মহাভারত (রাজশেখর বসু)/শান্তিপর্ব/রাজধর্মানুশাসনপর্বাধ্যায়
শান্তিপর্ব
॥ রাজধর্মানুশাসনপর্বাধ্যায়॥
১। যুধিষ্ঠির-সকাশে নারদাদি
মৃতজনের তর্পণের পর পাণ্ডবগণ অশৌচমোচনের জন্য গঙ্গাতীরে এক মাস বাস করলেন। সেই সময়ে ব্যাস নারদ দেবল প্রভৃতি মহর্ষিগণ এবং বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, স্নাতক ও গৃহস্থগণ তাঁদের সঙ্গে দেখা ক’রে কুশলজিজ্ঞাসা করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি ব্রাহ্মণদের অনুগ্রহে এবং কৃষ্ণ ও ভীমার্জুনের শৌর্যে পৃথিবী জয় করেছি, কিন্তু জ্ঞাতিক্ষয় এবং পুত্রদের নিধনের পর আমার এই জয়লাভ পরাজয়ের তুল্য মনে হচ্ছে। আমরা জানতাম না যে কর্ণ আমাদের ভ্রাতা, কিন্তু কর্ণ তা জানতেন, কারণ আমাদের মাতা তাঁকে বলেছিলেন। তথাপি তিনি কৃতজ্ঞতা ও প্রতিশ্রুতিরক্ষার জন্য দুর্যোধনকে ত্যাগ করেন নি। আমাদের সেই সহোদর ভ্রাতা অর্জুন কর্তৃক নিহত হয়েছেন। দুর্যোধনের হিতৈষী কর্ণ যখন দ্যূতসভায় আমাদের কটুবাক্য বলেছিলেন তখন তাঁর চরণের সঙ্গে আমাদের জননীর চরণের সাদৃশ্য দেখে আমার ক্রোধ দূর হয়েছিল, কিন্তু সাদৃশ্যের কারণ তখন বুঝতে পারি নি।
দেবর্ষি নারদ কর্ণের জন্ম ও অস্ত্রশিক্ষার ইতিহাস বিকৃত করে বললেন, কর্ণের বাহুবলের সাহায্যেই দুর্যোধন কলিঙ্গরাজ চিত্রাঙ্গদের কন্যাকে স্বয়ংবরসভা থেকে হরণ করেছিলেন। তার পব কর্ণ মগধরাজ জরাসন্ধকে দ্বৈরথযুদ্ধে পরাজিত করলে জরাসন্ধ প্রীত হয়ে তাঁকে অঙ্গদেশের মালিনী নগরী দান করেন। দুর্যোধনের কাছ থেকে তিনি চম্পা নগরী পালনের ভার পেয়েছিলেন। পরশুরাম ও একজন ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, ইন্দ্র তাঁর কবচকুণ্ডল হরণ করেছিলেন, ভীষ্ম অপমানিত হয়ে তাঁকে অর্ধরথ বলেছিলেন, শল্য তাঁর তেজোহানি করেছিলেন। এইসকল কারণে এবং বাসুদেবের কূটনীতির ফলে কর্ণ যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তাঁর জন্য শোক করা অনুচিত।
কুন্তী কাতর হয়ে বললেন, যুধিষ্ঠির, আমি কর্ণের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, তাঁর জনক দিবাকরও স্বপ্নযোগে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তথাপি আমরা তোমার সঙ্গে কর্ণের মিলন ঘটাতে পারি নি। যুধিষ্ঠির বললেন, কর্ণের পরিচয় গোপন ক’রে আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। মহাতেজা যুধিষ্ঠির দুঃখিতমনে অভিশাপ দিলেন — স্ত্রীজাতি কিছুই গোপন করতে পারবে না।
২। যুধিষ্ঠিরের মনস্তাপ
শোকসন্তপ্ত যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, ক্ষত্রিয়াচার পৌরুষ ও ক্রোধকে ধিক, যার ফলে আমাদের এই বিপদ হয়েছে। আমাদের জয় হয় নি, দুর্যোধনেরও জয় হয় নি; তাঁকে বধ ক’রে আমাদের ক্রোধ দূর হয়েছে, কিন্তু আমি শোকে বিদীর্ণ হচ্ছি। ধনঞ্জয়, আমার রাজ্যে প্রয়োজন নেই, তুমিই রাজ্যশাসন কর; আমি নির্দ্বন্দ্ব নির্মম হয়ে তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য বনে যাব, চীর ও জটা ধারণ ক’রে তপস্যা করব, ভিক্ষান্নে জীবিকানির্বাহ করব। বহু কাল পরে আমার প্রজ্ঞার উদয় হয়েছে, এখন আমি অব্যয় শাশ্বত স্থান লাভ করতে ইচ্ছা করি।
অর্জুন অসহিষ্ণু হয়ে ঈষৎ হাস্য ক’রে বললেন, আপনি অমানুষিক কর্ম সম্পন্ন ক’রে এখন শ্রেষ্ঠ সম্পদ ত্যাগ করতে চান! যে ক্লীব বা দীর্ঘসূত্রী তার রাজ্যভোগ কি ক’রে হবে? আপনি রাজকুলে জন্মেছেন, সমগ্র বসুন্ধরা জয় করেছেন, এখন মূঢ়তার বশে ধর্ম ও অর্থ ত্যাগ ক’রে বনে যেতে চাচ্ছেন! মহারাজ, অর্থ থেকেই ধর্ম কাম ও স্বর্গ হয়, অর্থ না থাকলে লোকের প্রাণযাত্রাও অসম্ভব হয়। দেবগণও তাঁদের জ্ঞাতি অসুরগণকে বধ ক’রে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন। রাজা যদি অন্যের ধন হরণ না করেন তবে কি ক’রে ধর্মকার্য করবেন? এখন সর্বদক্ষিণাযুক্ত যজ্ঞ করাই আপনার কর্তব্য, নতুবা আপনার পাপ হবে। মহারাজ, আপনি কুপথে যাবেন না।
ভীম বললেন, মহারাজ, আপনি মন্দবুদ্ধি বেদপাঠক ব্রাহ্মণের ন্যায় কথা বলছেন। আপনি আলস্যে দিনযাপন করতে চান তাই রাজধর্মকে অবজ্ঞা করছেন। আপনার এমন বুদ্ধি হবে জানলে আমরা যুদ্ধ করতাম না। আমাদেরই দোষ, বলশালী কৃতবিদ্য ও মনস্বী হয়েও আমরা একজন ক্লীবের বশে চলেছি। বনে গিয়ে মৌনব্রত ও কপট ধর্ম অবলম্বন করলে আপনার মৃত্যুই হবে, জীবিকানির্বাহ হবে না।
