রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ/১৩
(১৩)
দ্বিতীয় ধর্ম্মমাণিক্য
১৭১৬ খৃষ্টাব্দে মহেন্দ্রমাণিক্য সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁহার রাজত্বকাল দুই বৎসরেরও কম। ভ্রাতাকে বধ করিয়া মহেন্দ্রের মনে সুখ ছিল না, বিধাতার অভিসম্পাতে তাঁহার জীবনের দিনগুলি নানা বিভীষিকায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। খাইতে গেলে মুখে অন্ন রোচে না, শুইলে দুঃস্বপ্নে নিদ্রা দুঃখকর ঠেকে এবং জাগরণে নিদ্রায় তাঁহার মনে হইত তাঁহাকে যেন কে গলা চাপিয়া ধরিতেছে! রত্নমাণিক্যকে গলা চাপিয়া মারা হইয়াছিল। হায় রাজ্যলোভ! ইহার জন্য কত অনর্থই না হইয়াছে! কর্ম্মের ফল অবশ্যম্ভাবী জানিয়াও জীবনের কয়েকটি বৎসর মানুষ সুস্থির হইয়া কাটাইতে পারে না। দুই বৎসর মাত্র রাজত্ব করিয়া দুষ্কৃতি-পাংশুলচিত্তে মহেন্দ্রমাণিক্য কালপ্রাপ্ত হইলেন।
ভ্রাতার মৃত্যুর পর ১৭১৮ খৃষ্টাব্দে কনিষ্ঠ ভ্রাতা দুর্য্যোধন ধর্ম্মমাণিক্য নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসন আরোহণ করেন। তাঁহার দুই পুত্র গঙ্গাধর ঠাকুর এবং গদাধর ঠাকুর বর্ত্তমানেও তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতা চন্দ্রমণি ঠাকুরকে যৌবরাজ্য প্রদান করেন। অনন্তরাম উজীর এবং রণভীম ছিলেন সেনাপতি। অমরমাণিক্যের কালে উদয়পুর জয় করার ফলে রাজধানীতে মঘ বসতি হইয়াছিল। সেই হইতে মঘবংশ বর্দ্ধমান হইয়া উদয়পুরের অনেকাংশ জুড়িয়া রহিল। ইহারা অকুতোভয়ে চলাফেরা করিত এবং রাজশাসনও উপেক্ষার চক্ষে দেখিত। সেইজন্য ইহাদিগকে ভোজনের কৌশল অবলম্বনে ধ্বংস করা হয়।
মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য আওরঙ্গজেব বাদসাহের সহিত হস্তি-কর মূলক সন্ধি করিয়াছিলেন। সেই সর্ত্ত ধর্ম্মমাণিক্য হাতী নজরানা পাঠাইতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি ইহাতে শৈথিল্য প্রদর্শন করিয়া কর প্রেরণ স্থগিত রাখিলেন। ইহাতে নবাবের বিরক্তির সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। ধর্ম্মমাণিক্যের প্রতিনিধি মুর্শিদাবাদের নবাব দরবার হইতে পুনঃ পুনঃ এ বিষয় স্মরণ দিতে লাগিলেন কিন্তু মহারাজের চৈতন্য হইল না। এ বিষয় জানিতে পারিয়া নক্ষত্ররায়ের প্রপৌত্র জগৎরাম ঢাকার নবাবের নিকট দরবার সুরু করিলেন। তিনি বলিলেন যদি তাঁহাকে রাজাসনে বসাইয়া দেওয়া হয় তবে তিনি হস্তি-কর চুকাইয়া দিবেন। ইহাতে নবাব সম্মত হইয়া জগৎরামকে সৈন্য সাহায্য দিলেন, ধর্ম্মমাণিক্যের সহিত বল পরীক্ষা করিতে গিয়া জগৎরামের হার হইল। এ সংবাদ শুনিয়া নবাব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন ত্রবং নূরনগর ও গোমতী নদী এই দুই পথে দুই ফৌজ পাঠাইয়াছিলেন।
নবাব সৈন্যের গতিরোধে অসমর্থ হইয়া ধর্ম্মমাণিক্য অরণ্যে গা ঢাকা দিলেন। এদিকে নবাবের সৈন্য উদয়পুর লুট করিয়া রাজমঙ্গল প্রভৃতি হস্তী লইয়া ঢাকা চলিয়া আসিল। রাজমালায় যুদ্ধের ফলে জগৎমাণিক্যের কি লাভ হইয়াছিল তাহার উল্লেখ নাই। কৈলাস সিংহ প্রণীত ইতিহাসে এইরূপ লেখা হইয়াছে—“ঢাকা নেয়াবতের সুবিখ্যাত দেওয়ান মির হবিব জগৎরাম ঠাকুরকে ‘রাজা জগৎমাণিক্য’ আখ্যা প্রদান পূর্ব্বক ত্রিপুরার রাজা বলিয়া প্রচার করেন। প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র সমতলক্ষেত্র জগৎমাণিক্যের অধিকারভুক্ত হইয়াছিল। নবাব সুজাউদ্দিন ত্রিপুরার সমতলক্ষেত্রকে ‘চাকলে রোশনাবাদ’ আখ্যা প্রদান পূর্ব্বক বার্ষিক ৯২,৯৯৩ টাকা কর ধার্য্য পূর্ব্বক জগৎমাণিক্যকে জমিদারী স্বরূপ ইহা প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু উক্ত রাজস্ব মধ্যে পরগণে নূরনগরের বার্ষিক রাজস্ব ২৫,০০০ টাকা, দিল্লীর সম্রাটের পূর্ব্ব আদেশ মত সামরিক জায়গীর এবং হস্তী ধৃত করিবার খরচ বাবত ২০,০০০; মোট ৪৫,০০০ টাকা বাদে ৪৭,৯৯৩ টাকা আদায়ী রাজস্ব নির্ণীত হয়। রাজা জগৎমাণিক্যকে রক্ষা করিবার জন্য কুমিল্লা নগরে একদল মোগল সৈন্য স্থাপিত হইয়াছিল। আকাসাদেক তৎকালে ত্রিপুরার ‘ফৌজদার’ পদে নিযুক্ত হন।”
