সাহিত্যে প্রগতি/সাহিত্য ও সমাজ (১)
সাহিত্য ও সমাজ
(১)
আজকাল সাহিত্যে প্রগতি চাই বলিয়া কথা উঠিয়াছে; এবং ‘প্রগতি সাহিত্য' নামে একট্য সাহিত্য গড়িবারও চেষ্টা হইতেছে। এইজন্য সাহিত্যে প্রগতি কি, তাহার বিশ্লেষণ প্রয়োজন, কারণ সাধারণ সাহিত্যসেবীর কাছে ইহার কোন অর্থ বোধগম্য হয় না।
আমাদের দেশের সাহিত্যিকেরা সাধারণতঃ সনাতনপন্থী, অর্থাৎ জীবনের সর্ব্ব ক্ষেত্রেই এই দেশের লোকের যে প্রকারের মনোবৃত্তি, এই ক্ষেত্রেও তাহাই দেখা যায়। ইহার অর্থ, অতীতকে আঁকড়াইয়া থাকিয়া তাহাকেই সাহিত্য চর্চ্চার পরম লক্ষ্য মনে করা হয়। অতীতে সাহিত্যিকেরা যে-রূপ দিয়েছেন, ষে গণ্ডী নির্দ্দেশ করিয়াছেন, যে ভাবধারা নির্দ্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত করিয়া গিয়াছেন, তাহার বাহিরে যে সাহিত্য রস যাইতে পারে এই চিন্তা এখন এ দেশের সাহিত্যিকদের মনে সাধারণতঃ উদয় হয় নাই। এদেশে সাধারণের নিকট এখনও সাহিত্যের অর্থ, কাব্য, নাটক ও অলঙ্কার! কিন্তু পাশ্চাত্যের বিশিষ্ট অগ্রগামী জাতিদের মধ্যে 'লিটেরাটুর' (Literatur) অর্থে স্বীয় মাতৃভাষায় লিখিত যে কোন বিষয়ের পুস্তক নির্দ্দেশ করা হয়; এইজন্য বৈজ্ঞানিক পুস্তকসমূহও বৈজ্ঞানিক ‘লিটেরাটুর' বলিয়া গৃহীত হয়। অন্যদিকে, আমরা যাহাকে সাহিত্য বলি, তাহাকে 'হ্যমানিসম্, (Humanism) অর্থাৎ ক্লাসিকাল ভাষায় লিখিত পুস্তকসমূহের পাঠ মধ্যে গণ্য করা হয়। তৎপরে জীবন্ত সাহিত্যকে ঐ সব দেশে নানা স্তরে বিভক্ত করা হইয়াছে, যথা: - আইডিয়ালিসম্, রোমাণ্টিসিসম্, রিয়ালিস্ম্।এতদ্ব্যতীত, প্রগতিশীল লেখকেরা আবার সাহিত্যের মধ্যে কৃ্ষ্টির মাপকাঠি অনুসন্ধানের জন্য তাহাকেও প্রাচীন যুগ, সামন্ততান্ত্রিক যুগ, বুর্জ্জোয়া যুগ, প্রলেটারীয় যুগ বলিয়া অভিহিত করিতেছেন।
কিন্তু আমাদের দেশে, প্রথমোক্ত বিভাগটাই গণ্য। হয় তো শেষোক্তটি এখনও গবেষণার বস্তু হয় নাই। অতীতের ভাবধারা ও বর্ত্তমানের জাতীয়তাবাদের উন্মাদনার মধ্যে থাকিয়া ভাবুকেরা সবই একাকার দেখিতেছেন। এই সব বিষয়কে বোধগম্য করিতে হইলে সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ গবেষণা প্রয়োজন।
সাহিত্য কাহাকে বলে এবং তন্মধ্যে আমরা কি দেখি, ইহাই আমাদের অনুসন্ধানের বস্তু। একটা লোকের চিন্তা, ভাবধারা ও পারিপার্শ্বিক জগতের ঘটনাসমূহ (phenomena) পর্যবেক্ষণ করিয়া তাহা যখন ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়, তখন তাহাকে 'সাহিত্য' বলা হয়। সাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বকপোলকল্পিত কিছু নাই, মানবের চিন্তার ধারা তাহার বর্হিজগতের অবস্থা সাপেক্ষ। ভাবের পশ্চাতে থাকে অর্থনীতিক উপাদান। মানব সমষ্টির আর্থিক পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সামাজিক আবর্ত্তন ও বিবর্ত্তন ঘটে, সেই সঙ্গে তাহার ভাবরাজ্যেও পরিবর্ত্তন সংসাধিত হয়। অর্থনীতিক পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সামাজিক রূপান্তর দ্বারা কৃষ্টির যে পরিবর্ত্তন সাধিত হয়, তাহার নজীর হয় ইতিহাসে, না হয় সাহিত্যে দেখিতে পাই। সাহিত্যে তৎকালীন সামাজিক চিত্র প্রতিভাত হয়, সেইজন্য সাহিত্যে আমরা সমাজতত্ত্বের মাপকাঠি দ্বারা প্রত্যেক যুগের কৃষ্টির পরিচয় পাইতে পারি। এইজন্য সাহিত্যে সনাতনধারা বা অখণ্ডবস্তু বলিয়া কিছু নাই। জাতীয় জীবনের প্রত্যেক যুগের চিত্ত আমরা সাহিত্যমধ্যে অঙ্কিত হইতে দেখি!) এই কারণে আইডিয়ালিস্ম্ রোমাণ্টিসিসম্ প্রভৃতিতে ভাগ করিলে সাহিত্যের পর্য্যাপ্ত বিশ্লেষণ হয় না, কারণ এই সব, বিভাগের পশ্চাতেও ইতিহাসের অর্থনীতিক ব্যাখ্যা অন্তর্নিহিত রহিয়াছে। এই জন্যই ইহা সুনিশ্চিত যে, যেমন লোকসমাজ সাহিত্যও তদ্রূপ হইবে। সাহিত্যের মধ্যেই সমাজতত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। সাহিত্য আবার একটা বড় কাজ করে, তাহা হইতেছে ভাবপ্রচার। ইহাই সাহিত্যের ‘active role’। এই কারণেই সকলে স্বীয় চিন্তার ধারাকে মাতৃভাষায় লিখিয়া জনসমাজে প্রচার করিবার চেষ্টাকালীন সেই বিষয়ে একটা সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তাই যে সমাজে যত সংঘর্ষ সেই সমাজে ততই সাহিত্যের নানামুখী বিকাশ দেখিতে পাওয়া যায়। যে সাহিত্যে একটা সুরই বরাবর বাজে, বুঝিতে হইবে যে সেই সমাজ মৃতপ্রায়, তাহা অভিব্যক্তি বা আবর্ত্তনের বাহিরে গিয়া স্থানুবৎ হইয়াছে।
