মহাভারত (রাজশেখর বসু)/সভাপর্ব/শিশুপালবধপর্বাধ্যায়
॥শিশুপালবধপর্বাধ্যায়॥
১০। যজ্ঞসভায় বাগ্যুদ্ধ
যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, এই বিশাল রাজসমুদ্র ক্রোধে বিচলিত হয়েছে, যাতে যজ্ঞের বিঘ্ন না হয় এবং আমাদের মঙ্গল হয় তা বলুন। ভীষ্ম বললেন, ভয় পেয়ো না, কুকুরের দল যেমন প্রসুপ্ত সিংহের নিকটে এসে ডাকে, এই রাজারাও তেমনি কৃষ্ণের নিকট চিৎকার করছে। অল্পবুদ্ধি শিশুপাল সকল রাজাকেই যমালয়ে পাঠাতে উদ্যত হয়েছে। নরব্যাঘ্র কৃষ্ণ যাকে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করেন তার এইপ্রকার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে।
শিশুপাল বললেন, কুলাঙ্গার ভীষ্ম, তুমি বৃদ্ধ হয়ে রাজাদের বিভীষিকা দেখাচ্ছ, তোমার লজ্জা নেই? বদ্ধ নৌকা যেমন অন্য নৌকার অনুসরণ করে, এক অন্ধ যেমন অন্য অন্ধের পিছনে যায়, কৌরবগণও সেইরূপ তোমার অনুসরণ করছে। তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে একজন গোপের স্তব করতে চাও! বাল্যকালে কৃষ্ণ পুতনাকে বধ করেছিল, যুদ্ধে অক্ষম অশ্বাসুর আর বৃষভাসুরকে মেরেছিল, একটা অচেতন কাষ্ঠময় শকট পা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল—এতে আশ্চর্য কি আছে? সপ্তাহকাল গোবর্ধন ধারণ করেছিল যা একটা উইঢিবি মাত্র, তাও বিচিত্র নয়। একদিন কৃষ্ণ পর্বতের উপর খেলা করতে করতে প্রচুর অন্ন খেয়েছিল, তাও আশ্চর্য নয়; যে কংসের অন্ন কৃষ্ণ খেত তাঁকেই সে হত্যা করেছে এইটেই পরমাশ্চর্য। ধার্মিক সাধুরা বলেন, স্ত্রী গো ব্রাহ্মণ অন্নদাতা আর আশ্রয়দাতার উপর অস্ত্রাঘাত করবে না। এই কৃষ্ণ গোহত্যা ও স্ত্রীহত্যা করেছে, আর তোমার উপদেশে তাকেই পূজা করা হয়েছে! তুমি বলেছ, কৃষ্ণ বুদ্ধিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণ জগতের প্রভু; কৃষ্ণও তাই ভাবে। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, তুমি নিজেকে প্রাজ্ঞ মনে কর, তবে অন্য পুরুষে অনুরক্তা কাশীরাজকন্যা অম্বাকে হরণ করেছিলে কেন? তুমি প্রাজ্ঞ তাই তোমারই সম্মুখে অন্য একজন তোমার ভ্রাতৃজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন! তোমার কোন্ ধর্ম আছে? তোমার ব্রহ্মচর্যও মিথ্যা, মোহবশে বা ক্লীবত্বের জন্য তুমি ব্রহ্মচারী হয়েছ। নিঃসন্তানের যজ্ঞ দান উপবাস সবই ব্যর্থ। একটি প্রাচীন উপাখ্যান শোন।—এক বৃদ্ধ হংস সমুদ্রতীরে বাস করত, সে মুখে ধর্ম কথা বলত কিন্তু তার স্বভাব অন্যবিধ ছিল। সেই সত্যবাদী হংস সর্বদা বলত, ধর্মাচরণ কর, অধর্ম ক’রো না। জলচর পক্ষীরা সমুদ্র থেকে খাদ্য সংগ্রহ ক’রে তাকে দিত এবং তার কাছে নিজেদের ডিম রেখে চরতে যেত। সেই পাপী হংস সুবিধা পেলেই ডিমগুলি খেয়ে ফেলত। অবশেষে জানতে পেরে পক্ষীরা সেই মিথ্যাচারী হংসকে মেরে ফেললে। ভীষ্ম, এই ক্রুদ্ধ রাজারা তোমাকেও সেই হংসের ন্যায় বধ করবেন।
তার পর শিশুপাল বললেন, মহাবল জরাসন্ধ রাজা আমার অতিশয় সম্মানের পাত্র ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে দাস গণ্য করতেন তাই তার সঙ্গে যুদ্ধ করেন নি। কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে, অদ্বার দিয়ে গিরিব্রজপুরে প্রবেশ করেছিল। ব্রাহ্মণভক্ত জরাসন্ধ কৃষ্ণ আর ভীমার্জুনকে পাদ্য-অর্থ্যাদি দিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ তা নেয় নি। মূর্খ ভীষ্ম, কৃষ্ণ যদি জগৎকর্তাই হয় তবে নিজেকে পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণ মনে করে না কেন?
