মহাভারত (রাজশেখর বসু)/সভাপর্ব/জরাসন্ধপর্বাধ্যায়

॥জরাসন্ধবধপর্বাধ্যায়॥

৫। জরাসন্ধবধ

 তার পর কৃষ্ণ বললেন, জরাসন্ধের প্রধান দুই সহায় হংস আর ডিম্ভক মরেছে, কংসকেও আমি নিহত করেছি, অতএব জরাসন্ধবধের এই সময়। কিন্তু সুরাসুরও সম্মুখযুদ্ধে তাঁকে জয় করতে পারেন না, সেজন্য মল্লযুদ্ধেই তাঁকে মারতে হবে। আমি কৌশলজ্ঞ, ভীম বলবান, আর অর্জুন আমাদের রক্ষক, আমরা তিনজন মিলে মগধরাজকে জয় করতে পারব। আমরা যদি নির্জন স্থানে তাঁকে আহ্বান করি তবে তিনি নিশ্চয় আমাদের একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। তিনি বাহুবলে দর্পিত সেজন্য আমার বা অর্জনের সঙ্গে যুদ্ধ করা অপমানজনক মনে করবেন, ভীমসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হ’তেই তাঁর লোভ হবে। মহাবল ভীম নিশ্চয় তাঁকে বধ করতে পারবেন। যদি আমার উপর আপনার বিশ্বাস থাকে, তবে ভীমার্জুনকে আমার সঙ্গে যেতে দিন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, অচ্যুত, তুমি পাণ্ডবদের প্রভু, আমরা তোমার আশ্রিত, তুমি যা বলবে তাই করব। যখন আমরা তোমার আজ্ঞাধীন তখন জরাসন্ধ নিশ্চয় নিহত হবেন, রাজারা মুক্তি পাবেন, আমার রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হবে। জগন্নাথ, তুমি আমাদের কার্য শীঘ্র নির্বাহের জন্য মনোযোগী হও। কৃষ্ণ বিনা অর্জুন অথবা অর্জুন বিনা কৃষ্ণ থাকতে পারেন না, কৃষ্ণার্জুনের অজেয় কেউ নেই। আর, তোমাদের সঙ্গে মিলিত হ’লে বীরশ্রেষ্ঠ শ্রীমান বৃকোদর কি না করতে পারেন?

 কৃষ্ণ ভীম ও অর্জুন স্নাতক[] ব্রাহ্মণের বেশ ধ’রে মগধযাত্রা করলেন। তাঁরা কুরুজাঙ্গলের মধ্য দিয়ে গিয়ে কালকূট দেশ অতিক্রম করে গণ্ডকী মহাশোণ, সদানীরা, সরযূ, চর্মন্বতি প্রভৃতি নদী পার হয়ে মিথিলায় এলেন। তার পর পূর্বমুখে গঙ্গা ও শোণ অতিক্রম ক’রে মগধ দেশে প্রবেশ করলেন এবং গিরিব্রজ নগরের প্রান্তস্থ মনোরম চৈত্যক পর্বতে উপস্থিত হলেন। এই স্থানে রাজা বৃহদ্রথ এক বৃষরূপধারী মাংসাশী দৈত্যকে বধ করেন এবং তার চর্ম আর নাড়ী দিয়ে তিনটি ভেরী প্রস্তুত করিয়ে স্থাপন করেন। কৃষ্ণ ও ভীমার্জুন সেই ভেরী ভেঙে ফেলে পর্বতের এক বিশাল প্রাচীন শৃঙ্গ উৎপাটিত ক’রে নগরে প্রবেশ করলেন।