সমাজে যেরূপ সনাতন ধারা নাই সাহিত্যেও সেইরূপ কোন সনাতন ধারা নাই। সাহিত্য একটা নির্দ্দিষ্ট যুগ বা সামাজিক গণ্ডী বা চিন্তা ধারার মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে পারে না। যে স্থলে তাহা হয় তথায় সেই মৃতপ্রায় জাতির নিদর্শন মৃতপ্রায় সাহিত্যকে আবর্জ্জনা স্তূপের মধ্যে ফেলা হয়। জাতীয় জীবনের নূতনাবস্থার প্রমাণ স্বরূপই নূতন সাহিত্য গড়িয়া উঠে।
ভারতের সাহিত্যের যুগ ও ক্ষেত্র অতি প্রশস্ত, অধ্যাপক ভিণ্টারনিষ্টস্ তাঁহার “ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস” নামক গ্রন্থে বলেন যে ইহা ঋগ্বেদ হইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পয্যন্ত বিস্তৃত। ইহার সময় তিন হাজার বৎসরের উপর। কাজেই ইহার মধ্যে নানা যুগের ও নানা ভাবের লীলাখেলা দেখা যাইবে। আপাততঃ সংস্কৃতের সন্তান বাঙ্গলা ভাষা ছাড়িয়া দিয়া আমরা কেবল বেদের ভাষাপ্রসূত সংস্কৃত ভাষা ও তাহার পালি এবং প্রাকৃত রূপে যে সাহিত্য সৃষ্ট হইয়াছে তাহার যৎকিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ করিব।
ব্লুমফিল্ড প্রভৃতি পণ্ডিতেরা বলেন, ঋগ্বেদ ধনী ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের যজ্ঞাদির কথাই উল্লেখ করে। ইহা দানস্তুতি, দশরাজার যুদ্ধ, ইন্দ্রের সম্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, গজপৃষ্ঠে পাত্র পরিবেষ্টিত রাজা প্রভৃতি উচ্চস্তরের ক্রিয়াকলাপের গানে পরিপূর্ণ। ইহাতে আর আছে “মহাকুল” ও “মঘবন্” প্রভৃতিদের উল্লেখ! ইহাতেই দৃষ্ট হয় যে, বেদের মন্ত্রভাগ সমাজের উচ্চস্তরের লোকদের স্তুতিতেই পরিপূর্ণ। যজুর্ব্বেদও তদ্রূপ; ইহাতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণদ্বয়ের উন্নতিকল্পে যজ্ঞাদি করিবার ব্যবস্থা আছে এবং তাহাদের জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করাও উল্লিখিত আছে। পরে যখন বৈদিক ধর্ম্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষিত হয় এবং সাধারণ ভাষায় ধর্ম্মপুস্তকসমূহ লিখিত হইতে থাকে, সেই সময় প্রাকৃত ও পালি ভাষায় জৈন ও বৌদ্ধাচার্য্যেরা জনসাধারণের কিঞ্চিৎ সংবাদ দিয়াছেন। এই সব পুস্তকে, সনাতনী প্রথা ভাঙ্গিয়া সংস্কারকগণ যখন শূদ্র ও পতিতদের আহ্বান করেন, তখনকার চিত্র আমরা জনসাধারণের ভাষায় (জাতক, অবদান ও অঙ্গাদি পুস্তক) পাই। এই সব পুস্তকে আমরা জনসাধারণের সংবাদ পাই, তৎকালীন ভারতীয় সামাজিক জীবনও এই সব পুস্তকে প্রতিফলিত হইয়াছে। কিন্তু যখন শেষ মৌর্য্য সম্রাটকে হত্যা করিয়া তাঁহার সেনাপতি পুষ্যমিত্র ব্রাহ্মণাধিপত্য স্থাপন করে তখন সেই যুগের শাসকশ্রেণীর স্বার্থপ্রণোদিত শ্রেণী লক্ষণদূষ্ট ‘মানবধর্ম্মশাস্ত্র' বা মনুসংহিতার নূতন সঙ্কলন হয়। সেই সময় হইতে আমরা সংস্কৃত ভাষায় আর এক সামাজিক চিত্র দেখিতে পাই। ব্রাহ্মণাধিপত্যের যুগ হইতে নূতন সংস্কৃতের আদর হয়; এই আদর গুপ্তযুগে চরম শিখরে আরোহণ করে। ঐতিহাসিকেরা বলেন, প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার চরম উৎকর্ষ ১০০-৭০০ খৃষ্টীয় শতক মধ্যেই হয়। এই সময়েই সর্ব্বপ্রথম বৌদ্ধ অশ্বঘোষ নাটক রচনা করেন, তৎপরে ভাস, কালিদাস, ভবভূতি, পরে রাজশেখর, ভারবী, মাঘ, ভট্টনারায়ণ, আরও পরে শ্রীহর্ষ, জয়দেব ও শ্রীকৃষ্ণ মিশ্রের উদয় হয়। শেষোক্তদের সময় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্দ্ধারিত হইয়াছে। তখন ভারতে মুসলমান আক্রমণ হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়, কারণ শ্রীকৃষ্ণমিশ্রের “প্রবোধচন্দ্রোদয়” নাটকে তুরস্কের নামোল্লেখ আছে।
এই যে, ব্রাহ্মণদের দ্বারা বিরচিত বিস্তৃত সংস্কৃত সাহিত্য, যাহা লইয়া আজও আমরা গৌরব বোধ করি এবং যাহার বিশিষ্টাংশ সামন্ততান্ত্রিক যুগেই লিখিত তাহার স্বরূপকে বিশ্লেষণ দ্বারা ইহাই নিরূপিত হইবে: বর্ণাশ্রম ধর্ম্মের প্রাধান্য, কুল ও বংশের মহিমা, স্বাধীন সামস্তরাজাদের অস্তিত্ব, বাজারে বাজারে শিক্ষিতা গণিকার প্রাদুর্ভাব, গোলাম শ্রেণীর অস্তিত্ব, রাজাদের অন্তপুরে কঞ্চুকী ও প্রহরী, অবগুণ্ঠনের প্রচলন, স্ত্রীলোক আইনের অধিকার হইতে বঞ্চিত (যদিচ বৈদিক যুগের পরে অনেক মনীষী স্ত্রী, ও পুরুষ উভয়ের সমানাধিকার আছে বলিয়া স্বীকার করিতেন [ যাস্কের-টীকাকার দূর্গাচার্য্য]) সামাজিক আদবকায়দার বাহুল্য ইত্যাদি। এই সব পুস্তকে সামন্ততান্ত্রীক যুগ পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পায়, সেই জন্য তাহাতে জনের ও গণের সংবাদ পাওয়া যায় না, কেবল রাজা, রাণী, সেনাপতি, মন্ত্রী, রাজকন্যা ও তাঁহার প্রণয়ী।
