সাহিত্যে প্রগতি/সাহিত্যে সমাজ-চিত্র (১)

সাহিত্যে সমাজ-চিত্র

(১)

আজও এদেশে এরূপ একটা ধারণা আছে যে সাহিত্য কেবল অলঙ্কার ও কাব্যের ব্যাপার; উহা কেবল কবি বা লেখকের হৃদয়োচ্ছ্বাসের সহিত জড়িত। লেখক কেবল Art for art’s sake গল্পে মানব চরিত্র ফুটাইয়া তোলেন। সাহিত্যের সহিত পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অর্থাৎ অর্থনীতিক কারণ ঘটিত রাজনীতিক, সামাজিক কার্য্যকারণের কোন সম্বন্ধ নাই। কিন্তু তাঁহারা এই কথা স্বীকার করিতে চাহেন না যে, সাহিত্য ইতিহাসের অর্থনীতিক ব্যাখ্যার (Dialectical Materialism) অধীন; এবং তজ্জন্য সাহিত্যে সমকালীন সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়। আমাদের দেশে প্রাচীনকাল হইতেই সাহিত্যের স্বরূপ কি, উহার লক্ষণ কি— এগুলি সম্পর্কে সকলের ধারণা বোধ হয় এক নয়। সাহিত্যে যে সমাজের চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়—এই বিষয়ে এখন দ্বি-মত নাই। এইজন্যই কোনও একটী দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা, দেশের লোকের রাজনীতিক, সামাজিক ও কৃষ্টিগত অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান সমূহ সম্বন্ধে তথ্যাদি জানিতে হইলে আলোচ্য দেশের অধিবাসীদের সাহিত্যপাঠে উহা অন্ততঃ কথঞ্চিৎ অবগত হওয়া যায়। সুতরাং যে-জাতির কোন যুগের লিখিত ইতিহাস থাকে না তাহাদের সাহিত্যের ভিতর দিয়া সেই যুগের ইতিহাসের সংবাদ পরিষ্কার করা সম্ভব হয়। হোমারের “ইলিয়াডে” গ্রীকদের বর্ব্বর যুগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ইতিহাসের সন্ধান মিলে; আমাদের প্রাচীন বর্ব্বর যুগের কৌমাবস্থার সংবাদ বেদে পাওয়া যায়, মহাভারতে সামন্ততান্ত্রিক যুগের চিত্র চিত্রিত হইতে দেখা যায় এবং হালের সোভিয়েট রুষের সাহিত্যে তথাকার বর্তমান প্রলেটারিয়েট (Proletariate) সমাজের ছবির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এইখানেই বোধ হয় কাহারও মনে খটকা বাঁধে! কেহ কেহ হয়তো আপত্তি উত্থাপন করিয়া বলিবেন যে সমাজের আবার বর্ব্বর ও সভ্য অবস্থা কি, কৌমগত ও সামন্ততান্ত্রিক যুগ কি? সমাজ তো অখণ্ড; ইহার মধ্যে কৌমাবস্থার (Tribal stage) সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং প্রলেটারিয়েট সমাজ কি? এই অখণ্ড সমাজের ধারাও সনাতন, তাহার আবার বিভিন্ন যুগই বা কি?

মানব সভ্যতা বিভিন্নযুগের ভিতর দিয়া অগ্রসর হয়। তাহার উন্নতি কখন বিবর্ত্তন, কখন আবর্ত্তন দ্বারা সংঘটিত হইয়া থাকে। সমাজ কখনও স্থানুবতৎ স্থিতিশীল নহে; কাজে কাজেই সনাতন ধারা বলিয়া কোন অনুষ্ঠান সমাজতত্ত্বের মধ্যে স্থান পায় না। ইহা ভিন্ন সমাজও অখণ্ডও নহে। যাহারা Social–Unitarian, অর্থাৎ সামাজিক একত্ববাদীয় মত পোষণ করেন তাহাদের নিকট এই সকল তত্ত্ব অত্যন্ত অপ্রিয়। কিন্তু জাতিতত্ত্ব বলে যে, মানবজাতির অর্থনীতিক অবস্থার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাহার সামাজিক পরিবর্ত্তনও সংঘটিত হয়। যে আদিম মানব বনের ফলমূল ও নদীর শামুক, গুগলী আহরণ করিয়া উদর পূর্ণ করিত এবং গিরি-গহ্বরে অবস্থান করিত, তাহাদেরই বংশধরেরা যখন জগতে “সপ্তাশ্চর্য্য” নির্ম্মাণ করে তখন উভয়ের অর্থনীতিক অবস্থার বিশেষ পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। যে ভারতের অতি প্রাচীনকালের মৃত দেহকে জালায় ভরিয়া সমাহিত করা হইত, সেই দেশের লোক যখন তাজমহল সমাধি-মন্দির নির্ম্মান করে, তখন উভয় লোক সমষ্টির মধ্যে যে অর্থনীতিক তারতম্য ঘটিয়াছে তাহা অস্বীকার করিবার আর কোন উপায় নাই। অর্থনীতিক তারতম্য ঘটিলে যে সামাজিক, তজ্জন্য কৃষ্টিগত বিভিন্নতা উপস্থিত হয়—ইহা জাতিতত্ত্ব ও সামাজতত্ত্ববিদগণ স্বীকার করেন। সুতরাং সনাতন পদ্ধতি ও ধারা বলিয়াও কোন সামাজিক সূত্র নাই, এবং থাকিতে পারে না। সমাজ-তত্ত্ব বলে, মানবসমাজের মধ্যে আর্থিক উন্নতি, তজ্জন্য কৃষ্টির উৎকর্ষ সমাজের একটা লোকসমষ্টির ভোগের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়, অর্থাৎ যে লোকসমষ্টি রাষ্ট্রের পরিচালকরূপে বিদ্যমান থাকে তাহারাই সেই ক্ষমতার জন্য সমাজের শীর্ষদেশে অবস্থিত থাকে এবং সর্ব্বপ্রকার সুখসমৃদ্ধির ভোগ দখল করিতে থাকে। এই জন্য বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন স্তরের সৃষ্টি হয় এবং এই বিভিন্ন স্তর অর্থনীতিক অবস্থার বৈষম্য ও বিভিন্নতা হেতু রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রকার অধিকারসমূহ ভোগ করে,— তজ্জন্য সমাজেও বৈষম্য এবং তারতম্যের সৃষ্টি হয়। কাজেই বলিতে হয় যে, সমাজ একটি অখণ্ড বস্তু নহে; ইহাতে নানাপ্রকার স্তরভেদ রহিয়াছে— আবার ইহার মধ্যে চক্রভেদও আছে। এই সকল কারণ বশতঃ সমাজের কোন একটি লোকসমষ্টি বা একটি স্তর অথবা তাহার একটি চক্র বা মণ্ডলী, রাষ্ট্রের অন্তর্গত গোটা সমাজের প্রতীক বা প্রতিনিধি নহে।

