মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বিরাটপর্ব/সময়পালনপর্বাধ্যায়
॥ সময়পালনপর্বাধ্যায়॥
৪। মল্লগণের সহিত ভীমের যুদ্ধ
যুধিষ্ঠির বিরাট রাজা, তাঁর পুত্র এবং সভাসদ্বর্গ সকলেরই প্রিয় হলেন। তিনি অক্ষয়হৃদয়[১] জানতেন, সেজন্য দ্যূতক্রীড়ায় সকলকেই সূত্রবদ্ধ পক্ষীর ন্যায় ইচ্ছানুসারে চালিত করতেন। যুধিষ্ঠির যে ধন জয় করতেন তা বিরাটের অজ্ঞাতসারে ভ্রাতাদের দিতেন। ভীম যে মাংস প্রভৃতি বিবিধ খাদ্য রাজার নিকট লাভ করতেন তা যুধিষ্ঠিরাদিকে বিক্রয়[২] করতেন। অন্তঃপুরে অর্জুন যে সব জীর্ণ বস্ত্র পেতেন তা বিক্রয়চ্ছলে অন্য ভ্রাতাদের দিতেন। নকুল-সহদেব ধন ও দধিদুগ্ধাদি দিতেন। অন্যের অজ্ঞাতসারে দ্রৌপদীও তাঁর পতিদের দেখতেন।
এইরূপে চার মাস গত হ’লে মৎস্যরাজধানীতে ব্রহ্মার উদ্দেশে মহাসমারোহে এক জনপ্রিয় উৎসবের আয়োজন হ’ল। এই মহোৎসবে নানা দিক থেকে অসুরতুল্য বলবান বহুবিজয়ী মল্লগণ বিরাট রাজার রঙ্গস্থলে উপস্থিত হ’ল। তাদের মধ্যে জীমূত নামে এক মহামল্ল ছিল, সে অন্যান্য মল্লদের যুদ্ধে আহ্বান করলে, কিন্তু কেউ তার কাছে গেল না। তখন বিরাট ভীমকে যুদ্ধ করতে আদেশ দিলেন। রাজাকে অভিবাদন ক’রে ভীম অনিচ্ছায় রঙ্গে প্রবেশ করলেন এবং কটিদেশ বন্ধন ক’রে জীমূতকে আহ্বান করলেন। মদমত্ত মহাকায় হস্তীর ন্যায় দুজনের ঘোর বাহুযুদ্ধ হ’তে লাগল, তাঁরা হস্ত মুষ্টি করতল নখ জানু পদ ও মস্তক দিয়ে পরস্পরকে সগর্জনে আঘাত করতে লাগলেন। অবশেষে ভীম জীমূতকে তুলে ধ’রে শতবার ঘুরিয়ে ভূমিতে ফেললেন এবং পেষণ ক’রে বধ করলেন। কুবেরতুল্য ধনী বিরাট হৃষ্ট হয়ে তখনই ভীমকে প্রচুর অর্থ পুরস্কার দিলেন। তার পর ভীম আরও অনেক মল্লকে বিনষ্ট করলেন এবং অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বিরাটের আজ্ঞায় সিংহ ব্যাঘ্র ও হস্তীর সঙ্গে যুদ্ধ করলেন।
অর্জুন নৃত্যগীত ক’রে রাজা ও অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের মনোরঞ্জন করতে লাগলেন। নকুল অশ্বদের শিক্ষিত করে রাজাকে তুষ্ট করলেন। সহদেবও বৃষদের বিনীত ক’রে রাজার নিকট অনেক পুরস্কার পেলেন। দ্রৌপদী সুখী হলেন না, মহাবল পাণ্ডবদের কষ্টসাধ্য কর্ম দেখে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।