নকুল-সহদেবও যুধিষ্ঠিরকে নানাপ্রকারে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তার পর দ্রৌপদী বললেন, মহারাজ, তোমার ভ্রাতারা চাতক পক্ষীর ন্যায় শুষ্ককণ্ঠে অনেক কথা বললেন, কিন্তু তুমি উত্তর দিয়ে এঁদের আনন্দিত করছ না। এঁরা দেবতুল্য, এঁদের প্রত্যেকেই আমাকে সুখী করতে পারেন। পঞ্চেন্দ্রিয় যেমন মিলিত হয়ে শরীরের ক্রিয়া সম্পাদন করে সেইরূপ আমার পঞ্চ পতি কি আমাকে সুখী করতে পারেন না? ধর্মরাজ, তুমি উন্মত্ত হয়েছ, তোমার ভ্রাতারাও যদি উন্মত্ত না হতেন তবে তোমাকে বেঁধে রেখে রাজ্যশাসন করতেন। নৃপশ্রেষ্ঠ, ব্যাকুল হয়ো না, পৃথিবী শাসন কর, ধর্মানুসারে প্রজাপালন কর।
অর্জুন পুনর্বার বললেন, মহারাজ, রাজদণ্ডই প্রজা শাসন করে, ধর্ম অর্থ কাম এই ত্রিবর্গকে দণ্ডই রক্ষা করে। রাজার শাসন না থাকলে লোক বিনষ্ট হয়। ধর্মত বা অধর্মত যে উপায়েই হ’ক আপনি এই রাজ্য লাভ করেছেন, এখন শোক ত্যাগ ক’রে ভোগ করুন, যজ্ঞ ও দান করুন, প্রজাপালন ও শত্রুনাশ করুন।
ভীম বললেন, আপনি সর্বশাস্ত্রজ্ঞ নরপতি, কাপপুরুষের ন্যায় মোহগ্রস্ত হচ্ছেন কেন? আপনি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে জয়ী হয়েছেন, এখন নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করুন। পিতৃপিতামহের অনুসরণ ক’রে রাজ্যশাসন ও অশ্বমেধ যজ্ঞ করুন, আমরা এবং বাসুদেব আপনার কিংকর রয়েছি।
যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, অজ্ঞ লোকে নিজের উদরের জন্যই প্রাণিহিংসা করে, অতএব সেই উদরকে জয় কর, অল্পাহারে উদরাগ্নি প্রশমিত কর। রাজারা কিছুতেই সন্তুষ্ট হন না, কিন্তু সন্ন্যাসী অল্পে তুষ্ট হন। অর্জুন, দুইপ্রকার বেদবচন আছে — কর্ম কর, কর্ম ত্যাগ কর। তুমি যুদ্ধশাস্ত্রই জান, ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্বে প্রবেশ করতে পারবে না। মোক্ষার্থিগণ সন্ন্যাস দ্বারাই পরমগতি লাভ করেন।
মহাতপা মহর্ষি দেবস্থান ও ব্যাসদেব বহু উপদেশ দিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মন শান্ত হ’ল না। তিনি বললেন, বাল্যকালে যাঁর ক্রোড়ে আমি খেলা করেছি সেই ভীষ্ম আমার জন্য নিপাতিত হয়েছেন, আমার মিথ্যা কথার ফলে আচার্য দ্রোণ বিনষ্ট হয়েছেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্ণকেও আমি নিহত করিয়েছি, আমার রাজ্যলোভের জন্যই বালক অভিমন্যু প্রাণ দিয়েছে, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র বিনষ্ট হয়েছে। আমি পৃথিবীনাশক পাপী, আমি ভোজন করব না, পান করব না, প্রায়োপবেশনে শরীর শুষ্ক করব। তপোধনগণ, আপনারা অনুমতি দিন, আমি এই কলেবর ত্যাগ করব।
অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, মাধব, ধর্মপুত্র শোকার্ণবে মগ্ন হয়েছেন, তুমি এঁকে আশ্বাস দাও। যুধিষ্ঠিরের চন্দনচর্চিত পাষাণতুল্য বাহু ধারণ ক’রে কৃষ্ণ বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, শোক সংবরণ করুন, যাঁরা যুদ্ধে মরেছেন তাঁদের আর ফিরে পাবেন না। সেই বীরগণ অস্ত্রপ্রহারে পূত হয়ে স্বর্গে গেছেন, তাঁদের জন্য শোক করা উচিত নয়। ব্যাসদেব বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুসারেই ক্ষত্রিয়দের বিনষ্ট করেছ। যে লোক জেনে শুনে পাপকর্ম করে এবং তার পর নিলর্জ্জ থাকে তাকেই পূর্ণ পাপী বলা হয়; এমন পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। কিন্তু তুমি শুদ্ধস্বভাব, যা করেছ তা দুর্যোধনাদির দোষে অনিচ্ছায় করেছ এবং অনুতপ্তও হয়েছ। এরূপ পাপের প্রায়শ্চিত্ত মহাযজ্ঞ অশ্বমেধ; তুমি সেই যজ্ঞ করে পাপমুক্ত হও।
তার পর ব্যাসদেব নানাপ্রকার পাপকর্ম এবং সে সকলের উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত বিবৃত করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, আমি রাজধর্ম, চতুর্বর্ণের ধর্ম, আপৎকালোচিত ধর্ম প্রভৃতি সবিস্তারে শুনতে ইচ্ছা করি। ব্যাস বললেন, তুমি যদি সর্বপ্রকার ধর্ম জানতে চাও তবে কুরুপিতামহ ভীষ্মের কাছে যাও, তিনি তোমার সমস্ত সংশয় ছেদন করবেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি জ্ঞাতিসংহার করেছি, ছল ক’রে ভীষ্মকে নিপাতিত করেছি, এখন কোন্ মুখে তাঁর কাছে গিয়ে ধর্মজিজ্ঞাসা করব?