এইরূপে বিভক্ত সমাজের কৃষ্টিগত আদর্শ এবং ফলও এক নহে। কৃষ্টি উহার স্রষ্টার মনস্তত্ত্ব প্রকাশ করে।সমাজ যখন শিক্ষাদীক্ষা, চর্চ্চা ও আদর্শে এক নহে তখন কৃষ্টিও এক হইতে পারে না।যে–বস্তুকে আমরা একটা দেশের পরিচায়ক হিসাবে গণ্য করি তাহার একটু অনুসন্ধান করিলেই পরিষ্কার দেখিতে পাওয়া যাইবে যে উহা যুগ ও স্তরভেদ দোষে দুষ্ট। এই কারণেই সমাজের প্রত্যেক স্তরের কৃষ্টি ভিন্ন এবং তাহার প্রতীকও বিভিন্ন। ইতিপূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে, সাহিত্যে সমাজের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়। কিন্তু সমাজ যখন এক অবিভক্ত অখণ্ড বস্তু নহে, বরং স্তরভেদে বিভক্ত তখন সাহিত্যেও অনুরূপ প্রতিবিম্বই প্রতিফলিত হইতে দেখা যাইবে। এইজন্য সাহিত্য সমাজের এক অখণ্ডরূপের পরিচয় প্রদান করে না; সাহিত্যে সমাজের স্তর বা শ্রেণীগত মনস্তত্ত্বই প্রকাশ পাইয়া থাকে ।

সমাজ শ্রেণীভেদে বিভক্ত হইয়া একটি বিশিষ্ট-শ্রেণী দ্বারা শাসিত হয় এবং কৃষ্টি সেই শ্রেণীরই স্বরূপ প্রদর্শন করে। সেইজন্য সাহিত্য একটা দেশের গোটা সমাজের প্রতীক না হইয়া একটা বিশেষ শ্রেণীর প্রতিভূ স্বরূপ হয়। অতএব সাহিত্যকে “শ্রেণীগত সাহিত্য” (Class literature) বলা হয় । অর্থাৎ সাহিত্য সেই শ্রেণীর কৃষ্টি, আদর্শ ও মনস্তত্ত্ব প্রকাশ করে, যে শ্রেণী রাষ্ট্রের শাসকরূপে অধিষ্ঠিত থাকে। এখানে প্রশ্ন উঠে―এরূপ হয় কেন? ইহার কারণ এই যে, লেখক সমাজগত ভাবে যে-স্তর বা শ্রেণীর মধ্য হইতে উদ্ভূত হইয়াছেন এবং যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে প্রতিপালিত ও পরিবদ্ধিত হইয়া তাহারই ভাবধারা ও আদর্শকে সনাতন বা শাশ্বত বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন তাঁহাদের লেখনীমুখে সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলেখ্যই ফুটিয়া উঠিবে, তাঁহাদের রচনাবলীর মধ্যে ঐ শ্রেণীরই ভাব ও আদর্শ বিজ্ঞাপিত হইবে। লেখকের লেখা তাঁহার জাতীয় কৃষ্টির একাংশ মাত্র; কিন্তু কৃষ্টি আপেক্ষিক— তাহা যুগ ও শ্রেণীর প্রভাবে প্রভাবিত। এইজন্য সাহিত্যিকের রচনা যুগ ও শ্রেণীগত আদর্শের সহিত এক ও অভিন্ন (identified) হইয়া থাকে।