 তাঁরা নগরের সমৃদ্ধি দেখতে দেখতে রাজমার্গ দিয়ে চললেন। এক মালাকারের কাছ থেকে মাল্য আর অঙ্গরাগ কেড়ে নিয়ে তাঁরা নিজেদের বস্ত্র রঞ্জিত করলেন এবং মাল্যধারণ ক’রে অগুরুচন্দনে চর্চিত হলেন। তার পর জনাকীর্ণ তিনটি কক্ষা (মহল) অতিক্রম ক’রে সগর্বে জরাসন্ধের কাছে এসে বললেন, রাজা আপনার স্বস্তি ও কুশল হ’ক। জরাসন্ধ তখন একটি ব্রতাচরণের জন্য উপবাসী ছিলেন। তিনি আগন্তুকদের বেশ দেখে বিস্মিত হলেন এবং পাদ্য অর্ঘ্যাদি দিয়ে সম্মান ক’রে বললেন, আপনারা বসুন। তিনজনে উপবিষ্ট হ’লে জরাসন্ধ বললেন, আপনারা মাল্যধারণ ও চন্দনাদি অনুলেপন করেছেন, রঞ্জিত বস্ত্র পরেছেন, আপনাদের বেশ ব্রাহ্মণের ন্যায় কিন্তু বাহুতে ধনুর্গুণের আঘাতচিহ্ন দেখছি। সত্য বলুন আপনারা কে। চৈত্যক পর্বতের শৃঙ্গ ভগ্ন ক’রে ছদ্মবেশে অদ্বার দিয়ে কেন এসেছেন? আমি যথাবিধি অর্ঘ্যাদি উপহার দিয়েছি, কিন্তু আপনারা তা নিলেন না কেন?

 স্নিগ্ধগম্ভীর কণ্ঠে কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, রাজা, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য তিন জাতিই স্নাতকের ব্রত নিয়ে মাল্যাদি ধারণ করতে পারে। আমরা ক্ষত্রিয় সেজন্য আমাদের বাক্যবল বেশী নেই, যদি চান তো বাহুবল দেখাতে পারি। বুদ্ধিমান লোকে অদ্বার দিয়ে শত্রুর গৃহে এবং দ্বার দিয়ে মিত্রের গৃহে যায়। আমরা কোনও প্রয়োজনে এখানে এসেছি, আপনি আমাদের শত্রু, সেজন্য আপনার প্রদত্ত অর্ঘ্য আমরা নিতে পারি না। জরাসন্ধ বললেন, আপনাদের সঙ্গে কখনও শত্রুতা করেছি এমন মনে পড়ে না। আমি নিরপরাধ, তবে আমাকে শত্রু বলছেন কেন?

 কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, ক্ষত্রিয়কুলের নেতৃস্থানীয় কোনও এক ব্যক্তির আদেশে আমরা তোমাকে শাসন করতে এসেছি। তুমি বহু ক্ষত্রিয়কে অবরুদ্ধ ক’রে রেখেছ, সৎস্বভাব রাজগণকে রুদ্রের নিকট বলি দেবার সঙ্কল্প করেছ। তোমার এই পাপকার্য নিবারণ না করলে আমাদেরও পাপ হবে। আমরা ধর্মচারী, ধর্মরক্ষায় সমর্থ। মনুষ্যবলি আমরা কখনও দেখি নি, তুমি স্বয়ং ক্ষত্রিয় হয়ে কোন্‌ বুদ্ধিতে ক্ষত্রিয়গণকে মহাদেবের নিকট পশুরূপে বলি দিতে চাও? ক্ষত্রিয়দের রক্ষার নিমিত্ত আমরা তোমাকে বধ করতে এসেছি। আমরা ব্রাহ্মণ নই, আমি হৃষিকেশ কৃষ্ণ, এঁরা দুজন পাণ্ডুপত্র। আমরা তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি, হয় বন্দী রাজাদের মুক্তি দাও, না হয় যমালয়ে যাও।

 জরাসন্ধ বললেন, কৃষ্ণ, যাকে সবলে জয় করা হয় তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করা যেতে পারে―এই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। দেবতার জন্য যাদের এনেছি ভয় পেয়ে তাদের ছেড়ে দিতে পারি না। তোমরা কিপ্রকার যুদ্ধ চাও? ব্যুহিত সৈন্য নিয়ে, না তোমাদের একজন বা দুজন বা তিনজনই আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে? কৃষ্ণ বললেন, আমাদের তিনজনের মধ্যে কার সঙ্গে তুমি যুদ্ধ করতে চাও? জরাসন্ধ ভীমসেনকে নির্বাচন করলেন।

 পরোহিত গোরোচনা মালা প্রভৃতি মাঙ্গল্য দ্রব্য এবং বেদনা ও মূর্ছা নিবারক ঔষধ নিয়ে রাজার কাছে এলেন। স্বস্ত্যয়নের পর জরাসন্ধ কিরীট খুলে ফেলে দৃঢ়ভাবে কেশবন্ধন ক’রে ভীমের সম্মুখীন হলেন। কৃষ্ণ ভীমের জন্য স্বস্ত্যয়ন করলে ভীমও যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলেন। দুই যোদ্ধা বাহু ও চরণ দ্বারা পরস্পরকে বেষ্টন ও আঘাত করতে লাগলেন এবং ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় স্তব্ধনয়নে মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। তাঁরা হস্তীর ন্যায় গর্জন ক’রে পরস্পরের কটি স্কন্ধ পার্শ্ব ও অধোদেশে প্রহার করতে লাগলেন। বহু সহস্র ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি স্ত্রীপুরুষ যুদ্ধ দেখবার জন্য সেখানে সমবেত হ’ল।