কৃষ্ণ বললেন, নৃপশ্রেষ্ঠ, ভগবান ব্যাস যা বললেন তাই আপনি করুন। গ্রীষ্মকালের অন্তে লোকে যেমন মেঘের উপাসনা করে সেইরূপ আপনার প্রজারা, হতাবশিষ্ট রাজারা এবং কুরুজাঙ্গলবাসী ব্রাহ্মণাদি চতুবর্ণের প্রজারা প্রার্থী রূপে আপনার কাছে সমবেত হয়েছেন। আপনি আমাদের সকলের প্রীতির নিমিত্ত লোকহিতে নিযুক্ত হ’ন।
কৃষ্ণ, ব্যাস, দেবস্থান, ভ্রাতৃগণ, এবং অন্যান্য বহু লোকের অনুনয় শুনে মহাযশা যুধিষ্ঠিরের মনস্তাপ দূর হ’ল, তিনি শান্তিলাভ ক’রে নিজের কর্তব্যে অবহিত হলেন। তার পর ধৃতরাষ্ট্রকে পুরোবর্তী ক’রে এবং সুহৃদ্গণে পরিবেষ্টিত হয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সমারোহ সহকারে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করলেন।
৩। চার্বাকবধ—যুধিষ্ঠিরের অভিষেক
রাজভবনে প্রবেশ করে যুধিষ্ঠির দেবতা ও সমবেত ব্রাহ্মণগণের যথাবিধি অর্চনা করলেন। দুর্যোধনের সখা চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুর ছদ্মবেশে শিখা দণ্ড ও জপমালা ধারণ ক’রে সেখানে উপস্থিত ছিল। ব্রাহ্মণদের অনুমতি না নিয়েই সে যুধিষ্ঠিরকে বললে, কুন্তীপত্র, এই দ্বিজগণ আমার মুখে তোমাকে বলছেন — তুমি জ্ঞাতিহতা কুনৃপতি, তোমাকে ধিক। জ্ঞাতি ও গুরুজনদের হত্যা ক’রে তোমার রাজ্যে কি প্রয়োজন? মৃত্যুই তোমার পক্ষে শ্রেয়। যুধিষ্ঠির ব্যাকুল হয়ে বললেন, বিপ্রগণ, আমি প্রণত হয়ে বলছি, আপনারা প্রসন্ন হ’ন; আমার মরণ আসন্ন, আপনারা ধিক্কার দেবেন না।
ব্রাহ্মণগণ জ্ঞানচক্ষু দ্বারা চার্বাককে চিনতে পেরে বললেন, ধর্মরাজ, এ দুর্যোধনসখা চার্বাক রাক্ষস। আমরা আপনার নিন্দা করি নি, আপনার ভয় দূর হ’ক। তার পর সেই ব্রহ্মবাদী বিপ্রগণ ক্রোধে অধীর হয়ে হুংকার করলেন, চার্বাক দগ্ধ হয়ে ভূপতিত হ’ল।
কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, পুরাকালে সত্যযুগে এই চার্বাক রাক্ষস বদরিকাশ্রমে তপস্যা ক’রে ব্রহ্মার নিকট অভয়বর লাভ করেছিল। বর পেয়ে পাপী রাক্ষস দেবগণের উপর উৎপীড়ন করতে লাগল। দেবগণ শরণাপন্ন হ’লে ব্রহ্মা বললেন, ভবিষ্যতে এই রাক্ষস দুর্যোধন নামক এক রাজার সখা হবে এবং ব্রাহ্মণগণের অপমান করবে; তখন বিপ্রগণ রুষ্ট হয়ে পাপী চার্বাককে দগ্ধ করবেন। ভরতশ্রেষ্ঠ, সেই পাপী চার্বাকই এখন ব্রহ্মতেজে বিনষ্ট হয়েছে। আপনার জ্ঞাতি ক্ষত্রিয়বীরগণ নিহত হয়ে স্বর্গে গেছেন, আপনি শোক ও গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে এখন কর্তব্য পালন করুন।
তার পর যুধিষ্ঠির হৃষ্টচিত্তে স্বর্ণময় পীঠে পূর্বমুখ হয়ে বসলেন। কৃষ্ণ ও সাত্যকি তাঁর সম্মুখে এবং ভীম ও অর্জুন দুই পার্শ্বে উপবিষ্ট হলেন। নকুল-সহদেবের সহিত কুন্তী এক স্বর্ণভূষিত গজদন্তের আসনে বসলেন। গান্ধারী যুযুৎসু ও সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে আসন গ্রহণ করলেন। প্রজাবর্গ নানাপ্রকার মাঙ্গলিক দ্রব্য নিয়ে ধর্মরাজকে দর্শন করতে এল। কৃষ্ণের অনুমতিক্রমে পুরোহিত ধৌম্য একটি বেদীর উপর ব্যাঘ্রচর্মাবত সর্বতোভদ্র নামক আসনে মহাত্মা যুধিষ্ঠির ও দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণাকে বসিয়ে যথাবিধি হোম করলেন। কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য শঙ্খ থেকে জল ঢেলে যুধিষ্ঠিরকে অভিষিক্ত করলেন, প্রজাবৃন্দসহ ধৃতরাষ্ট্রও জলসেক করলেন। পণব আনক ও দুন্দুভি বাজতে লাগল। যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের প্রচুর দক্ষিণা দিলেন, তাঁরা আনন্দিত হয়ে স্বস্তি ও জয় উচ্চারণ ক’রে রাজার প্রশংসা করতে লাগলেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা ধন্য, কারণ, সত্য বা মিথ্যা যাই হ’ক, ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠগণ পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করছেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আমাদের পিতা এবং পরমদেবতা, আমি এঁর সেবা করব সেজন্য জ্ঞাতিহত্যার পরেও প্রাণধারণ ক’রে আছি। সুহৃদ্গণ, যদি আমার উপর তোমাদের অনুগ্রহ থাকে তবে তোমরা ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি পূর্বের ন্যায় ব্যবহার করবে। ইনি তোমাদের ও আমার অধিপতি, সমস্ত পৃথিবী ও পাণ্ডবগণ এঁরই অধীন। আমার এই কথা তোমরা মনে রেখো।