এতদ্বারা পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে সাহিত্য শ্রেণীগত; ইহাকে বিশ্লেষণ করিলে শ্রেণীগত আদর্শই প্রকাশ পায় এবং তাহা সমাজের সমস্ত লোকের মনোগত ভাবসমূহের পরিচায়ক নহে। ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন হইল হোমারের ইলিয়াড (Iliad) ও ওডিসী (Odyssey); তাহাতে গ্রীকজাতির আদিম যুগের কৌমগত অবস্থার চিত্র দেখিতে পাওয়া যায় না। বরং তাহাতে অর্থনীতিক, রাজনীতিক ও সামন্ততান্ত্রিক যুগের আচার ব্যবহার, অনুষ্ঠানসমূহ প্রতিবিম্বিত হইতে দেখা যায়। হোমারে একদিকে যেমন আদিম সমাজের আলেখ্য দেখা যায় না, তেমনি গরীব ও অধস্তন শ্রেণীর লোকদের চিত্রও তাহাতে দেখা যায় না। অবশ্য যুদ্ধের কয়েদী, গোলাম অথবা ক্রীতদাসের সংবাদ হোমারে পাওয়া যায়, কিন্তু তাহাদের সমাজের ও মনস্তত্ত্বের প্রতীক ইলিয়াড়্ বা ওডিসী নয়। এই দুই মহাকাব্য সামন্ত্রতান্ত্রিক যুগের বীরগণের সমাজের ও তাহাদের কীর্ত্তিকলাপ এবং আদর্শের আলেখ্য প্রকাশ করে। ইহাতে অন্যান্য শ্রেণীর সুখদুঃখের সংবাদ পাওয়া যায় না। এইরূপে ওডিসীর আদর্শে লিখিত রোমান ভাজ্জিলের ইলিয়াড্ মহাকাব্য ও টেরেন্স প্রভৃতির কবিতায় রোমের শাসক-শ্রেণীর পরিচয় পাওয়া যায়; তাহাতে রোমান সাম্রাজ্যের “জন” বা “গণে”র কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। অনুদিকে পালেষ্টিনের ইহুদী জাতির সুখ-সমৃদ্ধির সময়ে ‘গণে’র প্রতিনিধিত্ব করিয়া ইজিথিয়েল, জেরেমিয়া, মালেখি প্রভৃতি কয়েকজন পয়গম্বর বড় সোরগোল উপস্থিত করেন। তৎকালীন ইহুদী সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্বের পরিচয় এই সকল পয়গম্বরদের লেখনী ও বচনের ভিতর দিয়া প্রকাশ পাইয়া অবশেষে বাইবেলে লিপিবদ্ধ হইয়াছে।

ইউরোপের মধ্যযুগে যখন সভ্যতা আবার মাথা তুলিয়া উঠিতে লাগিল তখন দেখা যায় যে পশ্চিম ইউরোপের রাজদণ্ড উত্তরাগত অসভ্য জার্ম্মাণ জাতীয় ফ্রাঙ্কদের হাতে চলিয়া গিয়াছে। তাহারা “পবিত্র রোমক সাম্রাজ্য” নাম দিয়া প্রাচীন রোমের উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিত। এইজন্য পশ্চিম ইউরোপের নেতৃত্ব তাহাদের হাতে দিলেও তাহাদের আদর্শে পরিচালিত হইত। ইহারা অর্থনীতিক ভিত্তিতে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া রাজনীতি পরিচালনা করিত।

এই যুগের সাহিত্যে সামন্ততান্ত্রিক লক্ষণসমূহ— যেমন স্বামিধর্ম্ম (noblesse oblige), বীরধর্ম্ম (chivalry) ও সমাজের শ্রেণীভেদ, বৈরী (blood–feud) প্রভৃতি বিশেষভাবে চিত্রিত হইতে দেখা যায়। এই সামন্ততান্ত্রিক যুগের বড় সাহিত্যিক দল ছিল দক্ষিণ ফ্রান্সের চারণদল (Troubadours); ইহাদের মধ্যে নরমান্ডীর ডিউক ও ইংলণ্ডের রাজা দ্বিতীয় রবার্টের চারণ রোঁলা (Rolland) ছিল অগ্রণী। রোলাঁর মুখ দিয়া সামন্ততন্ত্রকে সমাজের আদর্শ বলিয়া জাহির করা হয়। তিনি বলিতেন— “বশ্যতা স্বীকারকারী প্রজার কর্ত্তব্য হইতেছে তাহার মনিবের জন্য যুদ্ধ করা” (It is the duty of the liegeman to fight for his liegelord)। এই স্বামিধর্ম্ম ও স্ত্রীলোকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ছিল সামন্ততান্ত্রিকযুগীয় রাষ্ট্রের লোকের আদর্শ। কিন্তু Troubadours-দের মুখ দিয়া তৎকালীন “জন” (Third Estate) ও “গণ” (Serfs) শ্রেণীদের কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। তখনকার ইউরোপীয় সমাজের অধিকাংশ লোকই ছিল নিম্নশ্রেণীর—তাহারা হয় গোলাম, না হয় অর্দ্ধ-গোলাম; সার্ফ, না হয় স্বাধীনতাপ্রাপ্ত গোলাম বা সার্ফের পুত্র জনশ্রেণীর বুর্জ্জোয়া। ইহারা কেহই রাষ্ট্রের অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক ছিল না। তৎকালীন সমাজে অভিজাতশাসনের যুগ— তাহাদিগকে লইয়াই সমাজ; কৃষ্টিও তাহাদিগের কীর্ত্তিকলাপেরই পরিচায়ক ছিল। সদ্যজাত “জন” ও সংখ্যাগরিষ্ঠ “গণে”র সন্ধান মধ্যযুগীয় সাহিত্যে পাওয়া যায় না।

