মহাভারত (রাজশেখর বসু)/সভাপর্ব/দিগ্‌‌বিজয়পর্বাধ্যায়

॥দিগ্‌বিজয়পর্বাধ্যায়॥

৬। পাণ্ডবগণের দিগ্‌বিজয়

 অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, ধন, অস্ত্র সহায় ভূমি যশ সবই আমরা পেয়েছি, এখন রাজকোষে ধনবৃদ্ধি করা উচিত মনে করি। অতএব আমি সকল রাজার কাছ থেকে কর আদায় করব। যুধিষ্ঠির সম্মতি দিলে অর্জুন ভীম সহদেব ও নকুল বিভিন্ন দিকে দিগ্‌বিজয়ে যাত্রা করলেন। যুধিষ্ঠির সুহৃদ্‌গণের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে রইলেন।

 অর্জুন উত্তর দিকে গিয়ে কুলিন্দ, আনর্ত, শাকলদ্বীপ প্রভৃতি জয় ক’রে প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরে গেলেন। সেখানকার রাজা ভগদত্ত তাঁর কিরাত চীন এবং সাগরতীরবাসী অন্যান্য সৈন্য নিয়ে অর্জুনের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধ করলেন। আট দিন পরেও অর্জুনকে অক্লান্ত দেখে ভগদত্ত সহাস্যে বললেন, কুরুনন্দন, তোমার বল ইন্দ্রপুত্রেরই উপযুক্ত। আমি ইন্দ্রের সখা, তথাপি যুদ্ধে তোমার সঙ্গে পারছি না। পুত্র, তুমি কি চাও বল। অর্জুন বললেন, ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির সম্রাট হ’তে ইচ্ছা করেন, আপনি প্রীতিপূর্বক তাঁকে কর দিন। ভগদত্ত সম্মত হ’লে অর্জুন কুবেররক্ষিত উত্তর পর্বতের রাজ্যসমূহ, কাশ্মীর, লোহিত দেশ, ত্রিগর্ত, সিংহপুর, সুহ্ম, চোল, দেশ, বাহ্ণীক, কম্বোজ, দরদ প্রভৃতি জয় করলেন। তার পর তিনি শ্বেতপর্বত অতিক্রম ক’রে কিম্পুরুষ, হাটক ও গন্ধর্ব দেশ জয় ক’রে হরিবর্ষে এলেন। সেখানকার মহাবল মহাকায় দ্বারপালরা মিষ্টবাক্যে বললে, কল্যাণীয় পার্থ, নিবৃত্ত হও, এখানে প্রবেশ করলে কেউ জীবিত থাকে না। এই উত্তরকুরু দেশে যুদ্ধে হয় না, মানবদেহধারী এখানে এলে কিছুই দেখতে পায় না। যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কিছু চাও তো বল। অর্জুন সহাস্যে বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সম্রাট হবেন এই আমার ইচ্ছা। যদি এই দেশ মানুষের অগম্য হয় তবে আমি যেতে চাই না; তোমরা কিঞ্চিৎ কর দাও। দ্বারপালরা অর্জুনকে দিব্য বস্ত্র আভরণ মৃগচর্ম প্রভৃতি কর স্বরূপ দিলে। দিগ্‌বিজয় শেষ করে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে এলেন।

 ভীমসেন বিশাল সৈন্য নিয়ে পূর্বদিকে গিয়েছিলেন। তিনি পাঞ্চাল, গণ্ডকীয়, বিদেহ, দশার্ণ, পুলিন্দনগর প্রভৃতি জয় ক’রে চেদি দেশে উপস্থিত হলেন। চেদিরাজ শিশুপাল ভীমের কাছে এসে কুশলপ্রশ্ন ক’রে সহাস্যে বললেন, ব্যাপার কি? ভীম ধর্মরাজের অভীষ্ট জানালে শিশুপাল তখনই কর দিলেন। তের দিন শিশুপালের আতিথ্য ভোগ করে ভীম কুমার দেশের রাজা শ্রেণীমান ও কোশলপতি বৃহদ্বলকে পরাজিত করলেন। তার পর অযোধ্যা, গোপালকচ্ছ, উত্তরসোমক, মল্ল, মৎস্য, দরদ, বৎস, সুহ্ম প্রভৃতি দেশ জয় ক’রে গিরিব্রজপুরে গেলেন এবং জরাসন্ধপুত্র সহদেবের নিকট কর নিয়ে তাঁর সঙ্গে কর্ণের রাজ্যে উপস্থিত হলেন। কর্ণ বশ্যতা স্বীকার করলেন। তার পর পুণ্ড্রদেশের রাজা মহাবল বাসুদেব এবং কৌশিকী নদীর তীরবাসী রাজাকে পরাস্ত ক’রে বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কর্বট, সুহ্ম, এবং ব্রহ্মপুত্র নদ ও পূর্বসাগরের তীরবর্তী ম্লেচ্ছ দেশ জয় ক’রে বহু ধনরত্ন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।

