণ করব, মৎস্যদেশের লোকে যদি যুদ্ধ করতে আসে, তবে তাদেরও সংহার করব, তার পর দুর্যোধনকে বধ ক’রে রাজ্যলাভ করব; যুধিষ্ঠির বিরাটের সেবা করতে থাকুন। দ্রৌপদী বললেন, বীর, তুমি আমার জন্য সত্যভ্রষ্ট হয়ো না, কীচককে গোপনে বধ কর।

 সিংহ যেমন মৃগের জন্য প্রতীক্ষায় থাকে সেইরূপ ভীম রাত্রিকালে নৃত্যশালায় গিয়ে কীচকের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সৈরিন্ধ্রীর সঙ্গে মিলনের আশায় কীচক সুসজ্জিত হয়ে সেই অন্ধকারময় বৃহৎ গৃহে এলেন এবং শয্যায় শয়ান ভীমকে স্পর্শ ক’রে আনন্দে অস্থির হয়ে বললেন, তোমার গৃহে আমি বহু ধন, রত্ন, পরিচ্ছদ ও দাসী পাঠিয়ে দিয়েছি; আর দেখ, আমার গৃহের সকল স্ত্রীরাই বলে যে আমার তুল্য সুবেশ ও সুদর্শন পুরুষ আর নেই।

 ভীম বললেন, আমার সৌভাগ্য যে তুমি সুদর্শন এবং নিজেই নিজের প্রশংসা করছ; তোমার তুল্য স্পর্শ আমি পূর্বে কখনও পাই নি। তার পর মহাবাহু ভীম সহসা শয্যা থেকে উঠে সহাস্যে বললেন, পাপিষ্ঠ, সিংহ যেমন হস্তীকে করে সেইরূপ আমি তোমাকে ভূতলে ফেলে আকর্ষণ করব, তোমার ভগিনী তা দেখবেন; তুমি নিহত হ’লে সৈরিন্ধ্রী অবাধে বিচরণ করবেন, তাঁর স্বামীরাও সুখী হবেন। এই ব’লে ভীম কীচকের কেশ ধরলেন, কীচকও ভীমের দুই বাহু ধরলেন। বালী ও সুগ্রীবের ন্যায় তাঁরা বাহুযুদ্ধে রত হলেন।

 প্রচণ্ড বায়ু যেমন বৃক্ষকে ঘূর্ণিত করে সেইরূপ ভীম কীচককে গৃহ মধ্যে সঞ্চালিত করতে লাগলেন। ভীমের হাত থেকে ঈষৎ মুক্ত হয়ে কীচক জানুর আঘাতে ভীমকে ভূতলে ফেললেন। ভীম তখনই উঠে আবার আক্রমণ করলেন। তাঁর প্রহারে কীচক ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লেন, ভীম তখন দুই বাহু দ্বারা কীচককে ধ’রে তাঁর কণ্ঠদেশ নিপীড়িত করতে লাগলেন। কীচকের সর্বাঙ্গ ভগ্ন হ’ল। ভীম তাঁকে ভূতলে ঘূর্ণিত ক’রে বললেন, ভার্যাকে যে পদাঘাত করেছিল সেই শত্রুকে বধ ক’রে আজ আমি ভ্রাতাদের কাছে ঋণমুক্ত হব, সৈরিন্ধ্রীর কণ্টক দূর করব।

 কীচকের প্রাণ বহির্গত হ’ল। পুরাকালে মহাদেব যেমন গজাসুরকে ক’রে ছিলেন, ক্রুদ্ধ ভীমসেন সেইরূপ কীচকের হাত পা মাথা গলা সমস্তই দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট ক’রে দিলেন। তার পর তিনি দ্রৌপদীকে ডেকে সেই মাংসপিণ্ড দেখিয়ে বললেন, পাঞ্চালী, কামুকটাকে কি করেছি দেখ। ভীমের ক্রোধের শান্তি হ’ল, তিনি পাকশালায় চ’লে গেলেন। দ্রৌপদী নৃত্যশালার রক্ষকদের কাছে গিয়ে বললেন, পরস্ত্রীলোভী কীচক আমার গন্ধর্ব পতিদের হাতে নিহত হ’য়ে প’ড়ে আছে, তোমরা এসে দেখ। রক্ষকরা মশাল নিয়ে সেখানে এল এবং কীচকের রুধিরাক্ত দেহ দেখে তার হাত পা মুণ্ড গলা কোথায় গেল অনুসন্ধান করতে লাগল।

৯। উপকীচকবধ ― দ্রৌপদী ও বৃহন্নলা

 কীচকের বান্ধবরা মৃতদেহ বেষ্টন ক’রে কাঁদতে লাগল। স্থলে উদ্ধৃত কচ্ছপের ন্যায় একটা পিণ্ড দেখে তারা ভয়ে রোমাণ্ডিত হ’ল। সূতপুত্রগণ[] যখন অন্ত্যেষ্টির জন্য মৃতদেহ বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা দেখলে অদূরে একটা স্তম্ভ ধ’রে দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে আছেন। উপকীচকরা বললে, ওই অসতীটাকে কীচকের সঙ্গে দগ্ধ কর, ওর জন্যই তিনি হত হয়েছেন। তারা বিরাটের কাছে গিয়ে অনুমতি চাইলে তিনি সম্মত হলেন, কারণ কীচকের বান্ধবরাও পরাক্রান্ত।