অর্থনীতিক কারণ বশতঃ যখন সামন্ততন্ত্র ভাঙ্গিয়া যথেচ্ছাচারী রাজাদের (National Monarch) দ্বারা শাসনকার্য্য পরিচালন ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হইতে থাকে তখন ইংরেজ ও ফরাসী সাহিত্যে তাহার প্রতিবিম্বস্বরূপ অভিজাতদের বীরত্ব জাতীয় কীর্ত্তিকলাপের একাংশ বলিয়া পড়া হইয়া থাকে। সেক্সপীয়রের বিজয়ী নর্ম্মানদের সন্তান-সন্ততিগণকে অভিজাতরূপে বর্ণিত ও পরিচিত হইতে দেখা যায়, এবং তাহাদের বীরত্ব ও কীর্ত্তিকলাপ ইংরাজের কীর্ত্তিকলাপের পরিচায়ক বলিয়াই পঠিত হয়। সেক্সপীয়র যখন Henry V নামক নাটকে একজন ফরাসী অভিজাতের মুখ দিয়া ইংরেজ আক্রমণকারীদের— “Oh, ye Bastard Frenchmen, Oh, ye traitors” বলিয়া গালি দেওয়াইতেছেন তখন ইংলণ্ডবিজয়ী ফরাসী ও নর্ম্মান ব্যারণদের ইংলণ্ডের স্বার্থের সহিত অভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট বংশধরদেরই ফ্রান্সের স্বার্থের পরিপন্থী বলিয়া ভৎসিত ও তিরস্কৃত করিয়াছেন। সেই সময় ফ্রান্স অর্থে অন্ধকার যুগে অসভ্য জার্ম্মানজাতীয় ফ্রাঙ্ক কৌমের (tribe) লোকদের বংশধরগণ এবং ইংলণ্ড বলিলে তাহার বিজেতাদের বংশধরগণকে বুঝাইত। সেক্সপীয়রে একটা দেশের রাজনীতিক ক্রমবিকাশের সেই যুগের চিত্র দেখিতে পাওয়া যায় যখন ইউরোপে National Monarch (জাতীয় রাজা) প্রথা বিবর্ত্তিত হইতেছে। তখন ইংলণ্ডের রাজা ফরাসী রাজার একজন সামন্ত এবং Plantagenet বংশীয় হইলেও তিনি আর ফরাসী নহে, তিনি ইংরেজদের রাজা ও তাঁহার সমশ্রেণীয় (peers) অভিজাতগণও আর ফরাসী বংশোদ্ভব নহে, তাঁহারা ইংরেজ। এই সকল লোকদের স্বার্থই ইংলণ্ডের স্বার্থ।

এই চিত্র দ্বারা সেক্সপীয়র দেখাইলেন যে, বিদেশাগত বিজেতাদের সন্তানেরা আর ইংলণ্ডের পর নয়, তাহারা এখন খাঁটি ইংরেজ। “Mary I” নাটকে কবি স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের মুখ দিয়া তাঁহার স্ত্রী ইংলণ্ডের রাণী প্রথম মেরীকে ভর্ৎসনা করাইতেছেন যে, রাণীর অ্যাডমির্য্যাল Lord Effingham স্পেনীয় নৌ-বেড়ার উপর গুলি বর্ষণ করিয়াছিল। প্রত্যুত্তরে রাণী বলেন— “He is an Englishman”। ইতিহাসাভিজ্ঞেরা অবগত আছেন যে, স্পেনের রাজা ফিলিপ ইংলণ্ডের রোমান ক্যাথলিকদের সহায়তায় সেই দেশ জয় করিয়া তথায় ক্যাথলিক ধর্ম্মের পুনঃ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করিয়া সত্যধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন। কিন্তু অ্যাডমিরাল এফিংহাম রোমান ক্যাথলিক হইয়াও রোমান ক্যাথলিক স্পেনীয়দের সহিত যোগদান করেন নাই। কারণ তিনি প্রথমেও একজন ইংরেজ—শেষেও একজন ইংরেজ! এই দৃষ্টান্ত দ্বারা করি দেখাইয়াছেন যে, পশ্চিম ইউরোপে ও অন্ততঃ ইংলণ্ডে অন্ধকার যুগ (Dark Age) ও সামন্ততান্ত্রিক যুগের (Feudal Age) সমাজ আর নাই এবং সে আদর্শও আর এখন নাই! এই সব যুগে জনসাধারণ ধর্ম্মের বৈশিষ্ট্য দ্বারাই আপনাদের পরিচয় প্রদান করিত। এক মূলজাতীয় (Race); এক ভাষাভাষী হইলেও লোক তখন ধর্ম্মের বিভিন্নতা হেতূ একে অন্যকে পর ভাবিত; কিন্তু ইংলণ্ডে সেই মনোবৃত্তি ও সেই আদর্শ তখন অন্তর্হিত হইয়াছে। এইজন্যই ক্যাথলিক এফিংহাম ক্যাথলিক স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে এবং দ্বিতীয় ফিলিপ ইংলণ্ডের রাণীর স্বামী হইলেও ইংলিশ চ্যানেল (English Channel) দিয়া যাইবার সময় ইংলণ্ডের রাজকীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন নাই। এইজন্যই এফিংহাম ফিলিপের কোন খাতির না রাখিয়া তাহার পতাকার উপর গুলি চালাইয়াছিল। এই নাটকে এবং এই চিত্রে কবি ইংলণ্ডের রাজনীতিক-সমাজনীতির সেই অবস্থায়ই প্রদর্শন করিয়াছেন যখন ধর্ম্ম রাজনীতিক জীবনে পরস্পরকে আর বিচ্ছিন্ন করে না। তখন একটা জাতীয় রাজার (National Monarch) অধীনে সকলে একত্রিত হইয়াছে এবং বিভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বী হইলেও অভিজাতেরা সমস্বার্থে একত্র হইয়াছে। অবশ্য সেক্সপীয়রে “জন” ও “গণের” সমাজ এবং মনস্তত্ব প্রতিফলিত হইতে দেখা যায় না; কেবল অভিজাতবর্গের মুখ দিয়া তাহাদিগকে “Villain, Knave” প্রভৃতি সামন্ততান্ত্রিক যুগের কায়দা মাফিক বিবিধ বিশেষণে বিশেষিত হইতে দেখা যায়। ইংলণ্ডে তখনও অভিজাতশাসনের যুগ চলিতেছিল। কিন্তু ইহার বহুপূর্ব্বে নর্ম্মান শাসনকালে Chaucer-এর Canterbury Tales ও Black Deathএর সমসাময়িক যুগে লিখিত “Piers Ploughman”-এ জনের ও গণের উল্লেখ দেখা যায়। তাহা এ্যাংলো স্যাক্সন জাতীয় লোকদের অর্থাৎ জনসাধারণ হইতে উদ্ভূত লেখকদের দ্বারা লিখিত বলিয়া তাহাদের সুখ-দুঃখের কিঞ্চিৎ বিবরণও পরিচয় প্রদান করে। কিন্তু ইহা ‘জন’ ও ‘গণে’র সাহিত্য নহে, কারণ তাহাদের আদর্শ ও মনস্তত্ত্ব ইহাতে প্রকাশমান নহে।