 কার্তিক মাসের প্রথম দিনে আরম্ভ হয়ে সেই যুদ্ধ অনাহারে অবিশ্রামে দিবারাত্র চলল। চতুর্দশ দিবসে রাত্রিকালে জরাসন্ধ ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ নিবৃত্ত হলেন। তখন কৃষ্ণ ভীমকে বললেন, যুদ্ধে ক্লান্ত শত্রুকে পীড়ন করা উচিত নয়, অধিক পীড়ন করলে প্রাণহানি হয়। অতএব তুমি মৃদুভাবে বাহুদ্বারা রাজার সঙ্গে যদ্ধে কর। কৃষ্ণের কথায় ভীম জরাসন্ধের দুর্বলতা বুঝলেন এবং তাঁকে বধ করবার জন্য আরও সচেষ্ট হয়ে বললেন, কৃষ্ণ, এই পাপী তোমার অনেক স্বজন নিহত করেছে, এ অনুগ্রহের যোগ্য নয়। কৃষ্ণ বললেন, ভীম, তোমার পিতা পবনদেবের কাছে যে দৈববল পেয়েছ সেই বল এখন দেখাও।

 তখন ভীম জরাসন্ধকে দুই হাতে তুলে শতবার ঘূর্ণিত ক’রে ভূমিতে ফেলে নিষ্পিষ্ট ক’রে গর্জন করতে লাগলেন এবং দুই পা ধরে টান দিয়ে তাঁর দেহ দ্বিধা বিভক্ত করলেন। জরাসন্ধের আর্তনাদ ও ভীমের গর্জন শুনে মগধবাসীরা ত্রস্ত হ’ল, স্ত্রীদের গর্ভপাত হল। তার পর জরাসন্ধের মৃতদেহ রাজভবনের দ্বারে ফেলে দিয়ে কৃষ্ণ ভীম ও অর্জুন সেই রাত্রিতেই বন্দী রাজাদের মুক্ত করলেন।

 জরাসন্ধের দিব্যরথে রাজাদের তুলে নিয়ে তাঁরা গিরিব্রজ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। এই রথ ইন্দ্র উপরিচর বসুকে দিয়েছিলেন, উপরিচরের কাছ থেকে বৃহদ্রথ এবং তার পর জরাসন্ধ পান। কৃষ্ণ গরুড়কে স্মরণ করলে গরুড় সেই রথের ধ্বজে বসলেন, কৃষ্ণ স্বয়ং সারথি হলেন। কারামুক্ত কৃতজ্ঞ রাজারা সবিনয়ে বললেন দেবকীনন্দন, আমরা প্রণাম করছি, আজ্ঞা করুন আমাদের কি করতে হবে। যে কর্ম মানুষের পক্ষে দুষ্কর তাও আমরা করতে প্রস্তুত। কৃষ্ণ তাঁদেব আশ্বস্ত ক’রে বললেন, যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ ক’রে সম্রাট হ’তে ইচ্ছা করেন, আপনারা তাঁকে সাহায্য করবেন। রাজারা সানন্দে সম্মত হলেন।

 এই সময়ে জরাসন্ধের পত্র সহদেব তাঁর পুরোহিত অমাত্য ও স্বজনবর্গের সঙ্গে এসে বাসুদেবকে কৃতাঞ্জলিপটে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ তাঁকে অভয় দিয়ে তাঁর প্রদত্ত মহার্ঘ রত্নসমূহ নিলেন এবং তাঁকে মগধের রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। অনন্তর কৃষ্ণ ও ভীমার্জুন ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এসে যুধিষ্ঠিরকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং রাজাদের যথাযোগ্য সম্মান ক’রে তাঁদের স্বরাজ্যে যেতে আজ্ঞা দিলেন। কৃষ্ণও দ্বারকায় ফিরে গেলেন।

  1. যিনি ব্রহ্মচর্য সমাপনের পর স্নান ক’রে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ করেছেন।