পুরবাসী ও জনপদবাসীদের বিদায় দিয়ে যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তিনি বিদুরকে মন্ত্রণা ও সন্ধিবিগ্রহাদির ভার, সঞ্জয়কে কর্তব্যঅকর্তব্য ও আয়ব্যয় নিরূপণের ভার, নকুলকে সৈন্যগণের তত্ত্বাবধানের ভার, অর্জুনকে শত্রুরাজ্যের অবরোধ ও দুষ্টদমনের ভার এবং পুরোহিত ধৌম্যকে দেবতাব্রাহ্মণাদির সেবার ভার দিলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে সহদেব সর্বদা নিকটে থেকে তাঁকে রক্ষা করতে লাগলেন। অন্যান্য কর্মে উপযুক্ত লোক নিযুক্ত ক’রে ধর্মরাজ বিদুর সঞ্জয় ও যুযুৎসুকে বললেন, আমার পিতা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সকল কার্যে আপনারা অবহিত থাকবেন এবং পুরবাসী ও জনপদবাসীর কার্যও তাঁর অনুমতি নিয়ে করবেন।
যুধিষ্ঠির নিহত যোদ্ধাদের ঔর্ধ্বদৌহিক সকল কর্ম সম্পাদন ক’রে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী প্রভৃতি এবং পতিপুত্রহীনা নারীগণকে সসম্মানে পালন করতে লাগলেন। তিনি দরিদ্র অন্ধ প্রভৃতির ভরণপোষণের যথোচিত ব্যবস্থা করলেন এবং শত্রু জয়ের পর অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সুখে কালযাপন করতে লাগলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে যুধিষ্ঠির ভীমকে দুর্যোধনের ভবন, অর্জুনকে দুঃশাসনের ভবন, নকুলকে দুর্মর্ষণের ভবন এবং সহদেবকে দুর্মুখের ভবন দান করলেন। তিনি পুরোহিত ধৌম্য ও সহস্র স্নাতক ব্রাহ্মণকে বহু ধন দিলেন, ভৃত্য আশ্রিত অতিথি প্রভৃতিকে অভীষ্ট বস্তু দিয়ে তুষ্ট করলেন, কৃপাচার্যের জন্য গরুর উপযুক্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন, এবং বিদুর ও যুযুৎসুকেও সম্মানিত করলেন।
৪। ভীষ্ম-সকাশে কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদি
একদিন যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের গৃহে গিয়ে দেখলেন, তিনি পীত কৌষেয় বস্ত্র প’রে দিব্যাভরণে ভূষিত হয়ে বক্ষে কৌস্তুভ মণি ধারণ ক’রে একটি বৃহৎ পর্যঙ্কে আসীন রয়েছেন। ধর্মরাজ কৃতাঞ্জলি হয়ে সম্ভাষণ করলেন, কিন্তু কৃষ্ণ উত্তর দিলেন না, ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, কি আশ্চর্য, অমিতবিক্রম মাধব, তুমি ধ্যান করছ! ত্রিলোকের মঙ্গল তো? ভগবান, তুমি নিবাতনিষ্কম্প দীপ এবং পাষাণের ন্যায় নিশ্চল হয়ে আছ। যদি গোপনীয় না হয় এবং আমি যদি শোনবার যোগ্য হই তবে তোমার এই ধ্যানের কারণ আমাকে বল।
ঈষৎ হাস্য ক’রে কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, শরশয্যাশায়ী ভীষ্ম আমাকে ধ্যান করছেন সেজন্য আমার মন তাঁর দিকে গিয়েছিল। এই পুরুষশ্রেষ্ট স্বর্গে গেলে পৃথিবী চন্দ্রহীন রাত্রির তুল্য হবে। আপনি তাঁর কাছে গিয়ে আপনার যা জানবার আছে জিজ্ঞাসা করুন। যুধিষ্ঠির বললেন, মাধব, তোমাকে অগ্রবর্তী ক’রে আমরা ভীষ্মের কাছে যাব। কৃষ্ণ সাত্যকিকে আদেশ দিলেন, আমার রথ সজ্জিত করতে বল।
এই সময়ে দক্ষিণায়ন শেষ হয়ে উত্তরায়ণ আরম্ভ হয়েছিল। ভীষ্ম একাগ্রচিত্তে তাঁর আত্মাকে পরমাত্মায় সমাবিষ্ট ক’রে কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন। ব্যাস নারদ অসিত বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র বৃহস্পতি শুক্র কপিল বাল্মীকি ভার্গব কশ্যপ প্রভৃতি ভীষ্মকে বেষ্টন ক’রে রইলেন।
কৃষ্ণ, সাত্যকি, যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতারা, কৃপাচার্য, যুযুৎসু এবং সঞ্জয় রথারোহণে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। তাঁরা দেখলেন, ওঘবতী নদীর তীরে পবিত্র স্থানে ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে আছেন, মুনিগণ তাঁর উপাসনা করছেন। ব্যাসাদি মহর্ষিগণকে অভিবাদন ক’রে কৃষ্ণ কিঞ্চিৎ কাতর হয়ে ভীষ্মকে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে প্রশ্ন করলেন। তার পর কৃষ্ণ বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি যখন সুস্থদেহে সমৃদ্ধ রাজ্যে বাস করতেন তখন সহস্র নারীতে পরিবৃত হ’লেও আপনাকে ঊর্দ্ধরেতা দেখেছি। আপনি ভিন্ন অপর কেউ মৃত্যুকে রোধ ক’রে শরশয্যায় শুয়ে থাকতে পারে এমন আমরা শুনি নি। সর্বপ্রকার ধর্মের তত্ত্ব আপনার জানা আছে; এই জ্যেষ্ঠপাণ্ডব জ্ঞাতিবধের জন্য সন্তপ্ত হয়েছেন, এঁর শোক আপনি দূর করুন। কুরুপ্রবীর, আপনার জীবনের আর ছাপান্ন[১] দিন অবশিষ্ট আছে, তার পরেই আপনি দেহত্যাগ করবেন। আপনি পরলোকে গেলে সমস্ত জ্ঞানই লুপ্ত হবে এই কারণে যুধিষ্ঠিরাদি আপনার কাছে ধর্মজিজ্ঞাসা করতে এসেছেন।
ভীষ্ম কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, নারায়ণ, তোমার কথা শুনে আমি হর্ষে আপ্লুত হয়েছি। বাক্পতি, তোমার কাছে আমি কি বলব? সমস্ত বক্তব্যই তোমার বাক্যে নিহিত আছে। দুর্বলতার ফলে আমার বাক্শক্তি ক্ষীণ হয়েছে, দিক আকাশ ও পৃথিবীর বোধও লোপ পেয়েছে, কেবল তোমার প্রভাবেই জীবিত রয়েছি। কৃষ্ণ, তুমি শাশ্বত জগৎকর্তা, গুরু উপস্থিত থাকতে শিষ্যতুল্য আমি কি ক’রে উপদেশ দেব?
