মহাভারত (রাজশেখর বসু)/সভাপর্ব/দ্যূতপর্বাধ্যায়

॥দ্যূতপর্বাধ্যায়॥

১২। দুর্যোধনের দুঃখ—শকুনির মন্ত্রণা

 ইন্দ্রপ্রস্থে বাসকালে শকুনির সঙ্গে দুর্যোধন পাণ্ডবসভার সমস্ত ঐশ্বর্য ক্রমে ক্রমে দেখলেন। স্ফটিকময় এক স্থানে জল আছে মনে ক’রে তিনি পরিধেয় বস্ত্র টেনে তুললেন, পরে ভ্রম বুঝতে পেরে লজ্জায় বিষণ্ণ হলেন। আর এক স্থানে পদ্মশোভিত সরোবর ছিল, স্ফটিকনির্মিত মনে ক’রে দুর্যোধন চলতে গিয়ে তাতে প’ড়ে গেলেন, ভৃত্যরা হেসে তাঁকে অন্য বস্ত্র এনে দিলে। তিনি বস্ত্র পরিবর্তন ক’রে এলে ভীমার্জুন প্রভৃতিও হাসলেন, দুর্যোধন ক্রোধে তাঁদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন না। অন্য এক স্থানে তিনি দ্বার আছে মনে করে স্ফটিকময় প্রাচীরের ভিতর দিয়ে যেতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেলেন। আর এক স্থানে কপাট আছে ভেবে ঠেলতে গিয়ে সম্মুখে পড়ে গেলেন, এবং অন্যত্র দ্বার খোলা থাকলেও বন্ধ আছে ভেবে ফিরে এলেন। এইরূপ নানা প্রকারে বিড়ম্বিত হয়ে তিনি অপ্রসন্নমনে হস্তিনাপুরে প্রস্থান করলেন।

 শকুনি জিজ্ঞাসা করলেন, দুর্যোধন, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছ কেন? দুর্যোধন বললেন, মাতুল, অর্জুনের অস্ত্রপ্রভাবে সমস্ত পৃথিবী যুধিষ্ঠিরের বশে এসেছে এবং তাঁর রাজসূয় যজ্ঞও সম্পন্ন হয়েছে দেখে আমি ঈর্ষায় দিবারাত্র দগ্ধ হচ্ছি। কৃষ্ণ শিশুপালকে বধ করলেন, কিন্তু এমন কোনও পুরুষ ছিল না যে তার শোধ নেয়। বৈশ্য যেমন কর দেয় সেইরূপ রাজারা বিবিধ রত্ন এনে যুধিষ্ঠিরকে উপহার দিয়েছেন। আমি অগ্নিপ্রবেশ করব, বিষ খাব, জলে ডুবব, জীবনধারণ করতে পারব না। যদি পাণ্ডবদের সমৃদ্ধি দেখে সহ্য করি তবে আমি পুরুষ নই, স্ত্রী নই, ক্লীবও নই। তাদের রাজশ্রী আমি একাকী আহরণ করতে পারব না, আমার সহায়ও দেখছি না, তাই মৃত্যুচিন্তা করছি। পাণ্ডবদের বিনাশের জন্য আমি পূর্বে বহু যত্ন করেছি, কিন্তু তারা সবই অতিক্রম করেছে। পুরুষকারের চেয়ে দৈবই প্রবল, তাই আমরা ক্রমশ হীন হচ্ছি আর পাণ্ডবরা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাতুল, আমাকে মরতে দিন, আমার দুঃখের কথা পিতাকে জানাবেন।

 শকুনি বললেন যুধিষ্ঠিরের প্রতি ক্রোধ করা তোমার উচিত নয়, পাণ্ডবরা নিজেদের ভাগ্যফলই ভোগ করছে। তারা পৈতৃক রাজ্যের অংশই পেয়েছে এবং নিজের শক্তিতে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাতে তোমার দুঃখ হচ্ছে কেন? ধনঞ্জয় অগ্নিকে তুষ্ট ক’রে গাণ্ডীব ধনু, দুই অক্ষয় তূণীর আর ভয়ংকর অস্ত্র সকল পেয়েছে, সে তার কার্মুক আর বাহুর বলে রাজাদের বশে এনেছে, তাতে খেদের কি আছে? ময় দানবকে দিয়ে সে সভা করিয়েছে, কিঙ্কর নামক রাক্ষসরা সেই সভা রক্ষা করে, তাতেই বা তোমার দুঃখ হবে কেন? তুমি অসহায় নও, তোমার দ্রাতারা আছেন, মহাধনুর্ধর দ্রোণ, অশ্বত্থামা, সূতপুত্র কর্ণ, কৃপাচার্য, আমি ও আমার ভ্রাতারা, আর রাজা সোমদত্ত—এঁদের সঙ্গে মিলে তুমি সমগ্র বসুন্ধরা জয় করতে পার।

 দুর্যোধন বললেন, যদি অনুমতি দেন তবে আপনাদের সাহায্যে আমি পৃথিবী জয় করব, সকল রাজা আমার বশে আসবে, পাণ্ডবসভাও আমার হবে। শকুনি বললেন, পঞ্চপাণ্ডব, বাসুদেব এবং সপুত্র দ্রুপদ—দেবতারাও এঁদের হারাতে পারেন না। যুধিষ্টিরকে যে উপায়ে জয় করা যায় তা আমি বলছি শোন। সে দ্যূতক্রীড়া ভালবাসে কিন্তু খেলতে জানে না, তথাপি তাকে ডাকলে আসবেই। দ্যূতক্রীড়ায় আমার তুল্য নিপুণ ত্রিলোকে নেই। তুমি যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান কর, আমি তার রাজ্য আর রাজলক্ষ্মী জয় ক’রে নিশ্চয় তোমাকে দেব। এখন তুমি ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নাও। দুর্যোধন বললেন, সুবলনন্দন, আপনিই তাঁকে বলুন, আমি পারব না।

১৩। ধৃতরাষ্ট্র-শকুনি-দুর্যোধন-সংবাদ

 হস্তিনাপুরে এসে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, দুর্যোধন দুর্ভাবনায় পাণ্ডুবর্ণ ও কৃশ হয়ে যাচ্ছে, কোনও শত্রু তার এই শোকের কারণ। আপনি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেন না কেন?

 ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে বললেন, পুত্র, তোমার শোকের কারণ কি? মহৎ ঐশ্বর্য আর রাজচ্ছত্র তোমাকে আমি দিয়েছি, তোমার ভ্রাতারা আর বন্ধুরা তোমার অহিত করেন না, তুমি উত্তম বসন পরছ, সমাংস অন্ন খাচ্ছ; উৎকৃষ্ট অশ্ব, মহার্ঘ শয্যা, মনোরমা নারীবৃন্দ, উত্তম বাসগৃহ ও বিহারস্থানও তোমার আছে; তবে তুমি দীনের ন্যায় শোক করছ কেন? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, পিতা, আমি কাপুরুষের ন্যায় ভোজন করছি, পরিধান করছি, এবং কালের পরিবর্তন প্রতীক্ষা ক’রে দারুণ ক্রোধ পোষণ করছি। আমাদের শত্রুরা সমৃদ্ধ হচ্ছে, আমরা হীন হয়ে যাচ্ছি, এই কারণেই আমি বিবর্ণ ও কৃশ হচ্ছি। অষ্টাশি হাজার স্নাতক গৃহস্থ এবং তাদের প্রত্যেকের ত্রিশটি দাসী যুধিষ্ঠির পালন করেন। তাঁর ভবনে প্রত্যহ দশ হাজার লোক স্বর্ণ পাত্রে উত্তম অন্ন খায়। বহু রাজা তাঁর কাছে কর নিয়ে এসেছিলেন এবং অনেক অশ্ব হস্তী উষ্ট্র স্ত্রী পট্টবস্ত্র কম্বল প্রভৃতি উপহার দিয়েছেন। শত শত ব্রাহ্মণ কর দেবার জন্য এসেছিলেন কিন্তু নিবারিত হয়ে দ্বারদেশেই অপেক্ষা করছিলেন, অবশেষে যুধিষ্ঠিরকে জানিয়ে সভায় প্রবেশ করতে পান। বহু রত্নভূষিত স্বর্ণময় কলস এবং উৎকৃষ্ট শঙ্খ দিয়ে বাসুদেব যুধিষ্ঠিরকে অভিষিক্ত করেছেন, তা দেখে আমার যেন জ্বর এল। প্রত্যহ এক লক্ষ ব্রাহ্মণের ভোজন শেষ হ’লে একটি শঙ্খ বাজত, তার শব্দ শুনে আমার রোমাঞ্চ হ’ত। যুধিষ্ঠিরের তুল্য ঐশ্বর্য ইন্দ্র যম বরুণ বা কুবেরেরও নেই। পাণ্ডুপুত্রদের সমৃদ্ধি দেখে আমি মনে মনে দগ্ধ হচ্ছি, আমার শান্তি নেই। মহারাজ, আমার এই অক্ষবিৎ মাতুল দ্যূতক্রীড়ায় পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য হরণ করতে চান, আপনি অনুমতি দিন।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ বিদুরের উপদেশে আমি চলি, তাঁর মত নিয়ে কর্তব্য স্থির করব। তিনি দূরদর্শী, ধর্মসংগত ও উভয় পক্ষের হিতকর উপদেশই তিনি দেবেন। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, বিদুর আপনাকে বারণ করবেন, তার ফলে আমি নিশ্চয় মরব, আপনি বিদুরকে নিয়ে সুখে থাকবেন। পুত্রের এই আর্ত বাক্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র আদেশ দিলেন, শিল্পীরা শীঘ্র একটি মনোরম বিশাল সভা নির্মাণ করুক, তার সহস্র স্তম্ভ ও শত দ্বার থাকবে। তার পর ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, পুত্র, তুমি পৈতৃক রাজ্য পেয়েছ, ভ্রাতাদের জ্যেষ্ঠ ব’লে রাজার পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, তবে শোক করছ কেন?

 পাণ্ডবসভায় তিনি কিরূপ বিড়ম্বনা আর উপহাস ভোগ করেছিলেন তা জানিয়ে দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, যুধিষ্ঠিরের জন্য বিভিন্ন দেশের রাজারা যে উপহার এনেছিলেন তার বিবরণ শুনুন। কাম্বোজরাজ স্বর্ণখচিত মেষলোমনির্মিত এবং গর্তবাসী প্রাণী ও বিড়ালের লোমনির্মিত আবরণবস্ত্র এবং উত্তম চর্ম দিয়েছেন। ত্রিগর্তরাজ বহুশত অশ্ব, উষ্ট্র ও অশ্বতর দিয়েছেন। শূদ্রেরা কার্পাসিকদেশবাসিনী শতসহস্র তন্বী শ্যামা দীর্ঘকেশী দাসী দিয়েছে। ম্লেচ্ছরাজ ভগদত্ত বহু অশ্ব, লৌহময় অলংকার, এবং হস্তিদন্তের মুষ্টিযুক্ত অসি দিয়েছেন। দ্বিচক্ষু, ত্রিচক্ষু[], ললাটচক্ষু[], উষ্ণীষধারী, বস্ত্রহীন, রোমশ, নরখাদক, একপাদ[], চীন, শক, উড্র, বর্বর, বনবাসী, হারহূণ প্রভৃতি লোকেরা নানা দিক থেকে এসেছিল, তারা বহুক্ষণ দ্বারদেশে অপেক্ষা ক’রে তবে প্রবেশ করতে পেরেছিল। মেরু ও মন্দর পর্বতের মধ্যে শৈলোদা নদীর তীরে যারা থাকে, সেই খস পারদ কুলিঙ্গ প্রভৃতি জাতি রাশি রাশি পিপীলিক[] স্বর্ণ এনেছিল, পিপীলিকারা যা ভূমি থেকে তোলে। কিরাত দরদ পারদ বাহ্ণীক কেরল অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুণ্ড্রক এবং আরও বহু দেশের লোক নানাবিধ উপহার দিয়েছে। বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনের সম্মানার্থে চোদ্দ হাজার উৎকৃষ্ট হস্তী দিয়েছেন। দ্রৌপদী প্রত্যহ অভুক্ত থেকে দেখতেন সভায় আগত কুব্জ-বামন পর্যন্ত সকলের ভোজন হয়েছে কিনা। কেবল দুই রাষ্ট্রের লোক যুধিষ্ঠিরকে কর দেয় নি—বৈবাহিক সম্বন্ধের জন্য পাঞ্চালগণ এবং সখিত্বের জন্য অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়গণ। রাজসূয় যজ্ঞ ক’রে যুধিষ্ঠির হরিশ্চন্দ্রের ন্যায় সমৃদ্ধিলাভ করেছেন, তা দেখে আমার আর জীবনধারণের প্রয়োজন কি?