শিশুপালের কথা শুনে ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন, তাঁর স্বভাবত আয়ত পদ্মপলাশবর্ণ নয়ন রক্তবর্ণ হ’ল। তিনি ওষ্ঠ দংশন ক’রে সবেগে আসন থেকে উঠলেন, কিন্তু ভীষ্ম তাঁকে ধরে নিরস্ত করলেন। শিশুপাল হেসে বললেন, ভীষ্ম, ওকে ছেড়ে দাও, রাজারা দেখুন ও আমার তেজে পতঙ্গবৎ দগ্ধ হবে। ভীষ্ম বললেন, এই শিশুপাল তিন চক্ষু আর চার হাত নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এবং জন্মকালে গর্দভের ন্যায় চিৎকার করেছিল। এর মাতা পিতা প্রভৃতি ভয় পেয়ে একে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন দৈববাণী হ’ল—রাজা, তোমার পুত্রটিকে পালন কর, এর মৃত্যুকাল এখনও আসে নি, যদিও এর হন্তা জন্মগ্রহণ করেছেন। শিশুপালের জননী নমস্কার ক’রে বললেন, আপনি দেবতা বা অন্য যাই হ’ন, বলুন কার হাতে এর মৃত্যু হবে। পুনর্বার দৈববাণী হ’ল—যিনি কোলে নিলে এর অতিরিক্ত দুই হাত খ’সে যাবে এবং যাঁকে দেখে এর তৃতীয় নয়ন লুপ্ত হবে তিনিই এর মৃত্যুর কারণ হবেন। চেদিরাজের অনুরোধে বহু সহস্র রাজা শিশুকে কোলে নিলেন, কিন্তু কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। কিছুকাল পরে বলরাম ও কৃষ্ণ তাঁদের পিতৃষ্বসা (চেদিরাজ দমঘোষের মহিষী) কে দেখতে এলেন। রাজমহিষী কুশলপ্রশ্নাদি করে শিশুটিকে কৃষ্ণের কোলে দিলেন, তৎক্ষণাৎ তার অতিরিক্ত দুই বাহু খ’সে গেল, তৃতীয় চক্ষু ললাটে নিমজ্জিত হ’ল। মহিষী বললেন, কৃষ্ণ, আমি ভয়ার্ত হয়েছি, তুমি বর দাও যে শিশুপালের অপরাধ ক্ষমা করবে। কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, দেবী, ভয় নেই, আমি এর একশত অপরাধ ক্ষমা করব। ভীম, এই মন্দমতি শিশুপাল গোবিন্দের বরে দর্পিত হয়েই তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছে। এই বুদ্ধি এর নিজের নয়, জগৎস্বামী কৃষ্ণের প্রেরণাতেই এমন করছে।
শিশুপাল বললেন, ভীষ্ম, যদি স্তব ক’রেই আনন্দ পাও তবে বাহ্ণীকরাজ, মহাবীর কর্ণ, অশ্বত্থামা দ্রোণ জয়দ্রথ কৃপ ভীষ্মক শল্য প্রভৃতির স্তব কর না কেন? হিমালয়ের পরপারে কুলিঙ্গ পক্ষিণী থাকে, সে সতত এই শব্দ করে—‘মা সাহসম্’, সাহস ক’রো না, অথচ সে নিজে সিংহের দাঁতের ফাঁক থেকে মাংস খায়, সে জানে না যে সিংহের ইচ্ছাতেই সে বেঁচে আছে। তুমিও সেইরূপ এই ভূপতিদের ইচ্ছায় বেঁচে আছ।
ভীষ্ম বললেন, চেদিরাজ, যাদের ইচ্ছায় আমি বেঁচে আছি সেই রাজাদের আমি তৃণতুল্যও জ্ঞান করি না। ভীষ্মের কথায় কেউ হাসলেন, কেউ গালি দিলেন, কেউ বললেন, একে পুড়িয়ে মার। ভীষ্ম বললেন, উক্তি আর প্রত্যুক্তিতে বিবাদের শেষ হবে না। আমি তোমাদের মাথায় এই পা রাখছি। যে গোবিন্দকে আমরা পূজা করেছি তিনি এখানেই রয়েছেন, মরবার জন্য যে ব্যস্ত হয়েছে সে চক্রগদাধারী কৃষ্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করুক।
১১। শিশুপাল বধ—রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তি
শিশুপাল বললেন, জনার্দন, তোমাকে আহ্বান করছি, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর, সমস্ত পাণ্ডবদের সঙ্গে আজ তোমাকেও বধ করব। তুমি রাজা নও, কংসের দাস, পূজার অযোগ্য। যে পাণ্ডবরা বাল্যকাল থেকে তোমার অর্চনা করছে তারাও আমার বধ্য।
