মহাভারত (রাজশেখর বসু)/সভাপর্ব/মন্ত্রপর্বাধ্যায়

॥মন্ত্রপর্বাধ্যায়॥

৩। কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠিরাদির মন্ত্রণা

 নারদের কথা শুনে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের বিষয় বার বার ভাবতে লাগলেন। তিনি ধর্মানসারে অপক্ষপাতে সকলের হিতসাধনে প্রবৃত্ত হলেন এবং ক্রোধ ও গর্ব ত্যাগ ক’রে কেবল এই কথাই বলতে লাগলেন―যার যা দেয় আছে তা দাও; ধর্মই সাধু, ধর্মই সাধু। প্রজারা যুধিষ্ঠিরকে পিতার তুল্য জ্ঞান করত, তাঁর শত্রু ছিল না এজন্য তিনি অজাতশত্রু নামে খ্যাত হলেন। তিনি ভ্রাতাদের উপর বিভিন্ন কর্মের ভার দিয়ে তাঁদের সাহায্যে রাজ্য শাসন ও পালন করতে লাগলেন। তাঁর রাজত্বকালে বার্ধুবী (তেজারতি), যজ্ঞকার্য, গোরক্ষা, কৃষি ও বাণিজ্যের সবিশেষ উন্নতি হ’ল। রাজকরের অনাদায়, করের জন্য প্রজাপীড়ন, ব্যাধি ও অগ্নিভয় ছিল না, রাজকর্মচারীদের মিথ্যাচার শোনা যেত না।

 যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ সম্বন্ধে তাঁর মন্ত্রী ও ভ্রাতাদের মত জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বললেন, আপনি সম্রাট হবার যোগ্য, আপনার সুহৃদ্‌বর্গ মনে করেন যে এখনই রাজসূয় যজ্ঞ করবার প্রকৃষ্ট সময়। পুরোহিত ও মুনিগণও এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। সর্বলোকশ্রেষ্ঠ জনার্দন কৃষ্ণের মত জানা কর্তব্য এই ভেবে যুধিষ্ঠির একজন দূতকে দ্রুতগামী রথে দ্বারকায় পাঠালেন, কৃষ্ণও যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা জেনে সত্বর ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন।

 কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, রাজসূয় যজ্ঞ করবার সকল গুণই আপনার আছে, তথাপি কিছু বলছি শুনুন। পৃথিবীতে এখন যেসকল রাজা বা ক্ষত্রিয় আছেন তাঁরা সকলেই পুরুরবা বা ইক্ষ্বাকু বংশধর। যযাতি থেকে উৎপন্ন ভোজবংশীয়গণ চতুর্দিকে রাজত্ব করছেন, কিন্তু তাঁদের সকলকে অভিভূত ক’রে জরাসন্ধ এখন শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন। সমস্ত পৃথিবী যাঁর বশে থাকে তিনিই সম্রাটের পদ লাভ করেন। প্রতাপশালী শিশুপাল সেই জরাসন্ধের সেনাপতি। করুষ দেশের রাজা মহাবল বক্র, করভ মেঘবাহন প্রভৃতি রাজা, এবং আপনার পিতার সখা মুর ও নরক দেশের অধিপতি বৃদ্ধ যবনরাজ ভগদত্ত, এঁরা সকলেই জরাসন্ধের অনুগত। কেবল আপনার মাতুল পুরুজিৎ―যিনি পশ্চিম ও দক্ষিণ দেশের রাজা―স্নেহবশে আপনার পক্ষে আছেন। যে দুর্মতি নিজেকে পুরুষোত্তম ও বাসুদেব ব’লে প্রচার করে এবং আমার চিহ্ন ধারণ করে, সেই বঙ্গ-পুণ্ড্র-কিরাতের রাজা পৌণ্ড্রকও জরাসন্ধের পক্ষে গেছে। ভোজবংশীয় মহাবল ভীষ্মকের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ[১] আছে, আমরা সর্বদা তাঁর প্রিয় আচরণ করি, তথাপি তিনি জরাসন্ধের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। বহু দেশের রাজারা জরাসন্ধের ভয়ে নিজ রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্মতি কংস জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তিকে বিবাহ করে শ্বশুরের সহায়তায় নিজ জ্ঞাতিদের উপর পীড়ন করেছিল, সেজন্য বলরাম ও আমি কংসকে বধ করি। তারপর আমরা আত্মীয়দের সঙ্গে মন্ত্রণা করে এই সিদ্ধান্তে এলাম যে তিন শ বৎসর নিরন্তর যুদ্ধ করেও আমরা জরাসন্ধের সেনা সংহার করতে পারব না।