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুত্র, যুধিষ্ঠির তোমার প্রতি বিদ্বেষ করে না, তার যেমন অর্থবল ও মিত্রবল আছে তোমারও তেমন আছে। তোমার আর পাণ্ডবদের একই পিতামহ। ভ্রাতার সম্পত্তি কেন হরণ করতে ইচ্ছা কর? যদি যজ্ঞ ক’রে ঐশ্বর্য লাভ করতে চাও তবে ঋত্বিকরা তার আয়োজন করুন। তুমি যজ্ঞে ধনদান কর, কাম্যবস্তু ভোগ কর, স্ত্রীদের সঙ্গে বিহার কর, কিন্তু অধর্ম থেকে নিবৃত্ত হও।

 দুর্যোধন বললেন, যার নিজের বুদ্ধি নেই, কেবল বহু শাস্ত্র শুনেছে, সে শাস্ত্রার্থ বোঝে না, দর্বী (হাতা) যেমন সুপের (দালের) স্বাদ বোঝে না। আপনি পরের বুদ্ধিতে চ’লে আমাকে ভোলাচ্ছেন কেন? বৃহস্পতি বলেছেন, রাজার আচরণ সাধারণের আচরণ থেকে ভিন্ন, রাজা সযত্নে স্বার্থ চিন্তা করবেন। মহারাজ, জয়লাভই ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি, ধর্মাধর্ম বিচারের প্রয়োজন নেই। অমুক শত্রু, অমুক মিত্র, এরূপ কোনও লেখ্য প্রমাণ নাই, চিহ্ণও নেই; যে লোক সন্তাপের কারণ সেই শত্রু। জাতি অনুসারে কেউ শত্রু হয় না, বৃত্তি সমান হলেই শত্রুতা হয়।

 শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠিরের যে সমৃদ্ধি দেখে তুমি সন্তপ্ত হচ্ছ তা আমি দ্যূতক্রীড়ায় হরণ করব, তাকে আহ্বান কর। আমি সুদক্ষ দ্যূতজ্ঞ, সেনার সম্মুখীন না হয়ে পাশা খেলেই অজ্ঞ পাণ্ডবদের জয় করব তাতে সন্দেহ নেই। পণই আমার ধনু, অক্ষই আমার বাণ, ক্ষেপণের দক্ষতাই আমার ধনুর্গণ, আসনই আমার রথ। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমি মহাত্মা বিদুরের মতে চ’লে থাকি, তাঁর সঙ্গে কথা ব’লে কর্তব্য স্থির করব। পুত্র, প্রবলের সঙ্গে কলহ করা আমার মত নয়, কলহ অলৌহময় অস্ত্রস্বরূপ, তাতে বিপ্লব উৎপন্ন হয়। দুর্যোধন বললেন, বিদুর আপনার বুদ্ধিনাশ করবেন তাতে সংশয় নেই, তিনি পাণ্ডবদের হিত যেমন চান তেমন আমাদের চান না। প্রাচীন কালের লোকেরাও দ্যূতক্রীড়া করেছেন, তাতে বিপদ বা যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। দৈব যেমন আমাদের তেমন পাণ্ডবদেরও সহায় হ’তে পারেন। আপনি মাতুল শকুনির বাক্যে সম্মত হয়ে পাণ্ডবদের দ্যূতসভায় আনবার জন্য আজ্ঞা দিন।

 ধৃতরাষ্ট্র অবশেষে অনিচ্ছায় সম্মতি দিলেন এবং সংবাদ নিয়ে জানলেন যে দ্যূতসভানির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। তখন তিনি তাঁর মুখ্য মন্ত্রী বিদুরকে বললেন, তুমি শীঘ্র গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে ডেকে আন, তিনি ভ্রাতাদের সঙ্গে এসে আমাদের সভা দেখুন এবং সুহৃদ্‌ভাবে দ্যূতক্রীড়া করুন। বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনার আদেশের প্রশংসা করতে পারি না, দ্যূতের ফলে বংশনাশ হবে, পুত্রদের মধ্যে কলহ হবে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বিদুর, দৈব যদি প্রতিকূল না হয় তবে কলহ আমাকে দুঃখ দিতে পারবে না, বিধাতা সর্বজগৎ দৈবের বশে রেখেছেন। তুমি আমার আজ্ঞা পালন কর।

১৪। যুধিষ্ঠিরাদির দ্যূতসভায় আগমন

 ধৃতরাষ্ট্রের আজ্ঞাবশে বিদুর ইন্দ্রপ্রস্থে গেলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ক্ষত্তা[], মনে হচ্ছে আপনার মনে সুখ নেই, আপনি কুশলে এসেছেন তো? বৃদ্ধ রাজার পুত্র ও প্রজারা বশে আছে তো? কুশল জ্ঞাপনের পর বিদুর বললেন, রাজা যুধিষ্ঠির, কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র তোমাকে এই বলেছেন।—তোমার ভ্রাতারা এখানে যে সভা নির্মাণ করেছেন তা তোমাদের সভারই তুল্য, এসে দেখে যাও। তুমি তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে এখানে এসে সুহৃদ্‌ভাবে দ্যূতক্রীড়া কর, আমোদ কর। তোমরা এলে আমরা সকলেই আনন্দিত হব।

 যুধিষ্ঠির বললেন, দ্যূত থেকে কলহ উৎপন্ন হয়, বুদ্ধিমান ব্যক্তির তা রুচিকর নয়। আপনার কি মত? বিদুর বললেন, আমি জানি যে দ্যূত অনর্থের মূল, তার নিবারণের চেষ্টাও আমি করেছিলাম, তথাপি ধৃতরাষ্ট্র আমাকে পাঠিয়েছেন। যুধিষ্ঠির, তুমি বিদ্বান, যা শ্রেয় তাই কর। যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনির সঙ্গে খেলতে আমার ইচ্ছা নেই, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র যখন ডেকেছেন তখন আমি নিবৃত্ত হ’তে পারি না।

 পরদিন যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী, ভ্রাতৃগণ ও পরিজনদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ কৃপ দুর্যোধন শল্য শকুনি প্রভৃতির সঙ্গে দেখা ক’রে ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে গেলেন। গান্ধারী তাঁকে আশীর্বাদ করলেন, ধৃতরাষ্ট্রও পঞ্চপাণ্ডবের মস্তকাঘ্রাণ করলেন। দ্রৌপদীর অত্যুজ্জ্বল বেশভূষা দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূরা বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন না। পাণ্ডবগণ সুখে রাত্রিযাপন ক’রে পরদিন প্রাতঃকৃত্যের পর দ্যূতসভায় প্রবেশ করলেন।