 সহদেব দক্ষিণ দিকে শূরসেন ও মৎস্য দেশের রাজা, কুন্তিভোজ, অবন্তি ও ভোজকট দেশের রাজা দুর্ধর্ষ ভীষ্মক ও পাণ্ড্যরাজ প্রভৃতিকে পরাস্ত ক’রে কিষ্কিন্ধ্যায় গেলেন এবং বানররাজ মৈন্দ ও দ্বিবিদকে বশীভূত রলেন। তার পর তিনি মাহিষ্মতী পুরীতে গেলেন। সেখানকার রাজা নীলকে স্বয়ং অগ্নিদেব সাহায্য করতেন সেজন্য সহদেবের প্রচুর সৈন্যক্ষয় এবং প্রাণসংশয় হ’ল। মাহিষ্মতীবাসীরা ভগবান অগ্নিকে পারদারিক বলত। একদিন ব্রাহ্মণের বেশে অগ্নি নীল রাজার সুন্দরী কন্যার সহিত বিহার করছিলেন, রাজা তা জানতে পেরে অগ্নিকে শাসন করলেন। অগ্নির কোপে রাজভবন জ্বলে উঠল, তখন রাজা অগ্নিকে প্রসন্ন ক’রে কন্যাদান করলেন। সেই অবধি অগ্নিদেব রাজার সহায় হলেন। অগ্নির বরে মাহিষ্মতীর নারীরা স্বৈরিণী ছিল, তাদের বারণ করা যেত না। সহদেব বহু স্তুতি করলে অগ্নি তুষ্ট হলেন, তখন অগ্নির আদেশে নীল রাজা সহদেবকে কর দিলেন। সহদেব ত্রিপুর, পৌরব, সুরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ জয় ক’রে ভোজকট নগরে গিরে কৃষ্ণের শ্বশুর ভীষ্মক রাজার নিকট কর আদায় করলেন। তার পর তিনি কর্ণপ্রাবরক[] গণ, কালমুখ নামক নররাক্ষসগণ, একপাদ পুরুষগণ প্রভৃতিকে জয় ক’রে কেবল দূত পাঠিয়ে পাণ্ড্য, দ্রবিড়, উড্র, কেরল, অন্ধ্র, কলিঙ্গ প্রভৃতি দেশ থেকে কর আদায় করলেন। ধর্মাত্মা বিভীষণও বশ্যতা স্বীকার করে বিবিধ রত্ন, চন্দন, অগুরু কাষ্ঠ, দিব্য আভরণ ও মহার্ঘ বস্ত্র উপহার পাঠালেন। এইরূপে বল ও সামনীতির প্রয়োগে সকল রাজাকে করদ ক’রে সহদেব ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এসে ধর্মরাজকে সমস্ত ধন নিবেদন করলেন।

 নকুল পশ্চিম দিকে গিয়ে শৈরীষক, মহোত্থ, দশার্ণ, ত্রিগর্ত, মালব, পঞ্চনদ প্রদেশ, দ্বারপালপুর প্রভৃতি জয় করলেন। তিনি দূত পাঠালে যাদবগণসহ কৃষ্ণ বশ্যতা স্বীকার করলেন। তার পর নকুল মদ্ররাজপুর শাকলে গিয়ে মাতুল শল্যের নিকট প্রচুর ধনরত্ন আদায় করলেন এবং সাগরতীরবর্তী ম্লেচ্ছ পহ্লব ও বর্বরগণকে জয় ক’রে দশ হাজার উষ্ট্রে ধন বোঝাই করে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।

  1. যাদের কান চামড়ায় ঢাকা।