কৃষ্ণ বললেন, গঙ্গানন্দন ভীষ্ম, আমার বরে আপনার গ্লানি মোহ কষ্ট ক্ষুৎপিপাসা কিছুই থাকবে না, সমস্ত জ্ঞান আপনার নিকট প্রকাশিত হবে, ধর্ম ও অর্থের তত্ত্ব সম্বন্ধে আপনার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হবে, আপনি জ্ঞানচক্ষু দ্বারা সর্ব জীবই দেখতে পাবেন। কৃষ্ণ এই কথা বললে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হ’ল, বিবিধ বাদ্য বেজে উঠল, অপ্সরারা গান করতে লাগল, সুখস্পর্শ সুগন্ধ বায়ু, প্রবাহিত হ’ল। এই সময়ে পশ্চিম দিকের এক প্রান্তে অস্তগামী দিবাকর যেন বন দগ্ধ করতে লাগলেন। সন্ধ্যা সমাগত দেখে মহর্ষিগণ গাত্রোত্থান করলেন, কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরাদিও ভীষ্মের নিকট বিদায় নিয়ে প্রস্থান করলেন।
৫। রাজধর্ম
পরদিন কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরাদি ও সাত্যকি পুনর্বার ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন। নারদপ্রমুখ মহর্ষিগণ এবং ধৃতরাষ্ট্রও সেখানে এলেন। কৃষ্ণ কুশলপ্রশ্ন করলে ভীষ্ম বললেন, জনার্দন, তোমার প্রসাদে আমার সন্তাপ মোহ ক্লান্তি গ্লানি সবই দূর হয়েছে, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সমস্তই আমি করতলস্থ ফলের ন্যায় প্রত্যক্ষ দেখছি, সর্বপ্রকার ধর্ম আমার মনে পড়ছে, শ্রেয়স্কর বিষয় বলবার শক্তিও আমি পেয়েছি। এখন ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আমাকে ধর্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করুন।
কৃষ্ণ বললেন, পূজনীয় গুরুজন ও আত্মীয়-বান্ধব বিনষ্ট ক’রে ধর্মরাজ লজ্জিত হয়েছেন, অভিশাপের ভয়ে ইনি আপনার সম্মুখে আসতে পারছেন না। ভীষ্ম বললেন, পিতা পিতামহ ভ্রাতা গুরু আত্মীয় এবং বান্ধবগণ যদি অন্যায়যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন তবে তাঁদের বধ করলে ধর্মই হয়। তখন যুধিষ্ঠির সম্মুখে গিয়ে ভীষ্মের চরণ ধারণ করলেন। ভীষ্ম আশীর্বাদ ক’রে বললেন, বৎস, উপবিষ্ট হও, তুমি নির্ভয়ে আমাকে প্রশ্ন কর। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, ধর্মজ্ঞরা বলেন যে নৃপতির পক্ষে রাজধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম; এই ধর্ম জীবলোকের অবলম্বন। রশ্মি যেমন অশ্বকে, অঙ্কুশ যেমন হস্তীকে, সেইরূপ রাজধর্ম সকল লোককে নিয়ন্ত্রিত করে। অতএব আপনি এই ধর্ম সম্বন্ধে বলুন।
ভীষ্ম বললেন, মহান ধর্ম, বিধাতা কৃষ্ণ ও ব্রাহ্মণগণকে নমস্কার ক’রে আমি শাশ্বত ধর্ম বিবৃত করছি। কুরুশ্রেষ্ঠ, দেবতা ও দ্বিজগণের প্রীতিসম্পাদনের জন্য রাজা শাস্ত্রবিধি অনুসারে সকল কর্ম করবেন। বৎস যুধিষ্ঠির, তুমি সর্বদা উদ্যোগী হয়ে কর্ম করবে, পুরুষকার ভিন্ন কেবল দৈবে রাজকার্য সিদ্ধ হয় না। তুমি সকল কার্যই সরলভাবে করবে, কিন্তু নিজের ছিদ্রগোপন, পরের ছিদ্রান্বেষণ, এবং মন্ত্রণাগোপন বিষয়ে সরল হবে না। ব্রাহ্মণকে শারীরিক দণ্ড দেবে না, গুরুতর অপরাধ করলে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করবে। শাস্ত্রে ছয় প্রকার দুর্গ উক্ত হয়েছে, তার মধ্যে নরদুর্গই সর্বাপেক্ষা দুর্ভেদ্য; অতএব প্রজাগণের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে যাতে তারা অনুরক্ত থাকে। রাজা সর্বদা মৃদু হবেন না, সর্বদা কঠোরও হবেন না, বসন্তকালীন সূর্যের ন্যায় নাতিশীতোষ্ণ হবেন। গর্ভিণী যেমন নিজের প্রিয় বিষয় ত্যাগ ক’রে গর্ভেরই হিতসাধন করে, রাজাও সেইরূপ নিজের হিতচিন্তা না ক’রে প্রজারই হিতসাধন করবেন। ভৃত্যের সঙ্গে অধিক পরিহাস করবে না; তাতে তারা প্রভুকে অবজ্ঞা করে, তিরস্কার করে, উৎকোচ নিয়ে এবং বঞ্চনার দ্বারা রাজকার্য নষ্ট করে, প্রতিরূপকের (জাল শাসনপত্রাদির) সাহায্যে রাজ্যকে জীর্ণ করে। তারা বেতনে সন্তুষ্ট থাকে না, রাজার অর্থ হরণ করে, লোককে ব’লে বেড়ায়, ‘আমরাই রাজাকে চালাচ্ছি।’
যুধিষ্ঠির, রাজ্যের সাতটি অঙ্গ আছে—অমাত্য সুহৃৎ কোষ রাষ্ট্র দুর্গ ও সৈন্য। যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, গুরু বা মিত্র হ’লেও তাকে বধ করতে হবে। রাজা কাকেও অত্যন্ত অবিশ্বাস বা অত্যন্ত বিশ্বাস করবেন না। তিনি সাধু লোকের ধন হরণ করবেন না, অসাধুরই ধন নেবেন এবং সাধু লোককে দান করবেন। যাঁর রাজ্যে প্রজাগণ পিতার গৃহে পুত্রের ন্যায় নির্ভয়ে বিচরণ করে সেই রাজাই শ্রেষ্ঠ। শুত্রুাচার্য তাঁর রামচরিত আখ্যানে এই শ্লোকটি বলেছেন —
রাজানং প্রথমং বিন্দেৎ ততো ভার্যাং ততো ধনম্।
রাজন্যসতি লোকস্য কুতো ভার্যা কুতো ধনম্॥
—প্রথমেই কোনও রাজার আশ্রয় নেবে, তার পর ভার্যা আনবে, তার পর ধন আহরণ করবে; রাজা না থাকলে ভার্যা কি ক’রে ধনই বা কি ক’রে থাকবে?
ভীষ্মের উপদেশ শুনে ব্যাসদেব কৃষ্ণ কৃপ সাত্যকি প্রভৃতি আনন্দিত হয়ে সাধু সাধু বললেন। যুধিষ্ঠির সজলনয়নে ভীষ্মের পাদস্পর্শ ক’রে বললেন, পিতামহ, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, কাল আবার আপনার কাছে আসব।
৬। বেণ ও পৃথু রাজার কথা
পরদিন যুধিষ্ঠিরাদি পুনর্বার ভীষ্মের কাছে উপস্থিত হলেন। ব্যাস প্রভৃতি ঋষি ও ভীষ্মকে অভিবাদনের পর যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, পিতামহ, ‘রাজা’ শব্দের উৎপত্তি কি ক’রে হ’ল তা বলুন। রাজা কি প্রকারে পৃথিবী রক্ষা করেন? লোকে কেন তাঁর অনুগ্রহ চায়?