এই প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক যুগের ইতিহাসে একটা ঘটনা দ্রষ্টব্য যে, ভাস হইতে হর্ষবর্দ্ধন পর্য্যস্ত সকলেই একছাঁচে নিজেদের নাটক রচনা করিয়াছেন। গল্পের বেশী বাহুল্য নেই। যাহা আছে, ঐতিহাসিকেরা বলেন তাহা, সকলেই গুণাঢ্যের পৈশাচী-প্রাকৃত ভাষায় লিখিত “বৃহৎ কথা” হইতে “plagiarize” করিয়া লিথিয়াছেন। এইসব পুস্তক একটা যুগের ও একটা শ্রেণীর বিষয় ক্রমাগত বর্ণনা করিয়াছে বলিয়া, সব পুস্তকই এক ছাঁচে ঢালা।
এই যুগের সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা একদিকে ব্রাহ্মণাধিপত্য ও বর্ণাশ্রনের মাহাত্ম্য (কালিদাস, ভবভৃতি দ্রষ্টব্য) ও বড় বড় ক্ষত্রিয় রাজাদের গুণকীর্তনে ব্যস্ত থাকায় দেখি যে, ব্রাহ্মণ লেখকগণ সাধারণকে ধাঁ ধাঁ লাগাইবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, হিন্দু-সমাজ ব্যবস্থা সনাতন ও চিরকালই ব্রাহ্মণ্যবাদ মানিয়া লইয়াছে। কিন্তু অন্য লেখকদের কাছ হইতে আমরা এই সংবাদ পাই যে, “লোকায়তবাদ”, নাস্তিকতা, বাস্তবিকতা পূর্ণ সুখভোগবাদ প্রচারিত ও গৃহীত হইতেছে। এই মতের বিশ্বাসীর দল ছিল ধনকুবের “নাগরক”গণ। প্রাচীন হিন্দুর সুখসমৃদ্ধির কালে যখন নানা সমুদ্র বিচরণ করিয়া হিন্দুর অর্ণবপোতগুলি নানাদেশ হইতে ‘সুক্তার বদলে মুক্তা, জিরের বদলে হীরে' লইয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিত, তখন এই অর্ণবপোতদের মালিকগণের মধ্যে “নাগরক” শ্রেণী উদ্ভূত হয়। বাৎসায়ণ বলেন, এই নাগরকগণই লোকায়ত ধর্ম্মের অনুরাগী হয়। “বনে দুইটা ময়ুরের অনুসন্ধানাপেক্ষা হাতে একটা পাখী থাকা ভাল” ইহাই হইতেছে লোকায়তদের মত। আসল কথা, দেশে ধনবৃদ্ধির সঙ্গে সামন্ততন্ত্রীয় আভিজাত্যের পার্শ্বে একটা বুর্জ্জোয়া শ্রেণী বিবর্ত্তিত হয়। এই শ্রেণীর নাগরকগণ পাশ্চাত্য দেশের হালফ্যাসানের ধনকুবেরগণের ন্যায় জীবন যাপন করিত। প্যারিস সহরে যে type'কে “boulevardier” বলা হয়, প্রাচীন ভারতের নাগরকগণ তাহাদেরই প্রতিমূর্ত্তি! ভাস ও মৃচ্ছকটিকের নাটকের চারুদত্ত তাহারই একজন প্রতীক, যদিচ ধনহীন। এক কথায়, সমাজের উচ্চস্তরে অবস্থিত অভিজাত শ্রেণীর লোক যদি বর্ণাশ্রম ধর্ম্মের ও বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের গুণকীর্ত্তন করিত, ধনকুবের নাগরকগণ realist হইয়া নাস্তিকতা ও ভোগবাদ মতের পোষকতা করিত। এই জন্যই তাহারা বৃহস্পতি ও চার্ব্বাকের লোকায়ত মতের অনুরাগী হয়। আবার, উত্তর বৈদিক যুগে যে সব ধর্ম্মসম্প্রদায় উত্থিত হইয়াছিল, তাহাদের ধর্ম্মপুস্তক সমূহে আমরা গণের সন্ধান পাই। বৌদ্ধ ‘অবদান' ও 'জাতক’সমূহ আমাদের তৎকালীন সমাজের আলোকচিত্র প্রদর্শন করে। এতদ্বারা দৃষ্ট হয় যে, গণেরা সাম্যবাদী বৌদ্ধধর্ম্মে অনুরাগী হয়।
যখন ভারতীয় সমাজ এই ভাবে চলিতেছে, তখন আমরা হিন্দু সমৃদ্ধির শেষাশেষি তান্ত্রিক ধর্ম্মের প্রাদুর্ভাব ভারতে দেখিতে পাই। তান্ত্রিকধর্ম্ম সামাজিক হিসাবে বর্ণাশ্রমের বিপক্ষে যায় নাই। সেই জন্য আমরা সাহিত্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে তান্ত্রিকতার সব অলৌকিক গল্পের অবতারণা হইতে দেখি। রাজশেখরের 'বিদ্ধশাল ভঞ্জিকা' হইতে ভবভূতির ‘মালতীমাধব' নাটকে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। মালতীমাধব নাটকে কাপালিক অঘোর ঘণ্টা ও তাহার শিষ্যা কপালকুণ্ডলার বীভৎস ব্যাপার বর্ণিত আছে। “কাপালিক দেবীর নিকট স্ত্রীরত্ন উপহার দিবার জন্য অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, কপালকুণ্ডলা তাহারই আহরণের ইচ্ছা করিতেছিলেন” (ভবভূতি, কবিকথা ২ খণ্ড পৃঃ ৪৭৮)। ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক পুস্তকসমূহে একটি বিশিষ্ট সামাজিক সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। দক্ষিণের ব্রাহ্মণ্যবাদীয় সতবাহনদের রাজত্বের অবসানের পরে, মধ্য ভারতের ‘ভারশীব’ও ‘ভাকাটাকা’ রাজাদের উত্থান হয়। বিষ্ণুপুরাণে ইহাদের ‘নবনাগ’ ও ‘বিন্ধ্যশক্তি' নামে অভিহিত করা হইয়াছে। এই রাজাদের যে-সব তাম্র-শাসনসমূহ আবিষ্কৃত হইয়াছে (Corpus Inscriptionum Indicarum vol III) তাহাতে দৃষ্ট হয় যে, ইহাদের সময়ে শৈব ধর্ম্ম বেশী প্রসার লাভ করে, আর ইহারা অশ্বমেধাদি নানাবিধ যাগযজ্ঞের পুনরুত্থান করে। এই সময়ে বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠার সংবাদ খুবই কম পাওয়া যায়। লেখমালা দৃষ্টে ইহা বোধগম্য হয় যে, ইহাদের শাসনকালে ও পরবর্ত্তী গুপ্তদের আড়ম্বরপূর্ণ শাসনকালে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মসমূহের বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আড়ম্বরপূর্ণ ক্রিয়াকাণ্ড যুক্ত ব্রাহ্মণ্যবাদীয় ধর্ম্মের উদ্ভব হয়। এই প্রচেষ্টারই চিত্র আমরা কালীদাস ও ভবভূতি