এই প্রকারে ফ্রান্সেও জাতীয় রাজার (National Monarch) য়ুগে কর্ণেই, রাসিন প্রভৃতির লেখায় তৎকালীন অভিজাত সমাজের চিত্র প্রাপ্ত হওয়া যায়। তৎকালে ফ্রান্সের রাষ্ট্রে “জাতীয় রাজা” বিবর্ত্তিত হইলেও সামন্ততান্ত্রিক যুগের অভিজাতদের বংশধরেরা তখনও পুরাদমে রাষ্ট্র–শাসন পরিচালনা ও সমাজে নেতৃত্ব করিতেছে। তখনকার ফ্রান্স সামন্ততান্ত্রিক যুগের ছায়ায় ও অবস্থাতে অবস্থিত রহিয়াছে। সুতরাং অপরাপর শ্রেণীসমূহের কোন সংবাদ তৎকালীন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই প্রকার সমাজ-পদ্ধতির বিরুদ্ধে নবোত্থিত বুর্জ্জোয়া, অর্থাৎ ব্যবসায়ী মধ্যবিত্তশ্রেণী যে প্রতিবাদ উত্থাপন করে তাহা বিশ্বকোষ রচয়িতাদের (Encyclopaedist) গবেষণা, রুশোর “মানবের মৌলিক অধিকার” প্রভৃতির মধ্য দিয়া ফুটিয়াছে। চিন্তাক্ষেত্রের এই বিপ্লব পরে রাষ্ট্রীয় বিপ্লবে পরিণত হইয়া সামন্ততান্ত্রিক ফ্রান্সের সর্ব্ব শেষ নিদর্শন পর্য্যস্ত মুছিয়া ফেলে! ফরাসী বিপ্লবের পূর্ব্বের দুইখানা পুস্তকে তৎকালীন ফরাসী মধ্যবিত্তশ্রেণীর মনোভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে। পাদরী (Abbe) সিয়ের (Sieyes) “Esque ce que la tiers etat” (তৃতীয় শ্রেণী কি?) নামক পুস্তিকায় সুস্পষ্টরূপেই বলা হইয়াছে, “ফরাসী অভিজাতবর্গ যদি ৫০,০০০ পালক মাথায় ফ্রাঙ্ক ঘোড়-সওয়ারদের বংশধর বলিয়া গর্ব্ব করে তাহা হইলে তাহারা জার্ম্মানীতে ফিরিয়া যাউক, আমরা তাহাদিগকে চাই না, তৃতীয় শ্রেণীই সব!” আবার বোমার্কের “ফিগারোর বিবাহ” নামক নাটকে নাট্যকার, ফিগারো নামে এক দরিদ্র মধ্যবিত্তশ্রেণীর শিক্ষিত লোকের মুখ দিয়া বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর মনোভাব ব্যক্ত করিয়াছেন। ফিগারো বলিতেছে, “মসিঁয় কাউণ্ট, তুমি জগতে কি করিয়াছ যে সমাজের সমস্ত দ্বার তোমার জন্য উন্মুক্ত হয়, তুমি তো কেবল কাউণ্টের ঘরে জন্মগ্রহণ করিবার অসুবিধা ভোগ করিয়াছ। আর আমি একজন গরীব বুদ্ধিজীবী লোক; কি করিয়া অন্নবস্ত্রের সংস্থান করিব তাহার কোন উপায় পাইতেছি না।” অভিজাতশাসনের যুগে পতিত বুর্জ্জোয়াদের অবস্থা সকল পুস্তকে সুস্পষ্টরূপে চিত্রিত আছে। বিপ্লবের পর বুর্জ্জোয়াশ্রেণী যখন রাষ্ট্রের কর্ণধার হয় তখন হইতে ফরাসী সাহিত্য নূতন রূপ ধারণ করে। রাজনীতিক সাম্যের সুর সাহিত্যের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইতে থাকে। বাল্‌জাক্‌, ও ডুমাতে অভিজাত এবং বুর্জ্জোয়া শ্রেণীদ্বয়ের সংঘর্ষ সুপরিস্ফুট করা হইয়াছে। Three Musketeers উপন্যাসে রাজা ও সামন্তদের দরবারের কলুষিত জীবন সুস্পষ্টরূপেই অঙ্কিত করা হইয়াছে। ডুমাতে জনৈক নাইট্ তাহার পরিচিত এক উচ্চ সম্ভান্তবংশীয়া কুমারীকে মাঁসিনিয়রের (রাজার ভাই) প্রাসাদে দেখিয়া অবাক-বিস্ময়ে বলিয়া উঠে— “Montalais, Montalais, you are here! What makes you come here in this giddy court life!” (মন্তালে, তুমি এখানে! এই মাথা বিগড়ান স্থানে তুমি কিসের জন্য আসিয়াছ!) আবার সেই পুস্তকের অনত্র জঘন্য কলুষিত চরিত্রের রাজা His Most Christian Majesty চতুর্দ্দশ লুই কি ভাবে উদ্যানে এক দরবারী কুমারীকে ফুসলাইয়া নষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছিল সেই দৃশ্য বর্ণিত হইয়াছে। পক্ষান্তরে নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর ফ্রান্সের মধ্যবিত্তশ্রেণী যখন অভিজাতদের পুনঃ প্রতিষ্ঠার বিষে জর্জ্জরিত হইয়া নিজেদের পূর্ব্ব গৌরব স্মরণ করিয়া একটা Nopoleonic Legend (নেপোলিয়নের উপাখ্যান) সৃষ্টি করে, নেপোলিয়নের প্রতি তখনকার বুর্জ্জোয়াদের ধারণা বালজাক, ডুমা, ভিক্টর হুগো প্রভৃতির রচনায় সুপরিস্ফূট হয়; “লে মিজারেবল্‌স্‌” পুস্তকে হুগোর অমর লেখনী-প্রসূত ওয়াটারলুর যুদ্ধের (Battle of Waterloo) বর্ণনায় নেপোলিয়নের প্রতি এই সময়ের ফরাসী স্বদেশপ্রেমিকদের মনে কিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় তাহা বেশ পরিষ্কার বুঝিতে পারা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফরাসী বিপ্লবের ফল-প্রসূত সাম্য ও মৈত্রীভাব কি প্রকারে বুর্জ্জোয়া উন্নতমনা ফরাসী চিন্তাশীল ব্যক্তিগণকেও পাইয়া বসিয়াছিল তাহা থিয়োফিল গতিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তে ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমেরিকায় পরিভ্রমণকালে শ্বেতাঙ্গ কর্ত্তৃক জনৈক কৃষ্ণকায়ের হত্যাকাণ্ড দেখিয়া সেই সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পান—“ও একটা নিগ্রো মাত্র!” স্পেনে ষাঁড়ের লড়াইয়ে একজনের মৃত্যু ঘটিলে উক্ত প্রকারের লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে এক প্রশ্নের উত্তর পান—“ও একটা ইহুদী মাত্র!” এরূপ মনোভাবে মর্ম্মাহত হইয়া তিনি প্রত্যুত্তরে বলিলেন, “ওখানে বলিল,—ও একটা নিগ্রো মাত্র; এখানে বলিল—ও একটা ইহুদী মাত্র; কিন্তু মানুষকে কেহই সম্মান করিল না!” এই সকল লেখায় মানবের সামাজিক ও অর্থনীতিক সাম্য সম্বন্ধে কোন প্রকার উল্লেখ পাওয়া যায় না। অধস্তন ও পতিত-জাতি সমূহের মনোগত ভাব এই বুর্জ্জোয়া সাহিত্যের মধ্যে ধরা পড়ে না!

