মহাভারত (রাজশেখর বসু)/সভাপর্ব/অর্ঘ্যাভিহরণপর্বাধ্যায়
॥অর্ঘ্যাভিহরণপর্বাধ্যায়॥
৮। কৃষ্ণকে অর্ঘ্য প্রদান
অভিষেকের দিনে অভ্যাগত ব্রাহ্মণ ও রাজাদের সঙ্গে নারদাদি মহর্ষিগণ যজ্ঞশালার অন্তর্গৃহে প্রবেশ করলেন। ঋষিগণ কার্যের অবকাশে গল্প করতে লাগলেন। বিতণ্ডাকারী দ্বিজগণ বলতে লাগলেন, এইরকম হবে, ও রকম নয়। কেউ কেউ শাস্ত্রের যুক্তি দিয়ে লঘু বিষয়কে গুরু এবং গুরু বিষয়কে লঘু প্রতিপাদিত করতে লাগলেন। আকাশে শ্যেনপক্ষীরা যেমন মাংসখণ্ড নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি করে সেইরূপ কোনও কোনও বুদ্ধিমান অপরের উক্তির নানাপ্রকার অর্থ করতে লাগলেন। কয়েকজন সর্ববেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ধর্ম ও অর্থ বিষয়ক আলাপে সানন্দে নিরত হলেন।
যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে সর্বদেশের ক্ষত্রিয়রাজগণ সমবেত হয়েছেন দেখে নারদ এইপ্রকার চিন্তা করলেন।—সাক্ষাৎ নারায়ণ প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য ক্ষত্রকুলে জন্মেছেন। তিনি পূর্বে দেবগণকে আদেশ দিয়েছিলেন—তোমরা পরস্পরকে বধ ক’রে পুনর্বার স্বর্গালোকে আসবে। ইন্দ্রাদি দেবতা যাঁর বাহুবল আশ্রয় করেন তিনিই পৃথিবীতে অন্ধক-বৃষ্ণিদের বংশ উজ্জ্বল করেছেন। অহো, এই মহাবিস্তৃত বলশালী ক্ষত্রগণকে নারায়ণ নিজেই সংহার করবেন!
ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এখন রাজগণকে যথাযোগ্য অর্ঘ্য দেবার ব্যবস্থা কর। গুরু পরোহিত, সম্বন্ধী, স্নাতক, সুহৃৎ ও রাজা এই ছ জন অর্ঘ্যদানের যোগ্য। এঁরা বহুদিন পরে আমাদের কাছে এসেছেন। তুমি এঁদের প্রত্যেককেই অর্ঘ্য দিতে পার অথবা যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তাঁকে দিতে পার। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি এঁদের মধ্যে একজনের নাম করুন যিনি অর্ঘ্যদানের যোগ্য। ভীষ্ম বললেন, জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে যেমন ভাস্কর, সেইরূপ সমাগত সকল জনের মধ্যে তেজ বল ও পরাক্রমে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ।—
অসূর্যমিব সূর্যেণ নির্বাতমিব বায়ুনা।
ভাসিতং হ্লাদিতঞ্চৈব কৃষ্ণেনেদং সদো হি নঃ॥
—সূর্য যেমন অন্ধকারময় স্থান উদভাসিত করেন, বায়ু যেমন নির্বাত স্থান আহ্লাদিত করেন, সেইরূপ কৃষ্ণ আমাদের এই সভা আলোকিত ও আহ্লাদিত করেছেন।
ভীষ্মের অনুমতিক্রমে সহদেব কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য যথাবিধি নিবেদন করলেন, কৃষ্ণও তা নিলেন। চেদিরাজ শিশুপাল কৃষ্ণের এই পূজা সইতে পারলেন না, তিনি সভামধ্যে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরকে ভর্ৎসনা ক’রে কৃষ্ণের নিন্দা ক’রতে লাগলেন।
৯। শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দা