ভীষ্ম বললেন, নরশ্রেষ্ঠ, সত্যযুগের প্রথমে যেভাবে রাজপদের উৎপত্তি হয় তা বলছি শোন। পুরাকালে রাজা ছিল না, রাজ্য ও দণ্ডও ছিল না, দণ্ডার্হ লোকও ছিল না, প্রজারা ধর্মানুসারে পরস্পরকে রক্ষা করত। ক্রমশ মোহের বশে লোকের ধর্মজ্ঞান নষ্ট হ’ল, বেদও লুপ্ত হ’ল, তখন দেবতারা ব্রহ্মার শরণ নিলেন। ব্রহ্মা এক লক্ষ অধ্যায়যুক্ত একটি নীতিশাস্ত্র রচনা ক’রে তাতে ধর্ম-অর্থ-কাম এই ত্রিবর্গ এবং মোক্ষবিষয়ক চতুর্থ বর্গ বিবৃত করলেন। এই শাস্ত্রে তিন বেদ, আন্বীক্ষিকী (তর্ক বিদ্যা), বার্তা (কৃষিবাণিজ্যাদি বৃত্তি), দণ্ডনীতি, সাম দান দণ্ড ভেদ উপেক্ষা এই পঞ্চ উপায়, সন্ধিবিগ্রহাদি, যুদ্ধ, দুর্গ, বিচারালয়ের কার্য, এবং আরও অনেক বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মানুষ অল্পায়ু, এই বুঝে মহাদেব সেই নীতিশাস্ত্রকে সংক্ষিপ্ত করলেন, তার পর ইন্দ্র বৃহস্পতি ও যোগাচার্য শুত্রু ক্রমশ আরও সংক্ষিপ্ত করলেন।
দেবগণ প্রজাপতি বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন, মানুষের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ হবার যোগ্য তা বলুন। বিষ্ণু বিরজা নামে এক মানসপুত্র সৃষ্টি করলেন। বিরজার অধস্তন পুরুষ যথাক্রমে কীর্তিমান কর্দম অনঙ্গ নীতিমান (বা অতিবল) ও বেণ। বেণ অধার্মিক ও প্রজাপীড়ক ছিলেন, সেজন্য ঋষিগণ মন্ত্রপূত কুশ দিয়ে তাঁকে বধ করলেন। তার পর তাঁরা বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করলেন, তা থেকে এক খর্বদেহ কদাকার দগ্ধকাষ্ঠতুল্য পুরুষ উৎপন্ন হ’ল। ঋষিরা তাকে বললেন, ‘নিষীদ’ — উপবেশন কর। এই পুরুষ থেকে বনপর্বতবাসী নিষাদ ও ম্লেচ্ছ সকল উৎপন্ন হ’ল। তার পর ঋষিরা বেণের দক্ষিণ হস্ত মথন করলেন, তা থেকে ইন্দ্রের ন্যায় রূপবান একটি পুরুষ উৎপন্ন হলেন। ইনি ধনুর্বাণধারী, বেদ-বেদাঙ্গ-ধনুর্বেদে পারদর্শী এবং দণ্ডনীতিজ্ঞ। দেবতা ও মহর্ষিগণ এই বেণপুত্রকে বললেন, তুমি নিজের প্রিয়-অপ্রিয় এবং কাম ক্রোধ লোভ মান ত্যাগ ক’রে সর্বজীবের প্রতি সমদর্শী হবে এবং ধর্মভ্রষ্ট মানুষকে দণ্ড দেবে; তুমি প্রতিজ্ঞা কর যে কায়মনোবাক্যে বেদনির্দিষ্ট ও দণ্ডনীতিসম্মত ধর্ম পালন করবে, দ্বিজগণকে দণ্ড দেবে না এবং বর্ণসংকরদোষ নিবারণ করবে। বেণপুত্র প্রতিজ্ঞা করলে শুত্রুাচার্য তাঁর পুরোহিত হলেন, বালখিল্য প্রভৃতি মুনিরা তাঁর মন্ত্রী হলেন এবং গর্গ তাঁর জ্যোতিষী হলেন।
এই বেণপুত্র পৃথু বিষ্ণু থেকে অষ্টম পুরুষ। পূর্বোৎপন্ন সূত ও মাগধ নামক দুই ব্যক্তি পৃথুর স্তুতিপাঠক হলেন। পৃথু সূতকে অনূপ-দেশ (কোনও জলময় দেশ) এবং মাগধকে মগধ দেশ দান করলেন। ভূপৃষ্ঠ অসমতল ছিল, পৃথু তা সমতল করলেন। বিষ্ণু ইন্দ্রাদি দেবগণ ও ঋষিগণ পৃথুকে পৃথিবীর রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। পৃথুর রাজত্বকালে জরা দুর্ভিক্ষ ব্যাধি তস্কর প্রভৃতির ভয় ছিল না, তিনি পৃথিবী দোহন ক’রে সপ্তদশ প্রকার শস্য ও বিবিধ অভীষ্ট বস্তু উৎপাদন করেছিলেন। ধর্মপরায়ণ পৃথু প্রজারঞ্জন করতেন সেজন্য ‘রাজা’, এবং ব্রাহ্মণগণকে ক্ষত (বিনাশ বা ক্ষতি) থেকে ত্রাণ করতেন সেজন্য ‘ক্ষত্রিয়’ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর সময়ে মেদিনী ধর্মের জন্য প্রথিত (খ্যাত) হয়েছিলেন সেজন্যই ‘পৃথিবী’ নাম। পৃথুর রাজ্যে ধর্ম অর্থ ও শ্রী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
যুধিষ্ঠির, স্বর্গবাসী পুণ্যাত্মার যখন পণ্যফলভোগ সমাপ্ত হয় তখন তিনি দণ্ডনীতিবিশারদ এবং বিষ্ণুর মহত্ত্বযুক্ত হয়ে পৃথিবীতে রাজা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। পণ্ডিতগণ বলেন, নরদেব (রাজা) দেবতারই সমান।
৭। বর্ণাশ্রমধর্ম—চরনিয়োগ—শুল্ক
ভীষ্ম বললেন, ব্রাহ্মণের ধর্ম ইন্দ্রিয়দমন বেদাভ্যাস ও যাজন। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম দান যজন বেদাধ্যয়ন প্রজাপালন ও দুষ্টের দমন; তিনি যাজন ও অধ্যাপন করবেন না। বৈশ্যের ধর্ম দান, বেদাধ্যয়ন, যজ্ঞ, সদুপায়ে ধনসঞ্চয়, এবং পিতার ন্যায় পশুপালন। প্রজাপতি শূদ্রকে অপর তিন বর্ণের দাসরূপে সৃষ্টি করেছেন, তিন বর্ণের সেবা করাই শূদ্রের ধর্ম। শূদ্র ধনসঞ্চয় করবে না, কারণ নীচ লোকে ধন দিয়ে উচ্চশ্রেণীর লোককে বশীভূত করে; কিন্তু ধার্মিক শূদ্র রাজার অনুমতিতে ধনসঞ্চয় করতে পারে। শূদ্রের বেদে অধিকার নেই, ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণের সেবা এবং তাঁদের অনুষ্ঠিত যজ্ঞই শূদ্রের যজ্ঞ।
ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য বানপ্রস্থ ও ভৈক্ষ্য — ব্রাহ্মণের এই চার আশ্রম। মোক্ষকামী ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচর্যের পরেই ভৈক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেন। ক্ষত্রিয়াদি তিন বর্ণ চতুরাশ্রমের সবগুলি গ্রহণ করেন না। যে ব্রাহ্মণ দুশ্চরিত্র ও স্বধর্মভ্রষ্ট তিনি বেদচর্চা করুন বা না করুন, তাঁকে শূদ্রের ন্যায় ভিন্ন পঙ্ক্তিতে খেতে দেবে এবং দেবকার্যে বর্জন করবে। যে শূদ্র তার কর্তব্য কর্ম করেছে এবং সন্তানের জনক হয়েছে, সে যদি তত্ত্বজিজ্ঞাসু ও সদাচারী হয় তবে রাজার অনুমতি নিয়ে ভৈক্ষ্য ভিন্ন অন্য আশ্রমে প্রবেশ করতে পারে।
যুধিষ্ঠির, সমস্ত জন্তুর পদচিহ্ন যেমন হস্তীর পদচিহ্নে লীন হয় সেইরূপ অন্য সমস্ত ধর্ম রাজধর্মে লীন হয়। সকল ধর্মের মধ্যে রাজধর্মই প্রধান, তার দ্বারাই চতুর্বর্ণ পালিত হয়। সর্বপ্রকার ত্যাগই রাজধর্মে আছে এবং ত্যাগই শ্রেষ্ঠ ও প্রাচীন ধর্ম। সর্বপ্রকার ভোগ উপদেশ ও বিদ্যা রাজধর্মে আছে, সকলেই রাজধর্মের আশ্রয়ে থাকে। রাজা যদি দণ্ড না দেন, তবে প্রবল মৎস্য যেমন দুর্বল মৎস্যকে ভক্ষণ করে সেইরূপ প্রবল লোকে দুর্বলের উপর পীড়ন করবে। রাজার ভয়েই প্রজারা পরস্পরকে সংহার করে না।
রাজা প্রথমেই ইন্দ্রিয় জয় ক’রে আত্মজয়ী হবেন, তার পর শত্রুজয় করবেন। যারা জড় অন্ধ বা বধিরের ন্যায় দেখতে, এবং ক্ষুধা পিপাসা ও শ্রম সইতে পারে, এমন বিচক্ষণ লোককে পরীক্ষার পর গুপ্তচর করবেন। অমাত্য মিত্র রাজপুত্র সামন্তরাজগণের নিকটে এবং নগরে ও জনপদে গুপ্তচর রাখবেন। এই চরেরা যেন পরস্পরকে জানতে না পারে, এবং তারা কি করছে তা দেখবার জন্য অপর লোক নিযুক্ত করতে হবে। যাঁরা সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন লোককে রাজা বিচারক নিযুক্ত করবেন। খনি, লবণ-উৎপাদন, পার-ঘাট, ধৃত বন্য হস্তী এবং অন্যান্য বিষয়ের শুল্ক আদায়ের জন্য বিশ্বস্ত লোক রাখবেন। প্রবল শত্রু আক্রমণ করলে রাজা দুর্গমধ্যে আশ্রয় নেবেন এবং সমস্ত শস্য সংগ্রহ করবেন। দুর্গের মধ্যে আনা অসম্ভব হ’লে ক্ষেত্রের শস্য পুড়িয়ে ফেলবেন। নদীর সেতু ভেঙে ফেলবেন, পানীয় জল অপসৃত করবেন অথবা তাতে বিষ দেবেন।
মহর্ষি কশ্যপ পুরূরবাকে বলেছিলেন, পাপী লোকে যখন স্ত্রীহত্যা ও ব্রাহ্মণহত্যা ক’রেও সভায় সাধুবাদ পায়, রাজাকেও উপেক্ষা করে, তখন রাজার ভয় উপস্থিত হয়। লোকে অত্যন্ত পাপ করলে রুদ্রদেব উৎপন্ন হন, তিনি সাধু অসাধু সকলকেই সংহার করেন। এই রুদ্র মানবগণের হৃদয়েই থাকেন এবং ইনিই নিজের ও পরের দেহ বিনষ্ট করেন।
তস্কর যদি প্রজার ধন হরণ করে এবং রাজা তা উদ্ধার করতে না পারেন, তবে সেই অক্ষম রাজা নিজের কোষ থেকেই প্রজার ক্ষতি পূরণ করবেন। ধর্মরাজ, তুমি যদি সর্বদাই মৃদুস্বভাব, অতিসৎ, অতিধার্মিক, ক্লীবতুল্য উদ্যমহীন ও দয়ালু হও তবে লোকে তোমাকে মানবে না।
৮। রাজার মিত্র—দণ্ডবিধি—রাজকর —অর্থনীতি
যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, অন্যের সাহায্য না নিয়ে রাজকার্য সম্পাদন করা অসম্ভব। রাজার সচিব কিপ্রকার হবেন? কিপ্রকার লোককে রাজা বিশ্বাস করবেন?
ভীষ্ম বললেন, রাজার মিত্র চতুর্বিধ।—সমার্থ (যাঁর স্বার্থ রাজার স্বার্থের সমান), ভজমান (অনুগত), সহজ (আত্মীয়) এবং কৃত্রিম (অর্থ দ্বারা বশীভূত)। এ ভিন্ন রাজার পঞ্চম মিত্র—ধর্মাত্মা; তিনি যে পক্ষে ধর্ম দেখেন সেই পক্ষেরই সহায় হন, সংশয়স্থলে নিরপেক্ষ থাকেন। বিজয়লাভের জন্য রাজা ধর্ম ও অধর্ম দুইই অবলম্বন করেন; তাঁর যে সংকল্প ধর্মবিরুদ্ধ তা ধর্মাত্মা মিত্রের নিকট প্রকাশ করবেন না। পূর্বোক্ত চতুর্বিধ মিত্রের মধ্যে ভজমান ও সহজই শ্রেষ্ঠ, অপর দুজন আশঙ্কার পাত্র। একই কার্যের জন্য দু-তিন জনকে মন্ত্রী করা উচিত নয়, তাঁরা পরস্পরকে সইতে পারবেন না।
কোনও রাজকর্মচারী যদি রাজধন চুরি করে, তবে যে লোক তা জানাবে তাকে রাজা রক্ষা করবেন, নতুবা চোর-কর্মচারী তাকে বিনষ্ট করবে। যিনি লজ্জাশীল ইন্দ্রিয়জয়ী সত্যবাদী সরল ও উচিতবক্তা, এমন লোকই সভাসদ হবার যোগ্য। সদ্বংশজাত বুদ্ধিমান রূপবান চতুর ও অনুরক্ত লোককে তোমার পরিজন নিযুক্ত করবে। অপরাধীকে তার অপরাধ অনুসারে দণ্ড দেবে, ধনীর অর্থদণ্ড করবে এবং নির্ধনকে কারাদণ্ড দেবে। দুর্বৃত্তগণকে প্রহার ক’রে দমন করবে এবং সজ্জনকে মিষ্ট বাক্যে এবং উপহার দিয়ে পালন করবে। রাজা সকলেরই বিশ্বাস জন্মাবেন, কিন্তু নিজে কাকেও বিশ্বাস করবেন না, পুত্রকেও নয়।