 উপকীচকগণ দ্রৌপদীকে বেঁধে শ্মশানে নিয়ে চলল। তিনি উচ্চস্বরে বললেন, জয় জয়ন্ত বিজয় জয়সেন জয়দ্‌বল শোন, মহাবীর গন্ধর্বগণ শোন—সূতপুত্রগণ আমাকে দাহ করতে নিয়ে যাচ্ছে। ভীম সেই আহ্বান শুনে তখনই শয্যা থেকে উঠে বললেন, সৈরিন্ধ্রী, ভয় নেই। তিনি বেশ পরিবর্তন ক’রে অদ্বার দিয়ে নির্গত হ’য়ে প্রাচীর লঙ্ঘন ক’রে সূতগণের সম্মুখীন হলেন। চিতার নিকটে একটি শুষ্ক বৃহৎ বৃক্ষ দেখে তিনি উৎপাটিত ক’রে স্কন্ধে নিলেন এবং দণ্ডপাণি কৃতান্তের ন্যায় ধাবিত হলেন। তাঁকে দেখে উপকীচকরা ভয় পেয়ে বললে, ক্রুদ্ধ গন্ধর্ব বৃক্ষ নিয়ে আসছে, সৈরিন্ধ্রীকে শীঘ্র মুক্তি দাও। তারা দ্রৌপদীকে ছেড়ে দিয়ে রাজধানীর দিকে পালাতে গেল, সেই এক শ পাঁচজন উপকীচককে ভীম যমালয়ে পাঠালেন। তার পর তিনি দ্রৌপদীকে বললেন, কৃষ্ণা, আর ভয় নেই, তুমি রাজভবনে ফিরে যাও, আমিও অন্য পথে পাকশালায় যাচ্ছি।

 প্রাতঃকালে মৎস্যদেশের নরনারীগণ সেনাপতি কীচক ও তাঁর এক শ পাঁচজন বান্ধব নিহত হয়েছে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হ’ল। তারা রাজার কাছে গিয়ে সেই সংবাদ দিয়ে বললে, সৈরিন্ধ্রী আবার আপনার ভবনে এসেছে; সে রূপবতী সেজন্য পুরুষরা তাকে কামনা করবে, গন্ধর্বরাও মহাবল। মহারাজ, সৈরিন্ধ্রীর দোষে যাতে আপনার রাজধানী বিনষ্ট না হয় তার ব্যবস্থা করুন।

 কীচক ও উপকীচকগণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য আদেশ দিয়ে বিরাট সুদেষ্ণাকে বললেন, তুমি সৈরিন্ধ্রীকে এই কথা বল—সুন্দরী, তুমি এখান থেকে যেখানে ইচ্ছা হয় চ’লে যাও; রাজা গন্ধর্বদের ভয় করেন, তিনি নিজে এ কথা তোমাকে বলতে পারেন না, সেজন্য আমি বলছি।

 মুক্তিলাভের পর দ্রৌপদী তাঁর গাত্র ও বস্ত্র ধৌত ক’রে রাজধানীর দিকে চললেন, তাঁকে দেখে লোকে গন্ধর্বের ভয়ে ত্রস্ত হয়ে পালাতে লাগল। পাকশালার নিকটে এসে ভীমসেনকে দেখে দ্রৌপদী সহাস্যে বললেন, গন্ধর্বরাজকে নমস্কার, যিনি আমাকে মুক্ত করেছেন। ভীম উত্তর দিলেন, এই নগরে যে পুরুষরা আছেন তাঁরা এখন তোমার কথা শুনে ঋণমুক্ত হলেন।

 তার পর দ্রৌপদী দেখলেন, নৃত্যশালায় অর্জুন কন্যাদের নৃত্য শেখাচ্ছেন। কন্যারা বললে, সৈরিন্ধ্রী, ভাগ্যক্রমে তুমি মুক্তিলাভ করেছ এবং তোমার অনিষ্টকারী কীচকগণ নিহত হয়েছে। অর্জুন বললেন, তুমি কি ক’রে মুক্ত হ’লে, সেই পাপীরাই বা কি ক’রে নিহত হ’ল তা সবিস্তারে শুনতে ইচ্ছা করি। দ্রৌপদী বললেন, বৃহন্নলা সৈরিন্ধ্রীর কথায় তোমার কি প্রয়োজন? তুমি তো কন্যাদের মধ্যে সুখে আছ, আমার ন্যায় দুঃখভোগ কর না। অর্জুন বললেন, কল্যাণী, বৃহন্নলাও মহাদুঃখ ভোগ করছে, সে এখন পশুতুল্য হয়ে গেছে তা তুমি বুঝছ না। আমরা এক স্থানেই বাস করি, তুমি কষ্ট পেলে কে না দুঃখিত হয়?

 দ্রৌপদী কন্যাদের সঙ্গে সুদেষ্ণার কাছে গেলেন। রাজার আদেশ অনুসারে সুদেষ্ণা বললেন, সৈরিন্ধ্রী, তুমি শীঘ্র যেখানে ইচ্ছা হয় চ’লে যাও। তুমি যুবতী ও রূপে অনুপমা, রাজাও গন্ধর্বদের ভয় করেন। দ্রৌপদী বললেন, তার তের দিনের জন্য আমাকে ক্ষমা করুন, তার পর আমার গন্ধর্ব পতিগণ তাঁদের কর্ম সমাপ্ত ক’রে আমাকে নিয়ে যাবেন, আপনাদেরও সকলের মঙ্গল করবেন।

  1. এরা কীচকের ভ্রাতৃসম্পর্কীয় বা উপকীচক।