 শকুনি বললেন, রাজা যুধিষ্ঠির, সভায় সকলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন, এখন খেলা আরম্ভ হ’ক। যুধিষ্ঠির বললেন, দ্যূতক্রীড়া শঠতাময় ও পাপজনক, তাতে ক্ষত্রোচিত পরাক্রম নেই, নীতিসংগতও নয়। শঠতায় গৌরব নেই, শকুনি, আপনি অন্যায়ভাবে আমাদের জয় করবেন না। শকুনি বললেন, যে পূর্বেই জানে পাশা ফেললে কোন্ সংখ্যা পড়বে, যে শঠতার প্রণালী বোঝে, এবং যে অক্ষক্রীড়ায় নিপুণ সে সমস্তই সইতে পারে। যুধিষ্ঠির, নিপুণ দ্যূতকারের হাতে বিপক্ষের পরাজয় হয়, সে কারণে আমাদেরই পরাজয়ের আশঙ্কা আছে, তথাপি আমরা খেলব। যুধিষ্ঠির বললেন, আমি শঠতার দ্বারা সুখ বা ধন লাভ করতে চাই না, ধূর্ত দ্যূতকারের শঠতা প্রশংসনীয় নয়। শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও বিদ্বানরাও শঠতার দ্বারা পরস্পরকে জয় করতে চেষ্টা করেন, এপ্রকার শঠতা নিন্দনীয় নয়। তবে তোমার যদি আপত্তি বা ভয় থাকে তবে খেলো না। যুধিষ্ঠির বললেন, আহ্বান করলে আমি নিবৃত্ত হই না, এই আমার ব্রত। এই সভায় কার সঙ্গে আমার খেলা হবে? পণ কে দেবে? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, মহারাজ, আমিই পণের জন্য ধনরত্ন দেব, আমার মাতুল শকুনি আমার হয়ে খেলবেন। যুধিষ্ঠির বললেন, একজনের পরিবর্তে অন্যের খেলা রীতিবিরদ্ধে মনে করি। যাই হ’ক, যা ভাল বোঝ তাই কর।

১৫। দ্যূতক্রীড়া

 এই সময়ে ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর পশ্চাতে অপ্রসন্নমনে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও বিদুর সভায় এসে আসন গ্রহণ করলেন। তার পর খেলা আরম্ভ হ’ল। যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা দুর্যোধন, সাগরের আবর্ত থেকে উৎপন্ন এই মহামূল্য মণি যা আমার স্বর্ণহারে আছে তাই আমার পণ। তোমার পণ কি? দুর্যোধন উত্তর দিলেন, আমার অনেক মণি আর ধন আছে, সে সমস্তই আমার পণ। তখন শকুনি তাঁর পাশা ফেললেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই জিতলাম।

 যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনি, আপনি কপট ক্রীড়ায় আমার পণ জিতে নিলেন। যাই হ’ক, সহস্র সুবর্ণে পূর্ণ আমার অনেক মঞ্জুষা আছে, এবারে তাই আমার পণ। শকুনি পুনর্বার পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। তার পর যুধিষ্ঠির বললেন, সহস্র রথের সমমূল্য ব্যাঘ্রচমার্বত কিংকিণীজালমণ্ডিত সর্ব উপকরণ সমেত ওই উত্তম রথ যাতে আমি এখানে এসেছি, এবং তার কুমুদশভ্র আটটি অশ্ব আমার পণ। এই কথা শুনেই শকুনি পূর্ববৎ শঠতা অবলম্বন করে পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি।

 তার পর যুধিষ্ঠির পর পর এইসকল পণ রাখলেন।—সালংকারা নৃত্যগীতাদিনিপুণা এক লক্ষ তরুণী দাসী; কর্মকুশল উষ্ণীষকুণ্ডলধারী নম্র স্বভাব এক লক্ষ যুবক দাস; এক হাজার উত্তম হস্তী; স্বর্ণধ্বজ ও পতাকায় শোভিত এক হাজার রথ যার প্রত্যেক রথী যুদ্ধকালে এবং অন্য কালেও সহস্র মুদ্রা মাসিক বেতন পান; গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ অর্জুনকে যেসকল বিচিত্রবর্ণ অশ্ব দিয়েছিলেন; দশ হাজার রথ ও দশ হাজার শকট; ষাট হাজার বিশালবক্ষী বীর সৈনিক যারা দুগ্ধ পান করে এবং শালিতণ্ডুলের অন্ন খায়; স্বর্ণমুদ্রায় পূর্ণ চার শত ধনভাণ্ড। এ সমস্তই শকুনি শঠতার দ্বারা জয় করলেন।

 দ্যূতক্রীড়ায় এইরূপে যুধিষ্ঠিরের সর্বনাশ হচ্ছে দেখে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, মুমূর্ষু ব্যক্তির ঔষধে রুচি হয় না, আমার বাক্যও হয়তো আপনার অপ্রিয় হবে, তথাপি বলছি শুনুন। এই দুর্যোধন জন্মগ্রহণ ক’রেই শৃগালের ন্যায় রব করেছিল, এ ভরতবংশ ধ্বংস করবে। আপনি জানেন যে অন্ধক যাদব আর ভোজবংশীয়গণ তাঁদেরই আত্মীয় কংসকে ত্যাগ করেছিলেন, এবং তাঁদেরই নিয়োগে কৃষ্ণ কংসকে বধ করেছিলেন। আপনি আদেশ দিন, সব্যসাচী অর্জুন দুর্যোধনকে বধ করবেন, এই পাপী নিহত হ’লে কৌরবগণ সুখী হবে। আপনি শৃগালতুল্য দুর্যোধনের বিনিময়ে শার্দূলতুল্য পাণ্ডবগণকে ক্রয় করুন। কুলরক্ষার প্রয়োজনে যদি একজনকে ত্যাগ করতে হয় তবে তাই করা উচিত; গ্রামরক্ষার জন্য কুল, জনপদ রক্ষার জন্য গ্রাম এবং আত্মরক্ষার জন্য পৃথিবীও ত্যাগ করা উচিত। দ্যূত থেকে কলহ ভেদ ও দারুণ শত্রুতা হয়, দুর্যোধন তাই সৃষ্টি করছে। মত্ত বৃষ যেমন নিজের শৃঙ্গ ভগ্ন করে, দুর্যোধন তেমন নিজের রাজ্য থেকে মঙ্গল দূর করছে। মহারাজ, দুর্যোধনের জয়ে আপনার খুব আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু এ থেকেই যুদ্ধ আর লোকক্ষয় হবে। ধনের প্রতি আপনার আকর্ষণ আছে এবং তার জন্য আপনি মন্ত্রণা করেছেন তা জানি। এখন আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এই যে কলহ সৃষ্ট হ’ল এতে আমাদের মত নেই। হে প্রতীপ ও শান্তনুর বংশধরগণ, তোমরা আমার হিতবাক্য শোন, ঘোর অগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছে, নির্বোধের অনুসরণ ক’রে তাতে প্রবেশ ক’রো না। এই অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির, বৃকোদর, সব্যসাচী এবং নকুল-সহদেব যখন ক্রোধ সংবরণ করতে পারবেন না তখন তুমুল যুদ্ধসাগরে দ্বীপ রূপে কোন পুরুষকে আশ্রয় করবে? এই পার্বতদেশবাসী শকুনি কপটদ্যূতে পটু তা আমরা জানি, ও যেখান থেকে এসেছে সেখানেই চ’লে যাক, পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ ক’রো না।