এইরূপে দেখা যায় যে সাহিত্য সমাজের সমুদয় লোকের প্রতীক হইয়া স্বরূপ প্রকাশ করে না। সাহিত্যে লেখকদের শ্রেণীগত মনোবৃত্তি ও আদর্শই প্রকাশিত হয়। অভিজাত-সাহিত্যে অভিজাতদের Divine Right of Kings and Barons (রাজা ও উচ্চ সম্ভ্রান্তবংশীয় লোকদের বিধিদত্ত অধিকার) ঘোষণা করা হইয়াছে, এবং নিম্নশ্রেণীর লোকদিগকে স্বামিধর্ম্মের নামে দোহাই পাড়িয়া মনিবের নিকট একান্ত অনুগত থাকিবার জন্য উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে, আবার বুর্জ্জোয়া সাহিত্যে উচ্চ শ্রেণীর লোকদের প্রতি গালাগালি ও বিদ্রূপবাক্য বর্ষণ করা হইয়াছে! কিন্তু নিজেদের নিম্নশ্রেণীর কৃষক ও শ্রমজীবীদের প্রতি সাম্যভাব ও ব্যবহার প্রদর্শন করা হয় নাই। “তৃতীয় শ্রেণীই সব”—ইহাই ছিল ফরাসী বুর্জ্জোয়া, বিপ্লবের মূলমন্ত্র। রোমের সময় হইতে ফরাসী বাবোফের এবং স্যোসালিস্ট শ্রমিকদের শাসনযন্ত্র (Government) করায়ত্ত করিবার প্রচেষ্টা আজও পর্য্যন্ত অর্থাৎ কিকিরো (Cicero) হইতে হালের ফ্যাসিস্ট লেখক পর্য্যন্ত কেহই কৃষক ও শ্রমিকদের উত্থান আদৌ পছন্দ করে নাই! এই কারণেই বলিতে হয় যে সাহিত্যে শ্রেণী-চৈতন্যের (class consciousness) টনটনে পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়!