কৃষ্ণ মৃদুবাক্যে সমবেত নৃপতিবৃন্দকে বললেন, রাজগণ, যাদবরা এই শিশুপালের কোনও অপকার করে নি তথাপি এ আমাদের শত্রুতা করেছে। আমরা যখন প্রাগ্জ্যোতিষপুরে যাই তখন আমাদের পিতৃষ্বসার পুত্র হয়েও এই নৃশংস দ্বারকা দগ্ধ করেছিল। ভোজরাজ রৈবতকে বিহার করছিলেন, তাঁর সহচরগণকে শিশুপাল হত্যা ও বন্ধন ক’রে নিজ রাজ্যে চ’লে যায়। এই পাপাত্মা আমার পিতার অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব হরণ করেছিল। বভ্রুর ভার্যা দ্বারকা থেকে সৌবীর দেশে যাচ্ছিলেন, সেই অকামা নারীকে এ হরণ করেছিল। এই নৃশংস ছদ্মবেশে মাতুলকন্যা ভদ্রাকে নিজ মিত্র করুষ রাজার জন্য হরণ করেছিল। আমার পিতৃষ্বসার জন্য আমি সব সয়েছি, কিন্তু শিশুপাল আজ আপনাদের সমক্ষে আমার প্রতি যে আচরণ করলে তা আপনারা দেখলেন। এই অন্যায় আমি ক্ষমা করতে পারব না। এই মূঢ় রুক্মিণীকে প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু শূদ্র যেমন বেদবাক্য শুনতে পায় না এও তেমনি রুক্মিণীকে পায় নি।
বাসুদেবের কথা শুনে রাজারা শিশুপালের নিন্দা করতে লাগলেন। শিশুপাল উচ্চ হাস্য ক’রে বললেন, কৃষ্ণ, পূর্বে রুক্মিণীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয়েছিল এই কথা এখানে বলতে তোমার লজ্জা হ’ল না? নিজের স্ত্রী অন্যপূর্বা ছিল এই কথা তুমি ভিন্ন আর কে সভায় প্রকাশ করতে পারে? তুমি ক্ষমা কর বা না কর, ক্রুদ্ধ হও বা প্রসন্ন হও, তুমি আমার কি করতে পার?
তখন ভগবান মধুসূদন চক্র দ্বারা শিশুপালের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করলেন, বজ্রাহত পর্বতের ন্যায় মহাবাহু শিশুপাল ভূপতিত হলেন। রাজারা দেখলেন, আকাশ থেকে সূর্যের ন্যায় একটি উজ্জ্বল তেজ শিশুপালের দেহ থেকে নির্গত হ’ল এবং কমলপত্রাক্ষ কৃষ্ণকে প্রণাম ক’রে তাঁর দেহে প্রবেশ করলে। বিনা মেঘে বৃষ্টি ও বজ্রপাত হ’ল, বসুন্ধরা কেঁপে উঠলেন, রাজারা কৃষ্ণকে দেখতে লাগলেন কিন্তু তাঁদের বাক্স্ফূর্তি হ’ল না। কেউ ক্রোধে হস্তপেষণ ও ওষ্ঠদংশন করলেন, কেউ নির্জন স্থানে গিয়ে কৃষ্ণের প্রশংসা করলেন, কেউ মধ্যস্থ হয়ে রইলেন। মহর্ষিগণ, মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং মহাবল নৃপতিগণ কৃষ্ণের স্তুতি করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের আজ্ঞা দিলেন যেন সত্বর শিশুপালের সৎকার করা হয়। তার পর যুধিষ্ঠির ও সমবেত রাজারা শিশুপালপুত্রকে চেদিরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হ’ল; ভগবান শৌরি (কৃষ্ণ) শার্ঙ্গধনু চক্র ও গদা নিয়ে শেষ পর্যন্ত যজ্ঞ রক্ষা করলেন। যধিষ্ঠির অবভৃথ স্নান (যজ্ঞান্ত স্নান) করলে সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজারা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, ভাগ্যক্রমে আপনি সাম্রাজ্য পেয়েছেন এবং অজমীঢ় বংশের যশোবৃদ্ধি করেছেন। এই যজ্ঞে সুমহৎ ধর্মকার্য করা হয়েছে, আমরাও সর্বপ্রকারে সংস্কৃত হয়েছি। এখন আজ্ঞা করুন আমরা নিজ নিজ রাজ্যে যাব। যুধিষ্ঠিরের আদেশে তাঁর ভ্রাতারা, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পুত্রগণ প্রধান প্রধান রাজাদের অনুগমন করলেন। কৃষ্ণ বিদায় চাইলে যুধিষ্ঠির বললেন, গোবিন্দ, তোমার প্রসাদেই আমার যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে, সমগ্র ক্ষত্রিয়মণ্ডল আমার বশে এসেছে। কি ব’লে তোমাকে বিদায় দেব? তোমার অভাবে আমি স্বস্তি পাব না। তার পর সুভদ্রা ও দ্রৌপদীকে মিষ্টবাক্যে তুষ্ট করে কৃষ্ণ মেঘবর্ণ গরুড়ধ্বজ রথে দ্বারকায় প্রস্থান করলেন।