ধর্ম্মমাণিক্য যখন বনান্তরালে গা ঢাকা দেন তখন তাঁহার সঙ্গে চল্লিশ হাজার টাকা ছিল। এ অবস্থায় আর কতদিন অবস্থান করিবেন? পরামর্শ ক্রমে মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দিনের সহিত সাক্ষাৎ করাই স্থির হইল। মহারাজ মুর্শিদাবাদে চলিয়া আসিলেন। নবাবের দরবারে খ্যাতিমান পুরুষ জগৎশেঠের সহিত আলাপক্রমে নবাবের নিকট মহারাজের বক্তব্য জানান হইল। নবাব মহারাজকে যাচাই করিবার জন্য এক অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করিলেন। জগৎশেঠকে বলিলেন—“ত্রিপুরার মহারাজের রাজোচিত চক্ষু কিরূপ আছে আমি দেখিতে চাই। ভাল তলোয়ার মন্দ খাপে আর মন্দ তলোয়ার ভাল খাপে রাখ, বহুমূল্য রত্নাঙ্গুরীয়ে মন্দ রঙ্ দিয়া মলিন করিয়া দাও, আর অল্প মূল্যের রত্নাঙ্গুরীয়ে উজ্জ্বল রঙ ফলাও, তারপর মহারাজকে পৃথক পৃথক দর জিজ্ঞাসা কর।” নবাবের অভিপ্রায় অনুযায়ী জিনিষগুলি সাজান হইল, মহারাজ আসিয়া ইহাদের উপর চোখ বুলাইয়া ব্যাপার বুঝিলেন। তখন একটু হুঁস রাখিয়া মহারাজ দাম বলিয়া যাইতে লাগিলেন, যাহা বলিলেন সকলই যথার্থ হইল। নবাব অত্যন্ত প্রীত হইয়া ধর্ম্মমাণিক্যকে খিলাত প্রদান করিলেন। জগৎমাণিক্যের শাসন রহিত হইল এবং কুমিল্লা হইতে মোগল ফৌজ উঠিয়া গেল।
“নবাব কেবল চাকলে রোশনাবাদের বার্ষিক পঞ্চ সহস্ৰ মুদ্রা রাজস্ব অবধারণপূর্ব্বক, জমিদারী স্বরূপ তাহা ধর্ম্মমাণিক্যকে অর্পণ করিবার জন্য ঢাকার শাসনকর্ত্তার প্রতি আদেশ প্রচার করেন, তদনুসারে মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্য চাকলে রোশনাবাদের জন্য বাঙ্গালার নবাবের অধীনস্থ জমিদার শ্রেণীতে সন্নিবিষ্ট হন। ষ্টুয়ার্ট প্রভৃতি ইংরেজ ইতিহাস লেখকগণ আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছেন, স্মরণাতীত কাল হইতে যে ত্রিপুরা স্বাধীন পতাকা উড্ডীন করিয়া আসিতেছিলেন, অদ্য তাহা মোগলের পদানত হইল।[১] কিন্তু আমাদের হর্ষ বিষাদের কারণ এই যে তৎকালে পার্ব্বত্য প্রদেশের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয় নাই। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টও পার্ব্বত্য ত্রিপুরাকে ‘স্বাধীন ত্রিপুরা’ বলিয়া মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন।”[২] ধর্ম্মমাণিক্য সসম্মানে স্বরাজ্যে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার শেষকাল নানাবিধ সৎকীর্ত্তিতে উজ্জ্বল হইয়া আছে। তিনি মেহেরকুল, ছত্রগ্রাম, কসবা ও ধর্ম্মপুর নামক স্থানে নিজ নামে সাগর খনন করান এবং তিল, ধেনু ও তুলাপুরুষাদি নানাবিধ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান যথারীতি সম্পন্ন করেন। তিনি অষ্টাদশ পুরাণ পাঠ শ্রবণে প্রীতি লাভ করেন। আঠার বৎসর রাজত্ব করিয়া কণ্ঠে দুর্গা নাম জপিতে জপিতে ১৭৩৬ খৃষ্টাব্দে মহারাজ পরলোক গমন করেন। ধর্ম্মমাণিক্যের শাসনে ত্রিপুরা রাজ্যের সমতল অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া জমিদারীরূপে পরিগণিত হয়।
- ↑ The province of Tippera, which from time immemorial had been an independent kingdom became annexed to the Mugal Empire. Stewart’s History of Bengal, P. 267.
- ↑ কৈলাস সিংহ প্রণীত রাজমালা, পৃঃ ১০৬।