ফরাসীদেশে কিন্তু বুর্জ্জোয়া সভ্যতার ফলে কালক্রমে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর অভ্যুদয় হয়। তাহাদের প্রতিনিধিগণ এক নূতন দর্শন ও আদর্শ গড়িয়া তোলেন। বিগত আশী বৎসর ফ্রান্স বুর্জ্জোয়া ও প্রলেটারিয়েট শ্রেণীদ্বয়ের সংঘর্ষস্থল হইয়া আছে। একদিকে রাজনীতিতে যেমন তাহার নজীর পাওয়া যায় অন্যদিকে সাহিত্যেও তদ্রূপ নজীরের বড় একটা অভাব দৃষ্ট হয় না। দর্শন পুস্তক সমূহ উহার সাক্ষ্য প্রদান করে; গল্প সাহিত্যেও তাহার প্রচুর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বুর্জ্জোয়াশ্রেণী যেমন রোমাঁ রোলাঁকে (Romain Rolland) উদ্ভূত করিয়াছে, নিম্ন-শ্রেণীও তেমনি আনাটোল ফ্রান্সকে বিবর্ত্তিত করিয়াছে। প্রথমোক্ত লেখক যেমন বুর্জ্জোয়া সমাজের মনস্তত্ত্ব প্রতিফলিত করিয়াছেন, শেষোক্ত লেখকও তদ্রূপ কৃষক-জীবনের বিভিন্ন দিকগুলি বর্ণনা করিয়াছেন। আবার কিছু পূর্ব্বে উভয়ের মাঝামাঝি হইতে এমিল জোলা বুর্জ্জোয়া সমাজের কলুষের জন্য দুঃখ ও বেদনায় উহাকে অভিসম্পাত করিয়াছেন! ইউরোপীয় সভ্যতার Hub (কেন্দ্র) প্যারী যে কতখানি কলুষিত ও অধঃপতিত হইয়াছে এবং উহাকে ধ্বংস না করিলে যে ফ্রান্সের মঙ্গল নাই—একথা তিনি তাঁহার “La Debacle” নামক পুস্তকের শেষভাগে বর্ণনা করিয়াছেন। ১৮৭০ খৃঃ তৃতীয় নেপোলিয়নের সিডানে আত্মসমর্পণের পর প্রুশীয়েরা যখন প্যারী অবরোধ করে এবং ভিতরে প্রলেটারিয়েট কমুনার্ডদের যখন বুর্জ্জোয়ারা হত্যা করিতেছিল সেই সময় জনৈকা ফরাসী মহিলা প্যারীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে চাহেন; তিনি সহর প্রাকারের বহির্দ্দেশে গুন্থার নামে একজন প্রুশীয় কর্মচারীকে দেখিতে পান। উক্ত গুন্থার আবার ফরাসী রমণীটির পিসতুতো ভাই! ভিতরে প্রবেশ করিবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করিলে গুন্থার কৌতূহলী হইয়া উক্ত মহিলাটিকে প্যারীর দিকে নির্দ্দেশ করিয়া দেখান যে, সোণার প্যারী দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে! লেখক এখানে ইঙ্গিত করিয়া বলিলেন যে প্যারী পুড়িয়া গেলে নূতন ফ্রান্সের সৃষ্টি হইবে। কিন্তু সেই নবীন ফ্রান্সের কোন রূপ তিনি বর্ণনা করেন নাই। ১৮৭০-৭১ খৃঃ ফ্রান্সের এই ভীষণ পরাজয়ের পর জাতীয় হতাশ ভাবের উদয় হয়। এই হতাশ ভাবের প্রতীক হয় Decadents নামক লেখক ও কবির দল। তাঁহাদের বিশ্বাস ছিল যে ল্যাটিন জাতিসমূহও বিশেষতঃ ফরাসী জাতি ইতিহাস হইতে বিলুপ্ত হইবে! কিন্তু ফ্রান্স পুনঃ সমৃদ্ধিশালী হইলে এই অবসাদের প্রতিক্রিয়া আসে; ফলে ফ্রান্সের আত্ম-প্রতায় ফিরিয়া আসে। বের্গসোঁ (Bergson) এই নূতন ভাবের প্রতীক হন। এই দলকে Neo-realist বলা হইত। Varhaeren এই নবভাবের কবি ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে শ্রমশিল্পের উন্নতির যুগে উক্ত দল সহর ও উহার ভীড়, কল কারখানা এবং ‘আধুনিক জীবনের’ (Modern life) প্রশংসা করেন।

সাহিত্যে যে শ্রেণী-জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ রুষ সাহিত্য। নেপোলিয়নের যুদ্ধের পর হইতে রুশিয়ায় ফরাসী-বিপ্লব প্রসূত উনবিংশ শতাব্দীর নূতন জ্ঞান ও ভাবাদর্শের প্রচার চলিতে থাকে। বর্ব্বর সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ভাঙ্গিয়া শতাব্দীর আদর্শ ও সভ্যতানুযায়ী নূতন সমাজ গড়িয়া তুলিবার প্রচেষ্টার মূলে যে বিভিন্ন প্রকার আন্দোলন উপস্থিত হয় এবং তাহাতে নানাশ্রেণীর নানা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, সাহিত্যে ইহার বিশিষ্ট নজীর পাওয়া যায়। অভিজাতদের দ্বারা সংঘটিত December Revolution প্রচেষ্টা উক্ত দলের লেখক ডস্টয়ভস্কি বর্ণনা করিয়াছেন; মধ্যবিত্তশ্রেণীর শিক্ষিত লোকদের মনস্তত্ত্ব টুর্‌গেনিভ Father and Son নামক পুস্তকে বর্ণনা করিয়াছেন; অভিজাত সমাজের পরিচয় টলষ্টয় দিয়াছেন। সাম্রাজ্যবাদী প্যান-শ্লাভিস্টদের মনোভাব ও আদর্শ আলিনিস্কি প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। রুণ-বিপ্লবের পূর্ব্বে অভিজাত বুর্জ্জোয়া, কৃষক ও শ্রমিকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং রাষ্ট্র করায়ত্ত করিবার জন্য স্ব স্ব মত ও আদর্শ ঘোষণা এবং প্রচারের পরিচয় রুশ সাহিত্যে পাওয়া যায়। এখানে মনে রাখিতে হইবে যে সাহিত্য অখণ্ড বস্তু নয়, অর্থাৎ প্রত্যেক সাহিত্যিক স্বদেশীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরগুলির প্রতিনিধি হইয়া কিছুই লেখেন না। তিনি তাহার স্ব সমাজেরই (of his own class) চিত্র অঙ্কিত করেন।