প্রভৃতিতে এবং পুরাণসমূহে পাই। কিন্তু শিলালেখ সমূহে ইহাও দৃষ্ট হয় যে সতবাহনযুগেই অনেক শক, পারদ ও যবন (গ্রীক) ব্রাহ্মণ্যবাদীয় হইয়া ব্রাহ্মণ্যক্রিয়া সম্পাদন করিতেছে। আবার পাণিনীর “শূদ্রানাম্ অনিরবুসিতানাম” সূত্রের ব্যাখ্যায় পতঞ্জলী তাঁহার মহাভাষ্যে বলিয়াছেন শক, যবনেরাও আর্য্যাবর্ত্তে বাস করে। স্বভাবতঃই সামাজিক প্রশ্ন উঠিবে, ইহাদের স্থান ভারতীয় সমাজের কোথায় হইবে? কৌমগত ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম তাহাদের স্থান দিতে চায় না, অথচ তাহারা হইতেছে “হিন্দু”। এই সময়েই তন্ত্রের উদ্ভব হয়। ভারশীব ও ভাকাটাকাদের শৈবধর্ম্ম অনুরাগ, এবং তন্ত্রোক্ত সংবাদ যে বিন্ধ্যপর্ব্বতের তিন পার্শ্বের স্থানে (অশ্বক্রান্তা, রথক্রান্তা, বিষ্ণুক্রাস্তা—মহানির্ব্বাণতন্ত্র, প্রথমোল্লাস) ৬৪ খানি করিয়া প্রত্যেক স্থানে তন্ত্রগ্রন্থ বিরচিত হইয়াছিল, এই সংবাদ দ্বারা একটা সমাজতান্ত্রিক নির্দ্দেশ পাওয়া যায়। পুনঃ, এই তন্ত্রের ‘চক্রে’ (ধর্ম্মোপাসনাক্ষেত্রে) ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, ম্লেচ্ছ, যবন ভেদ নাই, (মহানির্ব্বাণতন্ত্র ১৮৮, ২১৮)। আবার চক্রে অনুষ্ঠিত শৈব বিবাহ ব্রাহ্ম বিবাহের ন্যায় শাস্ত্রীয় ব্যবস্থআ। পুনঃ, এই বিবাহ বিধবার সহিত করণীয় (মহানির্ব্বাণ ৯।২৭৭) আবার অসবর্ণ বিবাহও চলিতে পারে (ঐ ২৭৭)। পুনঃ, “মহাচীনাচার” তন্ত্রে দৃষ্ট হয় যে ছুৎছাৎ আচার বিচারের বালাই তান্ত্রিকদের নাই। অশুচি বস্ত্র পরিধান করিয়া, আহারের পরেও ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান করা যায় (বৃহৎ তন্ত্রসার, বীরতন্ত্র)। এই সবের অর্থ, গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীয় “আচার” সম্বলিত কৌমগত ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের বাহিরে এমন ধর্ম্মমত বাহির হইল যাহাতে তদানীন্তনের ম্লেচ্ছ, শক ও যবন ও স্থান পায়।
এই প্রকারে পুষ্যমিত্র অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ার বিপক্ষে যুগধর্ম্মানুযায়ী ব্যবস্থা করিয়া একদল কৌমের বাহিরের লোকদের নিজেদের গণ্ডীর ভিতর আকর্ষণ করেন। কিন্তু পুরাণ ও স্মৃতি সমুহে এই প্রতিক্রিয়ার কোন সংবাদই নাই; যদিচ সামন্ততান্ত্রিকযুগের ছাপ ব্রাহ্মণ্যবাদীয় তন্ত্রে আছে। অন্যদিকে বৌদ্ধতন্ত্রেও জাতির বা বর্ণের বালাই নেই, তান্ত্রিক অষ্ট সিদ্ধি লাভ করিবার প্রযত্ন করিতেন, এবং আলকেমীতে পারদর্শীতাকে ধর্ম্মে সিদ্ধি রূপে প্রচার করিতেন (B. N. Datta—Mystic Tales of Lama Taranatha দ্রষ্টব্য)। কিন্তু সাম্যবাদীয় বৌদ্ধদের মহাযানী শাখাতে তৎকালীন সামন্ততান্ত্রীক বাতাবরণের ছাপ বিশেষভাবে পড়ে। তাঁহাদের ভিক্ষু সংঘে যেমন পদভেদ জনিত স্তরভেদ সাধুদের মধ্যে উদ্ভুত হয়, ধর্ম্মেও তদ্রূপ আরাধ্যদের মধ্যে স্তর ভেদ দৃষ্ট হয়। ফলতঃ একই সামন্ততান্ত্রিক বাতাবরণে বিবর্ত্তিত বর্ণাশ্রনীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মহাযানী বৌদ্ধবাদ একই ধারায় প্রবাহিত হইয়া শেষে তন্ত্রের ভিতর দিয়ে একীভূত হইয়া যায়। এই জন্যই পরে, বৌদ্ধ ধর্ম্ম ভারত হইতে অন্তর্হিত হয়।
ইহার পর, ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক প্রভাবের সময়ে আমরা মাঘের ‘শিশুপালবধ’, শ্রীহর্ষের 'নৈষধচরিতম' ও জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ', ধোয়ীর ‘পবনদূত’ বিরচিত হইত দেখি। উত্তর ভারতে হিন্দুর রাজনীতিক পতনের প্রাক্কালেই এই তিন পুস্তক লিখিত হইয়াছিল। কাব্য হিসাবে এই পুস্তকগুলি উচ্চদরের হইলেও ইহাতে পতনোন্মুখ হিন্দুর সামাজিক চিত্র বিশেষ ভাবে প্রতিফলিত হইয়াছে। এই কয়টী পুস্তকে আমরা প্রথমোক্ত যুগের কবিদের থেকে ভিন্ন সুর বাজিতে দেখি! ইহাতে বীররস অপেক্ষা আদিরস ও কামকলার চিত্রের সংবাদ পাই। পুস্তকগুলি পাঠ করিলে বেশই বুঝা যায় যে, হিন্দুর জাতীয় জীবনে ও নৈতিক আদর্শে ঘুণ ধরিয়াছে। মাঘে— যাদব ও যাদবীদের প্রভাসে মদোন্মত্ত বিহার, নৈষধে— দময়ন্তীর বিবাহে বরযাত্রীদের কদর্য্য রসিকতা এবং বাসরগৃহে বরকন্যার কদর্ঘ্য আলাপের সহিত ভাসের পুস্তকসমূহের বীররসের বর্ণনা, কালিদাসের রঘুর দিগ্বিজয়ে এবং ভবভূতিতে (মহাবীর চরিত) রামের সহিত পরশুরামের, পরে রাবণসৈন্যের সহিত যুদ্ধের বর্ণনার কি প্রভেদ! এতংব্যতিরেকে, এই উভয় দলের লেখকদের লেখার মধ্যে Moral toneএর কি প্রভেদ (কালিদাসের কয়খানি পুস্তক অতি কুরুচিপূর্ণ। কিন্তু বর্ত্তমানে কথা উঠিয়াছে উহা তাঁহার রচিত কিনা? হিন্দীতে শ্রীপ্রসাদজীর “স্কন্দগুপ্ত” নাটকের মুখবন্ধ দ্রষ্টব্য)!
এই প্রকারে সংস্কৃত সাহিত্যে বিভিন্নযুগের বাতাবরণে রস ও রূপেরই কত প্রভেদ! শেষে একটি পুস্তকের উল্লেখ করিয়া এই অধ্যায় সমাপ্ত করিব। তাহা হইতেছে পূর্ব্বোক্ত “প্রবোধচন্দ্রোদয়” নাটক। ইহা ধর্ম্মাত্মক পুস্তক, রূপকভাবে লিখিত এবং ইহাতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদিত হইয়াছে। বাঙ্গলায় যখন বৌদ্ধশাসন অন্তর্হিত হইয়া ব্রাহ্মণ্যবাদীয় শাসন প্রবর্ত্তিত হইয়াছে এবং ব্রাহ্মণদের দ্বারা একটা বাঙ্গালী national Chauvinist (আক্রমণশীল জাতীয়তা) ভাব সৃষ্ট হইয়াছে (এই ভাব দশম শতাব্দীর ভবদেব ভট্টেও দৃষ্ট হয়) তখন এই নাটক লিখিত হইয়াছে বলিয়া অনুমিত হয়। ৺জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুরের অনুবাদ হইতে উদ্ধৃতাংশটি পাঠ করিলেই তাহা বোধগম্য হবে।
“অহংকার—(সক্রোধে) আরে, আমরা দেখচি তুরস্ক দেশে এসেছি; তা না হলে অতিথি ব্রাহ্মণকেও গৃহস্থেরা পাদপ্রক্ষালনের জল দেয় না” (পূঃ ২১)
“অহংকার— অত্যুত্তম রাজ্য এক গৌড় তার নাম
তাহারি গো রাঢ় দেশ ভূরিশ্রেষ্ঠ গ্রাম;
সে গ্রামে করেন বাস শ্রেষ্ঠ মোর পিতা,
প্রজ্ঞাশীল বুদ্ধিধৈর্য্যে বিনয় আচারে” (পৃঃ ২২)
ইহা বাঙ্গলায় ব্রাহ্মণাধিপত্যের যুগের অর্থাং ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় সেন রাজাদের সমসাময়িক কালের জাঁকের কথা! ইহা পুষ্যমিত্র প্রতিষ্ঠিত Brahmanical Imperialism-রূপ (ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের সাম্রাজ্যবাদীয় মনস্তত্ত্ব) ব্যবস্থা বাঙ্গলায় সংস্থাপিত হইবার পর, বাঙ্গলার ব্রাহ্মণদের জাঁকের বড়াই। তারপর, তুরস্কের শেল বাঙ্গলায় পড়ে, তখন এই দেশের লোকে গৌড় রাজ্যের জাঁক করেনা, করে কেবল নিজের বর্ণের ও বংশের! তৎপর আসে দেবীবরের মেলবন্ধনের পালা, আর রঘুনন্দনের ‘অষ্টাবিংশতত্ত্বে' সতীদাহ ও আচারের কড়াকড়ির ব্যবস্থা।
রঘুনন্দন আজ নানাপ্রকারের গালাগালির পাত্র হইয়াছেন, কিন্তু ইহাও দেখা প্রয়োজন যে এই ব্যবস্থার পশ্চাতে কি অর্থনীতিক ব্যাখ্যা ছিল? “অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব” ব্রাহ্মণ ও জমিদার, উচ্চশ্রেণী প্রভৃতি নানা বনিয়াদী স্বার্থের প্রতীক মাত্র।
এই প্রকারে আমরা দেখি যে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যেও শ্রেণীসংগ্রামের ছাপ রহিয়াছে এবং অর্থনীতিক ও সামাজিক বিবর্ত্তনের সঙ্গে ভাবের পরিবর্ত্তন হইয়াছে।
এইবার আমরা বাঙ্গলা সাহিত্যের কিঞ্চিৎ সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করিব। বাঙ্গলা সাহিত্য প্রায় ১০০০ বৎসরের। গৌড় প্রাকৃত ভাষা নানা অভিব্যক্তির মধ্য দিয়া বর্ত্তমানের বাঙ্গলা ভাষার আকার পরিগ্রহণ করিয়াছে। ঐতিহাসিকেরা বাঙ্গলার সঠিক ইতিহাস খৃঃ ৭ম শতকের শশাঙ্ক হইতে আরম্ভ করেন। হালে আবিষ্কৃত একজন বৌদ্ধ বাঙ্গালীদ্বারা বিরচিত “আর্য্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প” পুস্তকে লিখিত আছে যে শশাঙ্ক ব্রাহ্মণবংশীয় ছিলেন। তৎপরে, অরাজকতার জন্য প্রজারা “ভদ্র” নামক একজন শূদ্রকে রাজপদে বরণ করেন। ইহার পর একটি ‘সাধারণ-তন্ত্র' (Republic) স্থাপিত হয়। বাঙ্গলা আবার “মাৎস্যন্যায়” দ্বারা জর্জরিত হইলে প্রকৃতিপুঞ্জ গোপাল নামক একজন নায়ককে রাজপদে বরণ করেন। উপরোক্ত পুস্তক গোপালের জাতি সম্বন্ধে বলিতেছে যে ইনি “দাসজীবিন” অর্থাৎ, ইনি অতি নীচ শ্রেণীর শূদ্র। এই গোপালই বিখ্যাত পাল বংশের স্থাপয়িতা। এই সময়ে বাঙ্গলার রাজারা কিছুকালের জন্য উত্তর ভারতে সার্ব্বভৌমত্ব প্রাপ্ত হন। তাঁহারা “পঞ্চগৌড়েশ্বর” আখ্যা পান। কিন্তু বাঙ্গলা সাহিত্যে এহেন প্রবল পাল-যুগের কোন নিদর্শন নাই। আছে কেবল ছড়া বা গীতিতে। তাহারও অতি যৎসামান্য রক্ষিত হইয়াছ বা আবিষ্কৃত হইয়াছে। পরের যুগের ব্রাহ্মণেরা বাঙ্গালীর শৌর্য্যবীর্য্যের ও গুণগরিমার চিহ্ন একেবারে মুছিয়া দিয়াছে! এখন “ধান ভান্তে মহীপালের গীত”-এর পরিবর্ত্তে শিবের গীত গাওয়া হয়। চৈতন্য চরিতামৃতে দুঃখের সহিত বলা হইয়াছে,
“জোগীপাল ভোগীপাল মহীপাল গীত,
শুনে সব লোকে আনন্দিত।”
৺পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মত এই যে বাংলায় বৌদ্ধ কৃষ্টির সমস্ত চিহ্নই ব্রাহ্মণেরা বিলুপ্ত বা রূপান্তরিত করিয়াছে! হাজার বৎসর পূর্ব্বে বাংলার বৌদ্ধরাষ্ট্রিক প্রাধান্যের যে সব প্রতিভূ ছিল তাহার কোন চিহ্ন আজ নাই। ইহা হইতেছে ভীষণ শ্রেণী-সংগ্রামের একটী নির্ম্মম দৃষ্টান্ত। দশম শতাব্দীতে এই সংগ্রাম ধর্ম্মসংগ্রামরূপে প্রকাশ পায়। বাংলার ছড়া
“আগডোম বাগডোন ঘোড়াডোম সাজে...
সাজতে সাজতে পড়ল সাড়া
সাড়া গেল বামুন পাড়া”
সেই সংগ্রামের স্মৃতি জাগাইয়া রাখিতেছে। এই সময়ের ইতিহাসে বৌদ্ধ দলন দেখিতে পাওয়া যায়। রাঢ় দেশের শূরেরা এবং পূর্ব্ববঙ্গের বর্ম্মণেরা বিদেশাগত এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী। তাহারা বাঙ্গালীর গলায় লৌহশৃঙ্খল পরাইতে আরম্ভ করে। পরে কর্ণাটাগত সেনেরা তাহা সম্পূর্ণ করে। এই সময় হইতে একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদিগের অত্যাচার, অন্যদিকে বৌদ্ধ বাঙ্গালীদের বিক্ষোভ—এই দুই অবস্থা সম্মিলিত হইয়া মুসলমান-তুর্কীদের দ্বারা বাঙ্গলা বিজয় সহজ করিয়া দেয়। এই যুগে বাঙ্গলা সাহিত্যের যাহা কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, “সূর্য্যের পাঁচালী”, “শূণ্য-পুরাণ” ইত্যাদি——তাহাতে আমরা বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী গণশ্রেণীর সংবাদ পাই। এই সময়ের ধর্ম্মপূজা সংক্রান্ত ‘ধর্ম্ম-মঙ্গল”ই বাঙ্গলার Epic (মহাকাব্য) বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত। ইহাতে ধর্মঠাকুরের ভক্ত লাউসেনের যুদ্ধ বিবরণ আছে। ইহাতে আমরা সংবাদ পাই যে সম্রাট ধর্মপালের শ্যালিকা পুত্র কামরূপ-বিজয়ী লাউসেনের দক্ষিণ হস্ত ছিল কালুডোম। এই মহাকাব্যে দেখি ডোম সেনাপতি, মেটে (বাগদী জাতির একটী শাখা) জাতীয় ইন্দ্র গৌড়ের সহর কোটাল, একজন চণ্ডাল ঢেকুরের সহর কোটাল (বোধ হয় এই পদ এই জাতীয় লোকেরাই গ্রহণ করিত, সেই জন্য আজও এই জাতি পশ্চিম বঙ্গে 'কোটাল' নামে পরিচিত), আর ঢেকুরের সামন্ত ইছাই ঘোষ সম্ভবতঃ গোয়ালা। আর্যমঞ্জুশ্রী কথিত পাল রাজাদের জাতি এবং তাহাদের সামন্ত ও কর্ম্মচারীদের জাতি দেখিয়া তৎকালীন বাংলার সমাজের স্বরূপ কিঞ্চিৎ বোঝা যায়। আজ যাঁহারা অধঃপতিত সেই সময়ে তাঁহারাই উচ্চবর্ণের এবং শাসকশ্রেণীর লোক ছিলেন। এই যে বাংলার সামাজিক পট সেন যুগ হইতে, পরিবর্ত্তিত হইয়া বর্ত্তমান আকার গ্রহণ করিয়াছে সেই নির্মমতার কোন স্মৃতিই বাংলা সাহিত্যে নাই। তৎপরে ব্রাহ্মণ যুগে আমরা উচ্চশ্রেণীর শৈব ধর্ম্ম ও গণশ্রেণীদের ধর্ম্মের সংগ্রাম 'মনসার ভাসান' বা ‘মনসা-মঙ্গল' গ্রন্থে দেখিতে পাই।
ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, বাঙ্গলার পালেরা মহাযানী বৌদ্ধ ছিলেন এবং মহাযানের তান্ত্রিক শাখা এবং ব্রাহ্মণ্য শৈব-তান্ত্রিকদের সহিত অনেক মিল ছিল। ঐতিহাসিকদের অনুমান যে মহাযান ধর্ম্ম তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের সহিত এত নৈকট্য সম্পাদন করিয়াছিল যে শেষে উভয়ে একীভূত হইয়া যায় {শঙ্করাচার্য্যের “প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ” অপবাদ তাহাই ইঙ্গিত করে)। এই জন্যই বাংলার অভিজাতবর্গ হয় মহাযানী না হয় তান্ত্রিক ছিল। লক্ষণ সেনের আদেশে পণ্ডিত হলায়ুধ লিখিত—“ব্রাহ্মণ-সর্ব্বস্ব” নামক পুস্তকে স্বীকৃত হইয়াছে যে বারেন্দ্র ও রাঢ়ী ব্রাহ্মণেরা সব তান্ত্রিক ধর্ম্মাবলম্বী ছিল। বৈদিক আচার দেশে অনুসৃত হইত না। অন্যদিকে নিম্নস্তরের জনসাধারণ হীনযান, সহজযান, নাথ ধর্ম্ম ও অন্যান্য পন্থাবলম্বী ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রচলনের (লক্ষণ সেনাদেশে পশুপতি লিখিত “মৎস-সুক্ত” দ্রষ্টব্য) সঙ্গে দেখিতে পাওয়া যায় যে উচ্চ শ্রেণীরা হয় তান্ত্রিক না হয় শাক্ত এবং তাহাদের সহিত গণসাধারণের ধর্ম্মের সংঘর্ষ হইতেছে। মনসা পূজার পুস্তকে তাহা ভালভাবে দেখা যায়। মহেনজো-দাড়োতে যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহাতে দৃষ্ট হয় যে ৫০০০ বৎসর পূর্ব্বেও সাধারণ লোকে অশ্বত্থ গাছ ও নানা প্রকারের জন্তু ও লিঙ্গ— পূজা (Phallic Worship) করিত; এই ধর্ম্ম আজও পর্য্যন্ত অন্তঃসলিলার ন্যায় ভারতে চলিতেছে। ইহারই উপর বৈদিক ধর্ম্ম আরোপিত হয়। কিন্তু বাঙ্গলার অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদের সহিত ইহার ঠিক রফা হয় নাই; তাই মনসার ভাসানে দেখি ধনী চাঁদ সওদাগর বলিতেছেন:
“যে হাতেতে পূজি আমি দেব শূলপাণি
সে হাতে পূজিব আমি কাণি চ্যাঙ্গমুড়ি!”
“হরিদ্রার বদলে পাইলাম কাঁচা সোনা।
বলিয়া পুঁথিতে উল্লিখিত আছে। আজকালকার পক্ষে এই পুস্তকের সর্ব্বাপেক্ষা বড সংবাদ যে তৎকালে বাঙ্গলার হিন্দুর মধ্যে বিধবা-বিবাহ প্রচলিত ছিল। এই বিবাহকে ‘সাঙ্গ।’ বলিত, এক্ষণে উক্ত জেলার মুসলমানদের বিধবা-বিবাহকে এই নামে অভিহিত করা হয়। পশ্চিমে হিন্দি-ভাষীদের মধ্যে ইহাকে ‘সাগাই’ বলা হয়। এই পুস্তকে বীর বলিতেছে[২]—
“গন্ধবণিক আমি সাবধানে শুন তুমি
‘সাঙ্গা’ কেমন আমি নাহি জানি।
তোরা ত বৈশ্যের ঝি অসম্ভব আছে কি
‘সাঙ্গা’ তোদের আছে পূর্ব্বাপর॥”
পুনঃ, বেহুলাকে পুনঃ স্বামী গ্রহণ করিবার অনুরোধও বিভিন্ন লোক দ্বারা করা হইয়াছে। এতদ্বারা নিদ্দিষ্ট হয় যে তৎকালে স্বাধীন হিন্দু রাষ্ট্রে বৈশ্য ও শূদ্রদের মধ্যে বিধবা-বিবাহ প্রচলিত ছিল। এই প্রথা পশ্চিমের হিন্দি-ভাষী শূদ্রদের মধ্যে আজও প্রচলিত আছে। কিন্তু একটা খটকা উঠে, গন্ধবণিক নিজেকে কি প্রকারে বৈশ্য হইতে পৃথক করিতেছে? স্মৃতি অনুসারে গন্ধবণিক ও বৈশ্য বর্ণের অন্তর্গত; যাঁহারা ব্যবসায় বৃত্তিধারণ করেন তাঁহারাই বৈশ্য বা বেণিয়া। অবশ্য বৈদিকযুগে বৈশ্য বা বিশ্ অর্থে কৃষক ছিল। গ্রন্থকার কি বৈশ্য অর্থে কোন নির্দ্দিষ্ট ব্যবসায়ী জাতিকে লক্ষ্য করিতেছেন? বোধ হয় এই স্থলে বর্ণাপেক্ষা শ্রেণী বিভাগ দ্বারা ব্যবসায়ী জাতিরা চিহ্নিত হইতেছেন কারণ
“উজানী নগরে ঘর সাহরাজা নৃপবর,
তার কন্যা বিপুলা সুন্দরী”।
“গন্ধবণিক সে যে চম্পকেতে ঘর।
রাজা হইয়া প্রজা পালে সুখে চন্দ্রধর।”
এতদ্বারা ধনকুবের গন্ধবণিকদের উচ্চশ্রেণীর অভিজাতদের মধ্যে গণ্য করা হইয়াছে। সেই জন্যই অনুমিত হয় যে তৎকালে অভিজাতদের মধ্যে বিধবা বিবাহ ছিল না, কেবল নিম্নস্তরের বৈশ্য ও শূদ্রের মধ্যে তাহা আবদ্ধ ছিল। আজও নমশূদ্র ও দুলে প্রভৃতি জাতিদের মধ্যে বিধবা-বিবাহ অপ্রচলিত নহে (নমশূদ্র বিধবা কন্যার বিবাহ লেখক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে বলিতেছেন)। পশ্চিমেও তথাকথিত উচ্চজাতিদের মধ্যে বিধবা-বিবাহ প্রচলিত নাই।
বোধহয় সমস্ত বাঙ্গলা মুসলমানাধীনে আসিলে এবং সর্ব্বত্র বাঙ্গলার নবব্রাহ্মণ্যবাদ প্রচলিত হইলে বিধবা বিবাহ উঠিয়া যায়। সকলেই ব্রাহ্মণ্যআচার আজ পর্যন্ত নকল করিয়া আসিতেছেন। সেই জন্য জনসাধারণের মধ্যে তাহা আর আদৃত হয় না। এই কবিতার আর একটি দুষ্টব্য যে নারায়ণদেব নিজের পরিচয়ে বলিতেছেন,
“মদকূল্য গোত্র হৈল গাঞন গুণাকর।
ক্ষত্রকুলে জন্ম সংকায়স্থের ঘর।”
উপরোক্ত গন্ধবণিকের ও কায়স্থের পক্ষে স্বাধীন হিন্দু-রাষ্ট্রের ব্যবস্থা আজ পরস্পর বিসম্বাদী ও আশ্চয্যজনক বলিয়। বোধ হইবে। কিন্তু সপ্তদশ খৃষ্টাব্দের বৈষ্ণব সাহিত্যান্তর্গত “প্রেম-বিলাস” গ্রন্থে (পৃঃ ২৬২) কায়স্থদের “ক্ষত্রিয় কায়স্থ” বলা হইয়াছে। এই সব সাহিত্যিক প্রমাণ দ্বারা এই তথ্যই নিশ্চিতরূপ বুঝা যায় যে শ্রেণী-সংগ্রাম বর্ণ বা জাতি-সংগ্রামরূপে ভারতের সমাজে কার্য্য করিতেছে, তদ্বারা সামাজিক শ্রেণী বা জাতিদেরও বিভিন্ন যুগে পদমর্য্যাদার পরিবর্ত্তন হইতেছে।
তুর্কি মুসলমান শাসনের প্রাক্কালে বাঙ্গলার সামাজিক অবস্থা আমরা “আদ্যের গম্ভীরার” উদ্ভব থেকে কিঞ্চিৎ অবগত হই। সেই সময়ে সদ্ধর্ম্মী বা বৌদ্ধদের অবস্থা বিষয়ে শ্রীহরিদাস পালিত বলিতেছেন,—“স্থায়ীদেহারাগুলি যখন মুসলমানগণ ভাঙ্গিয়া দিল, তাহাদের প্রতি অত্যাচার আরম্ভ করিল, তখন ধর্ম্মপূজার জন্য অস্থায়ী দেহারা নির্ম্মাণ করিতে হইত। এবং পূজান্তে “দেহারাভঙ্গ” বলিয়া মুসলমান-প্রীত্যর্থে হিন্দু দেবদেবীকে মুসলমান হইবার কথা শুনাইয় মুসলমানদের সন্তোষবিধান করিবার উদ্দেশ্যেই ‘দেহারা ভঙ্গে’ হিন্দুদের প্রতি অযথা আক্রমণ-সূচক গীত হইত। (“আদ্যের গম্ভীরা” পৃঃ ১১৮-১১৯)। বিভিন্ন গানেই ইহা ব্যক্ত হইয়াছে,—
মৃত্তিকার গড ভঙ্গের শেষের গান:—
“ভাঙ্গিতে নারিল মৃত্তিকার সহিঘর।
স্থান বেড়িয়া যে বসিল পেকাম্বর॥
কাজিমোল্লা কিতাব পড়ে বসি।
তা দেখাকরা খোদার মনো খুসি॥” (পৃঃ ১২০)
বড়জানানি:—
“পশ্চিম মুখে খোনকার করন্তি সেবা।
দুই পায়ে কলু খোনকারের হাতে চোক দাই।
সুরা চুরি কর্যাছিল হাত কাটা গেল।।
এক ব্রাহ্মণ ভাই পলাইয়া যায়।