রাজা ছয় প্রকার দুর্গের আশ্রয়ে নগর স্থাপন করবেন—মরুদুর্গ মহীদুর্গ গিরিদুর্গ মনুষ্যদুর্গ মৃদ্দূর্গ ও বনদুর্গ। প্রত্যেক গ্রামের একজন অধিপতি থাকবেন, তাঁর উপরে দশ গ্রামের এক অধিপতি, তাঁর উপরে বিশ গ্রামের, শত গ্রামের এবং সহস্র গ্রামের এক এক জন অধিপতি থাকবেন। এঁরা সকলেই নিজ নিজ অধিকারে উৎপন্ন খাদ্যের উপযুক্ত অংশ পাবেন। রাজা নানাবিধ কর আদায় করবেন, কিন্তু করভারে প্রজাদের অবসন্ন করবেন না। ইঁদুর যেমন ধারাল দাঁত দিয়ে ঘুমন্ত লোকের পায়ের মাংস কুরে কুরে খায়, পা নাড়লেও ছাড়ে না, রাজা সেইরূপ প্রজার কাছ থেকে ধীরে ধীরে কর আদায় করবেন। যদি শত্রুর আক্রমণের ভয় উপস্থিত হয় তবে রাজা সেই ভয়ের বিষয় প্রজাদের জানিয়ে বলবেন, ‘তোমাদের রক্ষার জন্য আমি ধন প্রার্থনা করছি, ভয় দূর হ’লে এই ধন ফিরিয়ে দেব; শত্রু যদি তোমাদের ধন কেড়ে নেয় তবে তা আর ফিরে পাবে না। তোমরা স্ত্রীপুত্রের জন্যই ধনসঞ্চয় ক’রে থাক, কিন্তু সেই স্ত্রীপুত্রই এখন বিনষ্ট হ’তে বসেছে; আপৎকালে ধনের মায়া করা উচিত নয়।’
ক্ষত্রিয় রাজা বর্মহীন বিপক্ষকে আক্রমণ করবেন না। তিনি শঠ যোদ্ধার সঙ্গে শঠতার দ্বারা এবং ধার্মিক যোদ্ধার সঙ্গে ধর্মানুসারে যুদ্ধ করবেন। ভীত বা বিজিত লোককে প্রহার করা উচিত নয়। বিষলিপ্ত বাণ বর্জনীয়, অসৎ লোকেই এরূপ অস্ত্র প্রয়োগ করে। যার অস্ত্র ভগ্ন হয়েছে বা বাহন হত হয়েছে, অথবা যে শরণাগত হয়েছে, তাকে বধ করবে না। আহত শত্রুর চিকিৎসা করবে অথবা তাকে নিজের গৃহে পাঠাবে। চিকিৎসার পর ক্ষত সেরে গেলে শত্রুকে মুক্তি দেবে।
চৈত্র বা অগ্রহায়ণ মাসেই সৈন্যসজ্জা করা প্রশস্ত; তখন শস্য পক্ক হয়, অধিক শীত বা গ্রীষ্ম থাকে না। বিপক্ষ বিপদ্গ্রস্ত হ’লে অন্য সময়েও সৈন্যসজ্জা করা যেতে পারে। বৃষ্টিহীন কালে রথাশ্ববহুল সৈন্য এবং বর্ষাকালে পদাতি ও হস্তিবহুল সৈন্য প্রশস্ত। যদি শান্তিস্থাপন সাধ্য হয় তবে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া অনুচিত। সাম দান ও ভেদ নীতি অসম্ভব হ’লেই যুদ্ধ বিধেয়। যুদ্ধকালে রাজা বলবেন, ‘আমার লোকেরা বিপক্ষসৈন্য বধ করছে তা আমার প্রিয়কার্য নয়, আহা, সকলেই বাঁচতে চায়।’ শত্রুর সমক্ষে এইরূপ ব’লে রাজা গোপনে নিজের যোদ্ধাদের প্রশংসা করবেন, এতে হত ও হন্তা উভয়েরই সম্মান হবে।
যুধিষ্ঠির, আত্মকলহের ফলে গণভেদ[২] ও বংশনাশ হয়, রাজ্যের মূল উচ্ছিন্ন হয়, সেজন্য তার প্রতিবিধান করা আবশ্যক। এই আভ্যন্তরিক ভয়ের তুলনায় বাহ্য শত্রুর ভয় তুচ্ছ। স্বপক্ষের সংঘবদ্ধতাই রাজ্যরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়।
৯। পিতা মাতা ও গুরু—ব্যবহার—রাজকোষ
ভীষ্ম বললেন, পিতা মাতা ও গুরুর সেবাই পরম ধর্ম। দশ জন শ্রোত্রিয় (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা পিতা শ্রেষ্ঠ, দশ পিতা বা সমস্ত পৃথিবী অপেক্ষা মাতা শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আমার মতে পিতা মাতা অপেক্ষাও গুরু শ্রেষ্ঠ। মানুষের নশ্বর দেহ পিতা মাতা হ’তে উৎপন্ন, কিন্তু আচার্যের উপদেশে যে জন্মলাভ হয় তা অজর অমর।
যুধিষ্ঠির, ক্রোধাবিষ্ট লোক যদি টিট্টিভ পক্ষীর ন্যায় কর্কশ বাক্য বলে তবে তা গ্রাহ্য করবে না। যে পুরুষাধম নিন্দিত কর্ম ক’রে আত্মপ্রশংসা করে তাকেও উপেক্ষা করবে। দুষ্ট খলের সঙ্গে বাক্যালাপ করাও উচিত নয়। মনু বলেছেন, যার দ্বারা প্রিয় বা অপ্রিয় সকল লোকের প্রতিই অপক্ষপাতে দণ্ডপ্রয়োশ ক’রে প্রজাপালন করা যায় তারই নাম ধর্ম। দণ্ডের ভয়েই লোকে পরস্পরের হানি থেকে বিরত থাকে। সম্যকরূপে ধর্মের নির্ধারণকেই ব্যবহার (আইন) বলে। বাদীপ্রতিবাদীর মধ্যে একজন বিশ্বাস উৎপাদন ক’রে জয়ী হয়, অপর জন দণ্ডলাভ করে; এই ব্যবহারশাস্ত্র রাজাদের জানা বিশেষ আবশ্যক। ব্যবহার দ্বারা যা নির্ধারিত হয় তাই বেদ, তাই ধর্ম, তাই সৎপথ। যে রাজা ধর্মনিষ্ঠ তাঁর দৃষ্টিতে মাতা পিতা ভ্রাতা ভার্যা পউরোহিত কেউ দণ্ডের বহির্ভূত নন।
রাজকোষ যদি ক্ষয় পায় তবে রাজার বলক্ষয় হয়। আপৎকালে অধর্মও ধর্মতুল্য হয় এবং ধর্মও অধর্মতুল্য হয়। সংকটে পড়লে ব্রাহ্মণ অযাজ্য লোকেরও যাজন করেন, অভোজ্য অন্নও ভোজন করেন। সেইরূপ ক্ষত্রিয় রাজা আপৎকালে ব্রাহ্মণ ও তপস্বী ভিন্ন অন্যের ধন সবলে গ্রহণ করতে পারেন। অরণ্যচারী মুনি ভিন্ন আর কেউ হিংসা বর্জন করে জীবিকানির্বাহ করতে পারে না। ধনবান লোকের অপ্রাপ্য কিছু নেই, রাজকোষ পূর্ণ থাকলে রাজা সকল বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হন।