 দুর্যোধন বললেন, ক্ষত্তা, আপনি সর্বদাই আমাদের নিন্দা আর মূর্খ ভেবে অবজ্ঞা করেন। আপনি নির্লজ্জ, যা ইচ্ছা তাই বলছেন। নিজেকে কর্তা ভাববেন না, আমার কিসে হিত হবে তা আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি না। আমরা অনেক সয়েছি, আমাদের উত্ত্যক্ত করবেন না। একজনই শাসনকর্তা আছেন, দ্বিতীয় নেই; যিনি গর্ভস্থ শিশুকে শাসন করেন তিনিই আমার শাসক; তাঁর প্রেরণায় আমি জলস্রোতের ন্যায় চালিত হচ্ছি। যিনি পর্বত ও ভূমি বিদীর্ণ করেন তাঁর বুদ্ধিই মানুষের কার্য নিয়ন্ত্রিত করে। বলপূর্বক অন্যকে শাসন করতে গেলেই শত্রু সৃষ্টি হয়। যে লোক শত্রুর দলভুক্ত তাকে গৃহে বাস করতে দেওয়া অনুচিত। বিদুর, আপনি যেখানে ইচ্ছা চ’লে যান।

 বিদুর বললেন, রাজপুত্র, ষাট বৎসরের পতি যেমন কুমারীর কাম্য নয়, আমিও সেইরূপ তোমার অপ্রিয়। এর পরে যদি হিতাহিত সকল বিষয়ে নিজের মনোমত মন্ত্রণা চাও তবে স্ত্রী জড় পঙ্গু ও মূঢ়দের জিজ্ঞাসা ক’রো। প্রিয়ভাষী পাপী লোক অনেক আছে কিন্তু অপ্রিয় হিতবাক্যের বক্তা আর শ্রোতা দইই দুর্লভ। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আমি সর্বদাই বিচিত্রবীর্যের বংশধরদের যশ ও ধন কামনা করি। যা হবার তা হবে, আপনাকে নমস্কার করি, ব্রাহ্মণেরা আমাকে আশীর্বাদ করুন।

 শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির, তুমি পাণ্ডবদের বহু সম্পত্তি হেরেছ, আর যদি কিছু থাকে তো বল। যুধিষ্ঠির বললেন, সুবলনন্দন, আমার ধন অসংখ্য, তাই নিয়ে আমি খেলব। এই ব’লে তিনি পণ করলেন—অসংখ্য অশ্ব গো ছাগ মেষ এবং পর্ণাশা ও সিন্ধু নদীর পূর্বপারের সমস্ত সম্পত্তি; নগর, জনপদ, ব্রহ্মস্ব ভিন্ন সমস্ত ধন ও ভূমি, ব্রাহ্মণ ভিন্ন সমস্ত পুরুষ। শকুনি সবই জিতে নিলেন। তখন যুধিষ্ঠির রাজপুত্রগণের কুণ্ডলাদি ভূষণ পণ করলেন এবং তাও হারলেন। তার পর তিনি বললেন, এই শ্যামবর্ণ লোহিতাক্ষ সিংহস্কন্ধ মহাবাহু যুবা নকুল আমার পণ। শকুনি নকুলকে এবং তার পর সহদেবকেও জয় ক’রে বললেন, যুধিষ্ঠির, তোমার প্রিয় দুই মাদ্রীপুত্রকে আমি জিতেছি, বোধ হয় ভীম আর অর্জুন তোমার আরও প্রিয়।

 যুধিষ্ঠির বললেন, মূঢ়, তুমি আমাদের মধ্যে ভেদ জন্মাতে চাচ্ছ। শকুনি বললেন, মত্ত লোক গর্তে পড়ে, প্রমত্ত লোক বহুভাষী হয়। তুমি রাজা এবং বয়সে বড়, তোমাকে নমস্কার করি। লোকে জুয়াখেলার সময় অনেক উৎকট কথা বলে[]

 যুধিষ্ঠির বললেন, শকুনি, যিনি যুদ্ধে নৌকার ন্যায় আমাদের পার করেন, যিনি শত্রুজয়ী ও বলিষ্ঠ, পণের অযোগ্য সেই রাজপুত্র অর্জুনকে পণ রাখছি। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। যুধিষ্ঠির বললেন, বজ্রধারী ইন্দ্রের ন্যায় যিনি যুদ্ধে আমাদের নেতা, যিনি তির্যক্‌প্রেক্ষী[] সিংহষ্কন্ধ ক্রুদ্ধস্বভাব, যাঁর তুল্য বলবান কেউ নেই, পণের অযোগ্য সেই ভীমসেনকে পণ রাখছি। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি। অবশেষে যুধিষ্ঠির নিজেকেই পণ রাখলেন এবং হারলেন।

 শকুনি বললেন, রাজা, কিছু ধন অবশিষ্ট থাকতে তুমি নিজেকে পণ রেখে হারলে, এতে পাপ হয়। তোমার প্রিয়া পাঞ্চালী এখনও বিজিত হন নি, তাঁকে পণ রেখে নিজেকে মুক্ত কর। যুধিষ্ঠির বললেন, যিনি অতিখর্বা বা অতিকৃষ্ণা নন, কৃশা বা রক্তবর্ণা নন, যিনি কৃষ্ণকুঞ্চিতকেশী, পদ্মপলাশাক্ষী, পদ্মগন্ধা, রূপে লক্ষ্মীসমা, সর্বগুণান্বিতা, প্রিয়ংবদা, সেই দ্রৌপদীকে পণ রাখছি।

 ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের এই কথা শুনে সভা বিক্ষুব্ধ হ’ল, বৃদ্ধগণ ধিক ধিক বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি ঘর্মাক্ত হলেন, বিদুর মাথায় হাত দিয়ে মোহগ্রস্তের ন্যায় অধোবদনে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র মনোভাব গোপন করতে পারলেন না, হৃষ্ট হয়ে বার বার জিজ্ঞাসা করলেন, কি জিতলে, কি জিতলে? কর্ণ দুঃশাসন প্রভৃতি আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন, অন্যান্য সদস্যগণের চক্ষু থেকে অশ্রুপাত হ’ল। শকুনি পাশা ফেলে বললেন, জিতেছি।