শিশুপাল বললেন, যুধিষ্ঠির, এখানে মহামহিম রাজারা উপস্থিত থাকতে কৃষ্ণ রাজার যোগ্য পূজা পেতে পারেন না। তোমরা বালক, সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্ব জান না, ভীষ্মেরও বুদ্ধিলোপ হয়েছে। ভীষ্ম, তোমার ন্যায় ধর্মহীন লোক নিজের প্রিয়কার্য করতে গিয়ে সাধুজনের অবজ্ঞাভাজন হয়। কৃষ্ণ রাজা নন, তিনি তোমাদের পূজা কেন পাবেন? যদি বয়োবৃদ্ধকে অর্ঘ্য দিতে চাও তবে বসুদেব থাকতে তাঁর পুত্রকে দেবে কেন? যদি কৃষ্ণকে পাণ্ডবদের হিতৈষী আর অনুগত মনে কর তবে দ্রুপদ অর্ঘ্য পাবেন না কেন? যদি কৃষ্ণকে আচার্য মনে কর তবে দ্রোণকে অর্থ দিলে না কেন? যদি কৃষ্ণকে পুরোহিত ভেবে থাক তবে বৃদ্ধ দ্বৈপায়ন থাকতে কৃষ্ণকে পূজা করলে কেন? মহারাজ যুধিষ্ঠির, মৃত্যু যাঁর ইচ্ছাধীন সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম এখানে রয়েছেন; সর্বশাস্ত্রবিশারদ বীর অশ্বত্থামা, রাজেন্দ্র দুর্যোধন, ভরতকুলের আচার্য কৃপ, তোমার পিতা পাণ্ডুর ন্যায় গুণবান মহাবল ভীষ্মক, মদ্রাধিপ শল্য, এবং জামদগ্ন্যের প্রিয়শিষ্য বহুযুদ্ধজয়ী মহারথ কর্ণও এখানে আছেন— এঁদের কাকেও অর্ঘ্য দেওয়া হ’ল না কেন? কৃষ্ণের অর্চনা করাই যদি তোমাদের উদ্দেশ্য হয় তবে অপমান করবার জন্য রাজাদের কেন ডেকে আনলে? আমরা যে কর দিয়েছি তা যুধিষ্ঠিরের ভয়ে বা অনুনয়ে নয়, লোভেও নয়। তিনি ধর্মকার্য করছেন, সম্রাট হ’তে চান, এই কারণেই দিয়েছি। কিন্তু এখন ইনি আমাদের গ্রাহ্য করছেন না। যে দুরাত্মা অন্যায় উপায়ে জরাসন্ধকে নিহত করেছে সেই ধর্মচ্যুত কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দিয়ে যুধিষ্ঠিরের ধর্মাত্মা-খ্যাতি নষ্ট হ’ল। আর মাধব, হীনবুদ্ধি পাণ্ডবরা অর্ঘ্য দিলেও তুমি অযোগ্য হয়ে কেন তা নিলে? কুকুর যেমন নির্জন স্থানে ঘৃত পেয়ে ভোজন করে কৃতার্থ হয়, তুমিও সেইরূপ পূজা পেয়ে গৌরব বোধ করছ। কুরুবংশীয়গণ তোমাকে অর্ঘ্য দিয়ে উপহাস করেছে। নপুংসকের যেমন বিবাহ, অন্ধের যেমন রূপদর্শন, রাজা না হয়েও রাজযোগ্য পূজা নেওয়া তোমার পক্ষে সেইরূপ। রাজা যুধিষ্ঠির কেমন, ভীষ্ম কেমন, আর এই বাসুদেবও কেমন তা আমরা আজ দেখলাম। এই কথা ব’লে শিশুপাল স্বপক্ষীয় রাজাদের আসন থেকে উঠিয়ে সদলে সভা থেকে চললেন।
যুধিষ্ঠির তখনই শিশুপালের পিছনে পিছনে গিয়ে মিষ্টবাক্যে বললেন, চেদিরাজ, তোমার কথা ন্যায়সংগত হয় নি, শান্তনুপুত্র ভীষ্মকে তুমি অবজ্ঞা করতে পার না। এখানে তোমার চেয়ে বৃদ্ধ বহু মহীপাল রয়েছেন, তাঁরা যখন কৃষ্ণের পূজা মেনে নিয়েছেন তখন তোমার আপত্তি করা উচিত নয়। কৃষ্ণকে ভীষ্ম যেমন জানেন তুমি তেমন জান না।