 হংস ও ডিম্ভক নামে দুই মহাবল রাজা জরাসন্ধের সহায় ছিলেন। বহু বার যুদ্ধ করবার পর বলরাম হংসকে বধ করেন, সেই সংবাদ শুনে মনের দুঃখে ডিম্ভকও জলমগ্ন হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। জরাসন্ধ তখন তাঁর সৈন্যদল নিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যান, আমরাও আনন্দিত হয়ে মথুরায় বাস করতে লাগলাম। তার পর কংসের পত্নী অন্তি তাঁর পিতা জরাসন্ধের কাছে গিয়ে বার বার বললেন, আমার পতিহন্তাকে বধ করুন। তখন আমরা ভয় পেয়ে জ্ঞাতি ও বন্ধুদের সঙ্গে পশ্চিম দিকে পালিয়ে গেলাম এবং রৈবতক পর্বতের নিকট কুশস্থলীতে দুর্গসংস্কার ক’রে সেখানেই আশ্রয় নিলাম। সেই দুর্গম স্থানে দেবতারাও আসতে পারেন না এবং স্ত্রীলোকেও তা রক্ষা করতে পারে। রৈবতক পর্বত তিন যোজন দীর্ঘ, এক যোজন বিস্তৃত। আমাদের গিরিদুর্গে শত শত দ্বার আছে, আঠার জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তার প্রত্যেকটি রক্ষা করে। আমাদের কুলে আঠার হাজার ভ্রাতা আছেন। চারুদেষ্ণ, চক্রদেব, তাঁর ভ্রাতা, সাত্যকি, আমি, বলরাম এবং শাম্ব―আমরা এই সপ্ত রথী যুদ্ধে বিষ্ণুর তুল্য। এ ছাড়া কৃতবর্মা, অনাধৃষ্টি, কঙ্ক, বৃদ্ধ অন্ধকভোজ রাজা এবং তাঁর দুই পুত্র প্রভৃতি যোদ্ধারা আছেন। এঁরা সকলেই এখন বৃষ্ণি[২] গণের সঙ্গে বাস করছেন এবং পূর্ব বাসভূমি মথুরার কথা ভাবছেন।

 মহারাজ, জরাসন্ধ জীবিত থাকতে আপনি রাজসূয় যজ্ঞ করতে পারবেন না। তিনি মহাদেবের বরপ্রভাবে ছেয়াশি জন রাজাকে জয় করে তাঁর রাজধানী গিরিব্রজে বন্দী ক’রে রেখেছেন, আরও চোদ্দ জনকে পেলেই তিনি সকলকে বলি দেবেন। যদি আপনি যজ্ঞ করতে চান তবে সেই রাজাদের মুক্তি দেবার এবং জরাসন্ধকে বধ করবার চেষ্টা করুন।

 ভীম বললেন, কৃষ্ণ অর্জুন আর আমি তিন জনে মিলে জরাসন্ধকে জয় করতে পারি। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীমার্জুন আমার দুই চক্ষু; জনার্দন, তুমি আমার মন। তোমাদের বিসর্জন দিয়ে আমি কি করে জীবন ধারণ করব? স্বয়ং যমরাজও জরাসন্ধকে জয় করতে পারেন না। অতএব রাজসূয় যজ্ঞের সংকল্প ত্যাগ করাই উচিত মনে করি।

 অর্জন বললেন, মহারাজ, আমি দুর্লভ ধনু, শর, উৎসাহ, সহায় ও শক্তির অধিকারী, বলপ্রয়োগ করাই আমি উচিত মনে করি। যদি আপনি যজ্ঞের সংকল্প ত্যাগ করেন তবে আপনার গুণহীনতাই প্রকাশ পাবে। যদি শান্তিকামী মুনি হ’তে চান তবে এর পর কাষায় বস্ত্র ধারণ করবেন, কিন্তু এখন সাম্রাজ্যলাভ করুন, আমরা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করব।

৪। জরাসন্ধের পূর্ববৃত্তান্ত

 কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন ভরতবংশের যোগ্য কথা বলেছেন। যুদ্ধ না ক’রে কেউ অমর হয়েছে এমন আমরা শুনি নি। বুদ্ধিমানের নীতি এই, যে অতিপ্রবল শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করবে না; জরাসন্ধ সম্বন্ধে আমার তাই মত। আমরা ছদ্মবেশে শত্রুগৃহে প্রবেশ করব এবং তাকে একাকী পেলেই অভীষ্ট সিদ্ধ করব। আমাদের আত্মীয় নৃপতিদের মুক্তির জন্য আমরা জরাসন্ধকে বধ করতে চাই, তার ফলে যদি মরি তবে আমাদের স্বর্গলাভ হবে।

 যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, এই জরাসন্ধ কে? তার কিরূপ পরাক্রম যে অগ্নিতুল্য তোমাকে স্পর্শ করে পতঙ্গের ন্যায় পড়ে মরে নি? কৃষ্ণ বললেন. মহারাজ, জরাসন্ধ কে এবং আমরা কেন তার বহু উৎপীড়ন সহ্য করেছি তা বলছি শুনুন। বৃহদ্রথ নামে মগধদেশে এক রাজা ছিলেন, তিনি তিন অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি। কাশীরাজের দুই যমজ কন্যাকে তিনি বিবাহ করেন। বৃহদ্রথ তাঁর দই ভার্যাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দুজনকেই সমদৃষ্টিতে দেখবেন। রাজার যৌবন গত হ’ল তথাপি তিনি পুত্রলাভ করলেন না। উদারচেতা চণ্ডকৌশিক মুনি রাজাকে একটি মন্ত্রসিদ্ধ আম্রফল দেন, সেই ফল দুই খণ্ড ক’রে দুই রাজপত্নী খেলেন এবং গর্ভবতী হয়ে দশম মাসে দুজনে দুই শরীরখণ্ড প্রসব করলেন। তার প্রত্যেকটির এক চক্ষু, এক বাহু এক পদ এবং অর্ধ মুখ উদর নিতম্ব। রাজ্ঞীরা ভয়ে ও দুঃখে তাঁদের সন্তান পরিত্যাগ করলেন, দুজন ধাত্রী সেই দুই সজীব প্রাণিখণ্ড আবৃত করে বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলে। সেই সময়ে জরা নামে এক রাক্ষসী সেখানে এল এবং খণ্ড দুটিকে দেখে সুদৃশ্য করবার ইচ্ছায় সংযুক্ত করলে। তৎক্ষণাৎ একটি পূর্ণাঙ্গ বীর কুমার উৎপন্ন হ’ল। রাক্ষসী বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত ক’রে দেখতে লাগল, বজ্রতুল্য গুরুভার শিশুকে সে তুলতে পারলে না। বালক তার তাম্রবর্ণ হাতের মুঠি মুখে পুরে সজল মেঘের ন্যায় গর্জন করে কাঁদতে লাগল। সেই শব্দ শনে রাজা, তাঁর দুই পত্নী, এবং অন্তঃপুরের অন্যান্য লোক সেখানে এলেন। জরা রাক্ষসী নারীমূর্তি ধারণ করে শিশুটিকে কোলে নিয়ে বললে, বৃহদ্রথ, তোমার পুত্রকে নাও, ধাত্রীরা একে ত্যাগ করেছিল, আমি রক্ষা করেছি। তখন দুই কাশীরাজকন্যা বালককে কোলে নিয়ে স্তনদুগ্ধধারায় স্নান করালেন।

 রাজা বৃহদ্রথ জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পুত্রপ্রদায়িনী কল্যাণী পদ্মকোষবর্ণা, তুমি কে? রাক্ষসী উত্তর দিলে, আমি কামরূপিণী জরা রাক্ষসী, তোমার গৃহে আমি সুখে বাস করছি। গৃহদেবী নামে রাক্ষসী প্রত্যেক মানুষের গৃহে বাস করে, দানববিনাশের জন্য ব্রহ্মা তাদের সৃষ্টি করেছেন। যে লোক ভক্তি ক’রে গৃহদেবীকে ঘরের দেওয়ালে চিত্রিত ক’রে রাখে তার শ্রীবৃদ্ধি হয়। মহারাজ, আমি তোমার গৃহপ্রাচীরে চিত্রিত থেকে গন্ধ পুষ্প ভোজ্যাদির দ্বারা পূজিত হচ্ছি, সেজন্য তোমার প্রত্যুপকার করতে ইচ্ছা করি। এই ব’লে রাক্ষসী অন্তর্হিত হ’ল। জরা রাক্ষসী সেই কুমারকে সন্ধিত অর্থাৎ যোজিত করেছিল সেজন্য তার নাম জরাসন্ধ হ’ল।

 যথাকালে জরাসন্ধকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত ক’রে বৃহদ্রথ তাঁর দুই পত্নীর সঙ্গে তপোবনে চলে গেলেন। চণ্ডকৌশিকের আশীর্বাদে জরাসন্ধ সকল রাজার উপর প্রভুত্ব এবং ত্রিপুরারি মহাদেবকে সাক্ষাৎ দর্শনের শক্তি লাভ করলেন। কংস হংস ও ডিম্ভকের মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে জরাসন্ধের প্রবল শত্রুতা হ’ল। তিনি একটা গদা নিরেনব্বই বার ঘুরিয়ে গিরিব্রজ থেকে মথুরার অভিমুখে নিক্ষেপ করেন, সেই গদা নিরেনব্বই যোজন দূরে পতিত হয়। মথুরার নিকটবর্তী সেই স্থানের নাম গদাবসান।

  1. ভীষ্মক রুক্মিণীর পিতা, কৃষ্ণের শ্বশুর।
  2. কৃষ্ণের কুল।