 দুর্যোধন বিদুরকে বললেন, পাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীকে নিয়ে আসুন, সেই অপুণ্যশীলা অন্য দাসীদের সঙ্গে গৃহমার্জনা করুক। বিদুর বললেন, তোমার মতন লোকেই এমন কথা বলতে পারে। কৃষ্ণা দাসী হ’তে পারেন না, কারণ তাঁকে পণ রাখবার সময় যুধিষ্ঠিরের স্বামিত্ব ছিল না। মূর্খ, মহাবিষ ক্রুদ্ধ সর্প তোমার মাথার উপর রয়েছে, তাদের আরও কুপিত ক’রো না, যমালয়ে যেয়ো না। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র নরকের ভয়ংকর দ্বারে উপস্থিত হয়েও তা বুঝছে না, দুঃশাসন প্রভৃতিও তার অনুসরণ করছে।

১৬। দ্রৌপদীর নিগ্রহ—ভীমের শপথ—ধৃতরাষ্ট্রের বরদান

 দুর্যোধন তাঁর এক অনুচরকে বললেন, প্রাতিকামী, তুমি দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এস, তোমার কোনও ভয় নেই। সূতবংশীয় প্রাতিকামী দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললে, যাজ্ঞসেনী, যুধিষ্ঠির দ্যূতসভায় ভীমার্জুন-নকুল-সহদেবকে এবং নিজেকে পণ রেখে হেরে গেছেন। আপনাকেও তিনি পণ রেখেছিলেন, দুর্যোধন অপনাকে জয় করেছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। দ্রৌপদী বললেন, সূতপত্র, তুমি দ্যূতকার যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা ক’রে এস—তিনি আগে নিজেকে না আমাকে হেরেছিলেন?

 প্রাতিকামী সভায় এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে যুধিষ্ঠির প্রাণহীনের ন্যায় ব’সে রইলেন, কিছই উত্তর দিলেন না। দুর্যোধন বললেন, পাঞ্চালী নিজেই এখানে এসে প্রশ্ন করুন। প্রাতিকামী আবার গেলে দ্রৌপদী বললেন, তুমি ধর্মাত্মা নীতিমান সদস্যগণকে জিজ্ঞাসা কর, ধর্মানুসারে আমার কর্তব্য কি। তাঁরা যা বলবেন আমি তাই করব। প্রাতিকামী সভায় ফিরে এসে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানালে সকলে অধোমুখে নীরবে রইলেন। এই সময়ে যুধিষ্ঠির একজন বিশ্বস্ত দূতকে দিয়ে দ্রৌপদীকে ব’লে পাঠালেন, পাঞ্চালী, তুমি এখন রজস্বলা একবস্ত্রা, এই অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে সভায় এসে শ্বশুরের সম্মুখে দাঁড়াও।

 দুর্যোধন পুনর্বার প্রাতিকামীকে বললেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে এস। প্রাতিকামী ভীত হয়ে বললে, তাঁকে কি বলব? দুর্যোধন বললেন, এই সূতপুত্র ভীমের ভয়ে উদ্‌বিগ্ন হয়েছে। দুঃশাসন, তুমি নিজে দ্রৌপদীকে ধ’রে নিয়ে এস। দুঃশাসন দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, পাঞ্চালী, তুমি বিজিত হয়েছে, লজ্জা ত্যাগ ক’রে দুর্যোধনের সঙ্গে দেখা কর, কৌরবগণকে ভজনা কর। দ্রৌপদী ব্যাকুল হয়ে বেগে ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীদের কাছে চললেন, কিন্তু দুঃশাসন তর্জন করে তাঁর কেশ ধরলেন যে কেশ রাজসূয় যজ্ঞের মন্ত্রপূত জলে সিক্ত হয়েছিল। দুঃশাসনের আকর্ষণে নতদেহ হয়ে দ্রৌপদী বললেন, মন্দবুদ্ধি অনার্য, আমি একবস্ত্রা রজস্বলা, আমাকে সভায় নিয়ে যেয়ো না। দুঃশাসন বললেন, তুমি রজস্বলা একবস্ত্রা বা বিবস্ত্রা যাই হও, দ্যূতে বিজিত হয়ে দাসী হয়েছে, আমাদের ভজনা কর।

 বিক্ষিপ্তকেশে অর্ধস্খলিতবসনে দ্রৌপদী সভায় আনীত হলেন। লজ্জায় ও ক্রোধে দগ্ধ হ’য়ে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, দুঃশাসন, ইন্দ্রাদি দেবগণও যদি তোমার সহায় হন তথাপি পাণ্ডবগণ তোমাকে ক্ষমা করবেন না। এই কুরুবীরগণের মধ্যে আমাকে টেনে আনা হ’ল কিন্তু কেউ তার নিন্দা করছেন না! ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না? ধিক, ভরতবংশের ধর্ম আর চরিত্র নষ্ট হয়েছে, এই সভায় কৌরবগণ কুলধর্মের মর্যাদালঙ্ঘন নীরবে দেখছেন। দ্রৌপদী করুণম্বরে এইরূপে বিলাপ ক’রে বক্রনয়নে পতিদের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে দুঃশাসন তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সশব্দে হেসে বললেন, দাসী! কর্ণও হৃষ্ট হ’য়ে অট্টহাস্য করলেন, শকুনিও অনুমোদন করলেন।

 সভাস্থ আর সকলেই অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ভীষ্ম বললেন, ভাগ্যবতী, ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না। যুধিষ্ঠির সব ত্যাগ করলেও সত্য ত্যাগ করেন না, তিনিই বলেছেন—আমি বিজিত হয়েছি। দ্যূতক্রীড়ায় শকুনি অদ্বিতীয়, তাঁর জন্যই যুধিষ্ঠিরের খেলার ইচ্ছা হয়েছিল। শকুনি শঠতা অবলম্বন করেছেন যুধিষ্ঠির এমন মনে করেন না। দ্রৌপদী বললেন, যুধিষ্ঠিরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধূর্ত দুষ্ট শঠ লোকে তাঁকে এই সভায় আহ্বান করেছে। তাঁর খেলতে ইচ্ছা হয়েছিল কেন বলছেন? তিনি শুদ্ধস্বভাব, প্রথমে শঠতা বুঝতে পারেন নি তাই পরাজিত হয়েছেন, পরে বুঝতে পেরেছেন। এই সভায় কুরুবংশীয়গণ রয়েছেন, এঁরা কন্যা ও পুত্রবধূদের অভিভাবক, সুবিচার করে বলুন আমাকে জয় করা হয়েছে কি না।

 দ্রৌপদীর অপমান দেখে ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্যূতকাররা তাদের বেশ্যাকেও কখনও পণ রাখে না, তাদের দয়া আছে। শত্রুরা শঠতার দ্বারা ধন রাজ্য এবং আমাদেরও হরণ করেছে, তাতেও আমার ক্রোধ হয় নি, কারণ আপনি এই সমস্তের প্রভু। কিন্তু পাণ্ডবভার্যা দ্রৌপদী এই অপমানের যোগ্য নন, হীন নৃশংস কৌরবগণ আপনার দোষেই তাঁকে ক্লেশ দিচ্ছে। আমি আপনার হস্ত দগ্ধ করব— সহদেব, অগ্নি আন।

 অর্জুন ভীমকে শান্ত করলেন। দুর্যোধনের এক ভ্রাতা বিকর্ণ সভাস্থ সকলকে বললেন, পাঞ্চালী যা বললেন আপনারা তার উত্তর দিন, যদি সুবিচার না করেন তবে আমাদের সদ্য নরকগতি হবে। কুরুগণের মধ্যে বৃদ্ধতম ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র, মহামতি বিদুর, আচার্য দ্রোণ ও কৃপ, এঁরা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন? যে সকল রাজারা এখানে আছেন তাঁরাও বলুন। বিকর্ণ এইরূপে বহুবার বললেও কেউ উত্তর দিলেন না। তখন হাতে হাত ঘষে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বিকর্ণ বললেন, আপনারা কিছু বলুন বা না বলুন, আমি যা ন্যায্য মনে করি তা বলছি। মৃগয়া মদ্যপান অক্ষক্রীড়া এবং অধিক স্ত্রীসংসর্গ—এই চারটি রাজাদের ব্যসন। ব্যসনাসক্ত ব্যক্তি ধর্ম থেকে চ্যুত হয়, তার কৃত কর্মকে লোকে অকৃত ব’লে মনে করে। যুধিষ্ঠির ব্যসনাসক্ত হ’য়ে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন। কিন্তু সকল পাণ্ডবই দ্রৌপদীর স্বামী, আর যুধিষ্ঠির নিজে বিজিত হবার পর দ্রৌপদীকে পণ বেখেছিলেন, অতএব দ্রৌপদী বিজিত হন নি।

 সভায় মহা কোলাহল উঠল, অনেকে বিকর্ণের প্রশংসা আর শকুনির নিন্দা করতে লাগলেন। কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এই সভার সদস্যগণ যে কিছু বলছেন না তার কারণ এঁরা দ্রৌপদীকে বিজিত ব’লেই মনে করেন। বিকর্ণ, তুমি বালক হয়ে স্থবিরের ন্যায় কথা বলছ। নির্বোধ, তুমি ধর্ম জান না। যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ করেছিলেন দ্রৌপদী তার অন্তর্গত; তিনি স্পষ্টবাক্যে দ্রৌপদীকেও পণ রেখেছিলেন, পাণ্ডবগণ তাতে আপত্তি করেন নি। আরও শোন—স্ত্রীদের এক পতিই বেদবিহিত, দ্রৌপদীর অনেক পতি, অতএব এ বেশ্যা। শকুনি সমস্ত ধন ও দ্রৌপদী সমেত পঞ্চপাণ্ডবকে জয় করেছেন। দুঃশাসন, তুমি পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ কর।

 পাণ্ডবগণ নিজ নিজ উত্তরীয় বসন ফেলে দিলেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র ধ’রে সবলে টেনে নেবার উপক্রম করলেন। লজ্জা থেকে ত্রাণ পাবার জন্য দ্রৌপদী কৃষ্ণ বিষ্ণু হরিকে ডাকতে লাগলেন। তখন স্বয়ং ধর্ম বস্ত্রের রূপ ধ’রে তাঁকে আবৃত করলেন। দুঃশাসন আকর্ষণ করলে নানা বর্ণে রঞ্জিত এবং শুভ্র শত শত বসন আবির্ভূত হ’তে লাগল। সভায় তুমুল কোলাহল হ’ল, আশ্চর্য ঘটনা দেখে সভাস্থ রাজারা দ্রৌপদীর প্রশংসা আর দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন।

 ক্রোধে হস্ত নিষ্পিষ্ট ক’রে কম্পিত ওষ্ঠে ভীম উচ্চস্বরে বললেন, ক্ষত্রিয়গণ, শোন, যদি আমি যুদ্ধক্ষেত্রে এই পাপী দুর্বুদ্ধি ভরতকুলকলঙ্ক দুঃশাসনের বক্ষ বিদীর্ণ ক’রে রক্তপান না করি, তবে যেন পিতৃপুরষগণের গতি না পাই। ভীমের এই লোমহর্ষকর শপথ শুনে রাজারা তাঁর প্রশংসা এবং দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন। সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র রাশীকৃত হ’ল, দুঃশাসন শ্রান্ত ও লজ্জিত হয়ে ব’সে পড়লেন। বিদুর বললেন, সদস্যগণ, আপনারা রোরুদ্যমানা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না তাতে ধর্মের হানি হচ্ছে। বিকর্ণ নিজের বুদ্ধি অনুসারে উত্তর দিয়েছে, আপনারাও দিন। সভাস্থ রাজারা উত্তর দিলেন না। কর্ণ দুঃশাসনকে বললেন, এই কৃষ্ণা দাসীকে গৃহে নিয়ে যাও।

 দ্রৌপদী বিলাপ করতে লাগলেন। ভীষ্ম বললেন, কল্যাণী, আমি তোমাকে বলেছি যে ধর্মের গতি অতি দুর্বোধ সেজন্য আমি উত্তর দিতে পারছি না। কৌরবগণ লোভমোহপরায়ণ হয়েছে, শীঘ্রই এদের বিনাশ হবে। পাঞ্চালী, যুধিষ্ঠিরই বলুন তুমি অজিতা না জিতা। দুর্যোধন সহাস্যে বললেন, ভীম অর্জুন প্রভৃতি বলুন যে যুধিষ্ঠির তোমার স্বামী নন, তিনি মিথ্যাবাদী, তা হ’লে তুমি দাসীত্ব থেকে মক্ত হবে। অথবা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির স্বয়ং বলুন তিনি তোমার স্বামী কি অস্বামী। ভীম তাঁর চন্দনচর্চিত বিশাল বাহু তুলে বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যদি আমাদের গুরু না হতেন তবে কখনই ক্ষমা করতাম না। উনি যদি আমাকে নিষ্কৃতি দেন তবে চপেটাঘাতে এই পাপী ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণকে নিষ্পিষ্ট করতে পারি।