ভীষ্ম বললেন, যিনি সর্বলোকের মধ্যে প্রবীণতম সেই কৃষ্ণের পূজায় যার সম্মতি নেই সে অনুনয় বা মিষ্টবাক্যের যোগ্য নয়। মহাবাহু কৃষ্ণ কেবল আমাদের অর্চনীয় নন, ইনি ত্রিলোকেরই অর্চনীয়। বহু ক্ষত্রিয়কে কৃষ্ণ যুদ্ধে জয় করেছেন, নিখিল জগৎ তাঁতে প্রতিষ্ঠিত, সেজন্য বৃদ্ধ রাজারা এখানে থাকলেও আমি কৃষ্ণকেই পূজনীয় মনে করি। জন্মাবধি ইনি যা করেছেন তা আমি বহুলোকের কাছে বহুবার শুনেছি। এই সভায় উপস্থিত বালক বৃদ্ধ সকলকে পরীক্ষার পর কৃষ্ণের যশ শৌর্য ও জয় জেনেই আমরা তাঁকে অর্ঘ্য দিয়েছি। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যিনি সর্বাধিক বলশালী, বৈশ্যদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ধনী, এবং শূদ্রদের মধ্যে যিনি বয়োবৃদ্ধ, তিনিই বৃদ্ধ রূপে গণ্য হন। দুই কারণে গোবিন্দ সকলের পূজ্য—বেদ বেদাঙ্গের জ্ঞান এবং অমিত বিক্রম। নরলোকে কেশব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কে আছে? দান দক্ষতা বেদজ্ঞান শৌর্য শালীনতা কীর্তি, উত্তম বুদ্ধি, বিনয় শ্রী ধৈর্য বৃদ্ধি তুষ্টি, সমস্তই কৃষ্ণে নিত্য বিদ্যমান। ইনি ঋত্বিক গুরু সম্বন্ধী স্নাতক নৃপতি সুহৃৎ—সবই, সেজন্য আমরা এঁর পূজা করেছি। কৃষ্ণই সর্বলোকের উৎপত্তি ও বিনাশের কারণ, ইনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান, এই অর্বাচীন শিশুপাল তা বোঝে না তাই অমন কথা বলেছে। সে যদি মনে করে যে কৃষ্ণের পূজা অন্যায়, তবে যা ইচ্ছা করুক।
সহদেব বললেন, যিনি কেশীকে নিহত করেছেন, যাঁর পরাক্রম অপ্রমেয়, সেই কেশবকে আমি পূজা করছি। ওহে নৃপগণ, আপনাদের মধ্যে যে তা সইতে পারবে না তার মাথায় আমি পা রাখছি। সে আমার কথার উত্তর দিক, তাকে আমি নিশ্চয় বধ করব। রাজাদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিমান আছেন তাঁরা মানুন যে কৃষ্ণই অর্থদানের যোগ্য। সহদেব তাঁর পা তুলে দেখালেও সদ্বুদ্ধি মানী বলশালী রাজারা কিছু বললেন না। সহদেবের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি হ’ল, ‘সাধু সাধু’ ‘এই দৈববাণী শোনা গেল। ভূতভবিষ্যদ্দ্বক্তা সর্বলোকজ্ঞ নারদ বললেন, কমলপত্রাক্ষ কৃষ্ণকে যারা অর্চনা করে না তারা জীবন্মৃত, তাদের সঙ্গে কখনও কথা বলা উচিত নয়।
তার পর সহদেব পূজার্হ সকলকে পূজা ক’রে অর্ঘ্যদান কার্য শেষ করলেন। কৃষ্ণের পূজা হয়ে গেলে শিশু পাল ক্রোধে রক্তলোচন হয়ে রাজাদের বললেন, আমি আপনাদের সেনাপতি, আদেশ দিন, আমি বৃষ্ণি আর পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। শিশুপাল-প্রমুখ সকল রাজাই ক্রোধে আরক্তবদন হয়ে বলতে লাগলেন, যুধিষ্ঠিরের অভিষেক আর বাসুদেবের পূজা যাতে পণ্ড হয় তাই আমাদের করতে হবে। তাঁরা নিজেদের অপমানিত মনে করে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হলেন। সুহৃদ্গণ বারণ করলে তাঁরা গর্জন ক’রে উঠলেন, মাংসের কাছ থেকে সরিয়ে নিলে সিংহ যেমন করে। কৃষ্ণ বুঝলেন যে এই বিশাল নৃপতিসংঘ যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে।