মহাভারত (রাজশেখর বসু)/স্ত্রীপর্ব/স্ত্রীবিলাপপর্বাধ্যায়
॥স্ত্রীবিলাপপর্বাধ্যায়॥
৪। গান্ধারীর কুরুক্ষেত্র দর্শন—কৃষ্ণকে অভিশাপ
ব্যাসের আজ্ঞানুসারে ধৃতরাষ্ট্র ও যুধিষ্ঠিরাদি কৃষ্ণকে অগ্রবর্তী ক’রে কৌরবনারীদের নিয়ে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। রুদ্রের ক্রীড়াস্থানের ন্যায় সেই যুদ্ধভূমি দেখে নারীরা উচ্চকণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে যান থেকে নামলেন।
গান্ধারী দূর থেকেই দিব্যচক্ষু দ্বারা সেই ভীষণ রণভূমি দর্শন করলেন। তিনি কৃষ্ণকে বললেন, দেখ, একাদশ অক্ষৌহিণীর অধিপতি দুর্যোধন গদা আলিঙ্গন ক’রে রক্তাক্তদেহে শুয়ে আছেন। আমার পুত্রের মৃত্যু অপেক্ষাও কষ্টকর এই, যে নারীরা নিহত পতিগণের পরিচর্যা করছেন। লক্ষ্মণজননী দুর্যোধনপত্নী মস্তকে করাঘাত ক’রে পতির বক্ষে পতিত হয়েছেন। আমার প্রতিপুত্রহীনা পুত্রবধূরা আলালায়িতকেশে রণভূমিতে ধাবিত হচ্ছেন। মস্তকহীন দেহ এবং দেহহীন মস্তক দেখে অনেকে মূর্ছিত হয়ে প’ড়ে গেছেন। ওই দেখ, আমার পুত্র বিকর্ণের তরুণী পত্নী মাংসলোভী গৃধ্রদের তাড়াবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। কৃষ্ণ, তুমি নারীদের দারুণ ক্রন্দনের নিনাদ শোন। শ্বাপদগণ আমার পুত্র দুর্মুখের মুখমণ্ডলের অর্ধভাগ ভক্ষণ করেছে। কেশব, লোকে যাঁকে অর্জুন বা তোমার চেয়ে দেড়গুণ অধিক শৌর্যশালী বলত সেই অভিমন্যুও নিহত হয়েছেন, বিরাটদুহিতা বালিকা উত্তরা শোকে আকুল হয়ে পতির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। উত্তরা বিলাপ ক’রে বলছেন, বীর, তুমি আমাদের মিলনের ছ মাস পরেই নিহত হ’লে! ওই দেখ, মৎস্যরাজের কুলস্ত্রীগণ অভাগিনী উত্তরাকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হায়, কর্ণের পত্নী জ্ঞানশূন্য হয়ে ভূতলে প’ড়ে গেছেন, শ্বাপদগণ কর্ণের দেহের অল্পই অবশিষ্ট রেখেছে। গৃধ্র ও শৃগালগণ সিন্ধুসৌবীররাজ জয়দ্রথের দেহ ভক্ষণ করছে, আমার কন্যা দুঃশলা আত্মহত্যার চেষ্টা করছে এবং পাণ্ডবদের গালি দিচ্ছে। হা হা, ওই দেখ, দুঃশলা তার পতির মস্তক না পেয়ে চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। ওখানে ঊর্দ্ধরেতা সত্যপ্রতিজ্ঞ ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে আছেন। দ্রোণপত্নী কৃপী শোকে বিহ্বল হয়ে পতির সেবা করছেন, জটাধারী ব্রাহ্মণগণ দ্রোণের চিতা নির্মাণ করছেন। কৃষ্ণ, ওই দেখ, শকুনিকে শকুনগণ বেষ্টন ক’রে আছে, এই দুর্বুদ্ধিও অস্ত্রাঘাতে নিধনের ফলে স্বর্গে যাবেন!
তার পর গান্ধারী বললেন, মধুসূদন, তুমি কেন এই যুদ্ধ হ’তে দিলে? তোমার সামর্থ্য ও বিপুল সৈন্য আছে, উভয় পক্ষই তোমার কথা শুনত, তথাপি তুমি কুরুকুলের এই বিনাশ উপেক্ষা করেছ, তোমাকে এর ফল ভোগ করতে হবে। পতির শুশ্রূষা ক’রে আমি যে তপোবল অর্জন করেছি তার দ্বারা তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি — তুমি যখন কুরু-পাণ্ডব জ্ঞাতিদের বিনাশ উপেক্ষা করেছ, তখন তোমার জ্ঞাতিগণকেও তুমি বিনষ্ট করবে। ছত্রিশ বৎসর পরে তুমি জ্ঞাতিহীন অমাত্যহীন পুত্রহীন ও বনচারী হয়ে অপকৃষ্ট উপায়ে নিহত হবে। আজ যেমন ভরতবংশের নারীরা ভূমিতে লণ্ঠিত হচ্ছে, তোমাদের নারীরাও সেইরূপ হবে।
মহামনা বাসুদেব ঈষৎ হাস্য করে বললেন, দেবী, আপনি যা বললেন তা আমি জানি; যা অবশ্যম্ভাবী তার জন্যই আপনি অভিশাপ দিলেন। বৃষ্ণিবংশের সংহারকর্তা আমি ভিন্ন আর কেউ নেই। যাদবগণ মানুষ ও দেবদানবের অবধ্য, তাঁরা পরস্পরের হস্তে নিহত হবেন। কৃষ্ণের এই উক্তি শুনে পাণ্ডবগণ উদ্বিগ্ন ও জীবন সম্বন্ধে নিরাশ হলেন।