 অচেতনের ন্যায় নীরব যুধিষ্ঠিরকে দুর্যোধন বললেন, ভীমার্জুন প্রভৃতি আপনার আজ্ঞাধীন, আপনিই দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিন। এই ব’লে দুর্যোধন কর্ণের দিকে চেয়ে একটু হেসে বসন সরিয়ে কদলীকাণ্ডতুল্য তাঁর বাম ঊরু দ্রৌপদীকে দেখালেন। বৃকোদর ভীম বিস্ফারিতনয়নে বললেন, মহাযুদ্ধে তোমার ওই ঊরু যদি গদাঘাতে না ভাঙি তবে যেন আমার পিতৃলোকে গতি না হয়।

 বিদুর বললেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, এই ভীমসেন থেকে তোমাদের মহা বিপদ হবে তা জেনে বাখ। তোমরা দ্যূতের নিয়ম লঙ্ঘন করেছ, সভায় স্ত্রীলোক এনে বিবাদ করছ। ধর্ম নষ্ট হ’লে সভা দূষিত হয়। যুধিষ্ঠির নিজে বিজিত হবার পূর্বে দ্রৌপদীকে পণ রাখতে পারতেন, কিন্তু প্রভুত্ব হারাবার পর তা পারেন না।

 ধৃতরাষ্ট্রের অগ্নিহোত্রগৃহে একটা শৃগাল চিৎকার ক’রে উঠল, গর্দভ ও পক্ষীরাও ভয়ংকর রবে ডাকতে লাগল। অশুভ শব্দ শুনে বিদুর গান্ধারী ভীষ্ম দ্রোণ ও কৃপ ‘স্বস্তি স্বস্তি’ বললেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মূর্খ দুর্যোধন, এই কৌরবসভায় তুমি পাণ্ডবগণের ধর্মপত্নীর সঙ্গে কথা বলেছ! তুমি মরেছ। তার পর তিনি দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, পাঞ্চালী, তুমি আমার বধূদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং ধর্মশীলা সতী, আমার কাছে অভীষ্ট বর চাও।

 দ্রৌপদী বললেন, ভরতর্ষভ, এই বর দিন যেন সর্বধর্মচারী যুধিষ্ঠির দাসত্ব থেকে মুক্ত হন, আমার পুত্র প্রতিবিন্ধ্যকে কেউ যেন দাসপুত্র ব’লে না ডাকে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, কল্যাণী, যা বললে তাই হবে। তুমি দ্বিতীয় বর চাও, আমার মন বলছে একটিমাত্র বর তোমার যোগ্য নয়। দ্রৌপদী বললেন, মহারাজ, ভীমসেন ধনঞ্জয় আর নকুল-সহদেব দাসত্ব থেকে মুক্ত ও স্বাধীন হ’ন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পুত্রী, তাই হবে। দুটি বরও তোমার পক্ষে যথেষ্ট নয়, তৃতীয় বর চাও। দ্রৌপদী বললেন মহারাজ, লোভে ধর্মনাশ হয়, আমি আর বর চাই না। এই বিধান আছে যে বৈশ্য এক বর, ক্ষত্রিয়াণী দুই বর, রাজা তিন বর এবং ব্রাহ্মণ শত বর নিতে পারেন। আমার স্বামীরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে পুণ্যকর্মের বলেই শ্রেয়োলাভ করবেন।

 কর্ণ বললেন, দ্রৌপদী যা করলেন কোনও নারী তা পূর্বে করেছেন এমন শুনি নি, দুঃখসাগরে নিমগ্ন পাণ্ডবগণকে ইনি নৌকার ন্যায় পার করেছেন। এই কথা শুনে ভীম দুঃখিত হয়ে বললেন, মহর্ষি দেবলের মতে পুরুষের তেজ তিনটি—অপত্য, কর্ম ও বিদ্যা। পত্নীর অপমানে আমাদের সন্তান দূষিত হ’ল। অর্জুন বললেন, হীন লোকে কি বলে না বলে তা নিয়ে সজ্জনরা জল্পনা করেন না, তাঁরা নিজ ক্ষমতায় নির্ভর করেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন বিতর্কে প্রয়োজন কি, মহারাজ, আমি আজই সমস্ত শত্রুকে বিনাশ করব, তার পর আপনি পৃথিবী শাসন করবেন।

 যুধিষ্ঠির ভীমকে নিবৃত্ত ক’রে বসিয়ে দিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহারাজ, আমরা সর্বদাই আপনার অধীন, আদেশ করুন এখন কি করব। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, অজাতশত্রু, তোমার মঙ্গল হ’ক। সমস্ত ধন সমেত তোমরা নির্বিঘ্নে ফিরে যাও, নিজ রাজ্য শাসন কর। আমি বৃদ্ধ, তোমাদের হিতকর আদেশই দিচ্ছি। তুমি ধর্মের সূক্ষ্ম গতি জান, তুমি বিনীত, বৃদ্ধদের সেবক। যাঁরা উত্তম পুরুষ তাঁরা কারও শত্রুতা করেন না, পরের দোষ না দেখে গুণই দেখেন। এই সভায় তুমি সাধুজনোচিত আচরণ করেছ। বৎস, দুর্যোধনের নিষ্ঠুরতা মনে রেখো না। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী বৃদ্ধ অন্ধ পিতা, আমাকে আর তোমার মাতা গান্ধারীকে দেখো। তোমাদের দেখবার জন্য এবং এই দুই পক্ষের বলাবল জানবার জন্য আমি দ্যূতসভায় মত দিয়েছিলাম। তোমার ন্যায় শাসনকর্তা এবং বিদুরের ন্যায় মন্ত্রী থাকতে কুরুবংশীয়গণের কোনও ভয় নেই। এখন তুমি ইন্দ্রপ্রস্থে যাও, ভ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সম্প্রীতি এবং ধর্মে মতি থাকুক।

  1. ১.০ ১.১ ১.২ ১.৩ মেগাস্থেনিসের ভারতবিবরণে এই সকলের উল্লেখ আছে।
  2. দাসীপুত্র। বিদুরের উপাধি।
  3. অর্থাৎ আমার কথায় রাগ ক’রো না।
  4. যাঁর চক্ষু বা দৃষ্টি বাঁকা।