বর্ত্তমান যুগের প্রথম দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক কাণ্ট (Kant) বলিয়াছেন— “যদি মানুষকে বুঝিতে চাও তাহা হইলে তাহার পারিপার্শ্বিক সমাজকে বুঝিতে চেষ্টা কর।” মানুষ তাহার পারিপার্শ্বিক অবস্থা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হইয়া থাকে। এই কারণ বশতঃ নিজের সমাজের গণ্ডীর বাহিরের সংবাদ সম্বন্ধে সম্যক অবহিত হওয়া কিম্বা উহার মনস্তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা সহজসাধ্য ও সম্ভবপর হয় না। যিনি অভিজাত ও সম্ভ্রান্তবংশীয়দের প্রতি স্বামিধর্ম্ম প্রদর্শন করিবার তরফদারী করেন, তিনি ব্যবসায়ীশ্রেণীর ডেমোক্রাসী সমর্থনপূর্ব্বক লেখনী ধারণ করিতে পারেন না। আবার যদি ব্যবসায়ীদের বুর্জ্জোয়া-ডেমোক্রাসীর আদর্শকে সম্মুখে ধরিতে চাহেন তিনি শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা (Government) সমর্থন করিয়া কলম চালাইতে পারেন না। যিনি ধনিকশ্রেণীর আবেষ্টনীর মধ্যে লালিত পালিত ও পরিবর্দ্ধিত এবং সেই সামাজিক আদর্শকে সনাতন ও শাশ্বত বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছেন তিনি অর্থনীতিক-সাম্য-সঞ্জাত শ্রেণী-হীন সমাজ (Classless Society) সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কলম নিয়োজিত করিতে পারেন না। সর্ব্বহারাগণের মনস্তত্ত্ব তাঁহার পক্ষে বোঝা ও জানা এবং নিখুঁতভাবে উহাকে রূপ দেওয়া অসম্ভব। উচ্চস্তরের লোকদের মধ্যে কাহারও কাহারও “ছোটলোকদের” প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা সম্ভব হইতে পারে, ইহাতে তাহাদের দয়া ও মহানুভবতা প্রকাশ পায় বটে; কিন্তু উচ্চস্তরের লোকদের পক্ষে তাহাদের মনস্তত্ত্ব সম্যক্‌রূপে উপলদ্ধি করিয়া এবং তাহার সহিত নিজেকে মিশাইয়া দিয়া তাহাদের আশা আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শকে লোক সমাজে উপস্থাপিত করা মনোবিজ্ঞান-বিরুদ্ধ বলিয়াই বিবেচিত হয়। কিন্তু যে-সব যায়গায় এরূপ ঘটনা ঘটে সেখানে ইহা পরিষ্কাররূপে প্রতীয়মান হইবে যে, সেই ব্যক্তি স্বয়ং শ্রেণীচ্যুত হইয়াছেন; তিনি আর তাহার সমাজ ও জন্মগত শ্রেণীতে অবস্থিত নাই—নিম্নশ্রেণীর সহিত সর্ব্ব বিষয়ে এক ও অভিন্ন হইয়া শ্রেণী-বিহীন (de classed) হইয়াছেন। এই কারণেই বলিতে হয় যে সাহিত্য একটি অখণ্ড বস্তু নহে, প্রত্যেকেই আপনার শ্রেণীগত মনস্তত্ত্ব জাত দৃষ্টিভঙ্গীতে সাহিত্য রচনা করিয়া থাকে। কোন একটি দেশের নিদ্দিষ্ট ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করিলেই সেইটিকে সেই দেশের অথণ্ড সাহিত্য বলা যাইতে পারে না। তবে এই কথা বিশেষভাবে বলা যায় যে বর্ত্তমানে সোভিয়েট সাহিত্যই প্রলেটারিয়েট সাহিত্যের প্রকৃষ্ট নিদর্শন। অধুনা সোভিয়েট সাহিত্যিকগণ রুশীয় ভাষায় যাহা লিপিবদ্ধ করেন তাহা রুশ ভাষার অন্তর্গত সাহিত্য বটে, কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর রুশ-সাহিত্য আর আধুনিক গোগল, পুস্কিন হইতে আরম্ভ করিয়া সলকফ, প্রভৃতি উদীয়মান নবীন সোভিয়েট সাহিত্যিকদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিপাদ্য বিষয় ও আদর্শের মধ্যে কি পর্ব্বতপ্রমাণ পার্থক্য দেখা যায়! তাহাতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মনোভাব ও কার্য্য যে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহা আর অস্বীকার করিবার উপায় নাই।

আজকাল সোভিয়েট রুশিয়ায় প্রলেটারিয়েট সাহিত্য নামে সাহিত্যের একটা নূতন রূপ বিবর্ত্তিত হইয়াছে। ইহার অর্থ—শ্রমিকদের সাহিত্য। ইহাতে শ্রমিকদের জীবন, তাহাদের মনোভাব, তাহাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং লোক সমূহকে তাহাদের আদর্শ অনুযায়ী দেখা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়গুলি পরিস্ফুট করা তইতেছে। প্রলেটারিয়েট সাহিত্যের কথা উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে - সোস্যালিষ্ট আন্দোলনের মধ্য হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে। যেমন উনবিংশ শতাব্দীতে বুর্জ্জোয়াশ্রেণী দ্বারা একটা সাহিত্য সৃষ্টি হয় এবং তাহাতে তাহাদের সমাজ ও জীবনের আলেখ্য প্রতিফলিত হয় তদ্রূপ প্রলেটারিয়েটদের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে তাহাদের আদর্শকে ফুটাইয়া তুলিয়া একটা নুতন সাহিত্য গড়িয়া তোলা একান্ত প্রয়োজন। উক্ত আন্দোলন সোভিয়েট রুশিয়ার গণবিপ্লবের পর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সোভিয়েট রুশিয়ার শ্রমিক গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হইবার পর সর্ব্বপ্রথম শ্রমিকদের শ্রেণীস্বার্থ, জীবন ও আদর্শ লইয়া একটা বিরাট সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছে। এরূপ শোনা যায় যে শ্রমিকদের বংশ হইতেই বড় বড় তরুণ নবীন সাহিত্যিক সৃষ্ট হইতেছে; এবং তাহাদের রচিত পুস্তকসমূহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় ভাষান্তরিত হইতেছে। এই তুলনামূলক আলোচনা দ্বারা এই তথ্যে উপনীত হওয়া গেল যে সাহিত্যে বিভিন্নশ্রেণীরই মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।