ধরিয়া আনিয়া তারে নেবাজ করায়॥
আর ব্রাহ্মণ পালায় গুড়ি গুড়ি।
মাথায় তুলিয়া দিল হেড়ার চুবড়ি॥” (পৃঃ ১২১)
শূণ্য-পুরাণের “নিরজনের রুক্ষ্ম।” এই প্রকার অবস্থার আর একটি প্রমাণ। এই সব সাহিত্যিক প্রমাণ দ্বারা বোধগম্য হয় যে বৌদ্ধগণ মুসলমানের দ্বারা ব্রাহ্মণ্যবাদীর ন্যায় নিপীড়িত হইলে ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ প্রণোদিত হইয়া মুসলমানের প্রীতিভাজন হইবার বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিল। ইহা ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় অভিজাত শ্রেণীর সহিত সাধারণ বৌদ্ধের সঙ্ঘর্ষেরই ফল! আবার এই যুগে বৌদ্ধধর্ম্ম কি প্রকারে বাঙ্গলার বর্ত্তমান হিন্দুধর্মের অন্তর্গত হইয়া যায়, তাহার দৃষ্টান্ত আমরা এই পদে পাই
“আপনি ত্যজিলেন প্রাণ দেব নিরঞ্জন।
বাম ঊরুভাগে হইল ধর্ম্মের শাসন।
বিষ্ণু হৈল কাষ্ঠ তাতে ব্রহ্মা হুতাশন।
বাম উরু ভাগে পোড়া গেল নিরঞ্জন।”
অন্যদিকে হিন্দুর ‘সত্যনারায়ণ' পূজাকে ‘সত্যপীর’ নামে পূজা করিয়া হিন্দু প্রচ্ছন্নভাবে নিজের ধর্ম্মকর্ম্ম চালায়।
ইহার পর আছে মোগল শাসনের প্রাক্কালে কবিকঙ্কণের চণ্ডী। মোগলশাসনের প্রচলন সঙ্গে বাঙ্গলার রাজনীতিক্ষেত্রে সামন্ত-তন্ত্রের যুগ শেষ হইয়া যায়। মোগলেরা ভারতে কেন্দ্রীভূত শাসন-প্রণালী প্রচলন করেন। এই সময় হইতে বাঙ্গলায় যাঁহারা ‘জমিদার’ আখ্যা পাইতেন তাঁহারা দুর্গবাসী সামন্তরাজাও নন বা Manor নিবাসী ব্যারণও নন। তাঁহারা কেবল খাজনা আদায় করিবার চুক্তিবদ্ধ কর্ম্মচারী (ফ্রান্সের Farmer General-এর ন্যায়)। পরবর্ত্তীকালের সাহিত্য আলোচনা কালে এই কথাটি আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে। কবিকঙ্কণের চণ্ডী তৎকালীন বাঙ্গলার একটী realistic (বাস্তব) চিত্র প্রদান করিয়াছে। তাহাতে নিখুঁত ভাবে পশ্চিম বঙ্গের সামাজিক চিত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতির পেযা, সামাজিকপদ এবং রীতি প্রভৃতি যাহা এই পুস্তকে বর্ণিত হইয়াছে তাহার সহিত আজকালকার কোন মিল নাই। কবি বলিতেছেন, “বর্ণ-দ্বিজগণ মঠপতি”। ৺হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই তথ্যের উপর নির্ভর করিয়া বলিয়া গিরাছেন যে বর্ত্তমানের বর্ণ-দ্বিজগণ পুরাতন বৌদ্ধ পুরোহিত ছিলেন। পুনঃ, কবি বলিতেছেন,
“শরাক আইসিয়া বসে, জীবজন্তু নাই হিংসে,
সর্ব্বস্থানে তারা নিরামিস।
পাইয়া প্রধান বাড়ী, বুনে তসরের ষাড়ী,
দেখি বীর হৈলা হরিস”॥
নগরে অনেক যোগী, বসিলা ভিক্ষার ভোগী;
কেহ বুনে বসন কম্বল।”
আজ এই যোগী বা জুগি সম্প্রদায় এই বৃত্তি অবলম্বন করেন না। তাঁহারাও নাম পরিবর্ত্তন করিয়া “নাথ” নাম গ্রহণ করিয়াছেন। আবার,
“বিষম করাল, রাঘব ঘোষাল,
করবাল মারে বীরের অঙ্গে”।
এই স্থলে ব্রাহ্মণ সৈনিকের সংবাদ পাওয়া গেল, বিজয় গুপ্তের পদ্মাপুরাণেও এই সংবাদ আছে। পুনঃ, বাগ্দী, হাড়ী ও ডোম জাতির লোকেরা পাইক হইত। আবার, “আসরী নিবসে পুরে, আপনার বৃত্তি করে”। অনুমিত হয় যে এই বৃত্তি কৃষিকর্ম্ম। আজ কিন্তু এই জাতি নিজের নাম পরিবর্ত্তন করিয়া বাঙ্গলা তাঁহাদের “বিমাতৃদেশ” বলিতেছেন! কবি আর একটি জাতির সংবাদ দিতেছেন: “কায়স্থরা ভব্যজন নগরের শোভা” বলিতেছেন এবং এই জাতীয় ভাঁড়ুদত্তকে বীরের মন্ত্রী পদপ্রার্থী রূপে কবি বর্ণনা করিয়াছেন। পুনঃ, গোয়ালাদের বিষয় কবি বলিয়াছেন—গোপ দুই প্রকার: বণিক গোপ ও পল্লব গোপ। কিন্তু আজ চারি প্রকারের গোপ দৃষ্ট হয়। তদ্রূপ, তেলী ছিল তিন প্রকার: “কেহ চাষী, কেহ ঘনা, কিনিয়া বেচয়ে কেহ তেল”। কিন্তু আজ পশ্চিম বঙ্গে তেলী অদৃশ্য! তাঁহারা নাম পরিবর্ত্তন করিয়া তিলি হইয়াছেন যদিচ একদল এখনও কৃষিকর্ম্ম করেন। আর ঘনারা এক্ষণে “কলু” নামে পরিচিত। অন্যপক্ষে, পূর্ব্ব-বঙ্গে বা বাঙ্গলার অন্যত্র “তেলী” নামে একটা জাতি গভর্ণমেণ্টের তফসীল ভুক্ত জাতির তালিকা মধ্যে দৃষ্ট হয়। শেষে একটা বড় সামাজিক সংবাদ-যাহা ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদেরা বাদ দিয়া গিয়াছেন, তাহা হইতেছে যে বাঙ্গলার হিন্দু সমাজে “রাজপুত্র” বা “রাজপুত” বলিয়া একটী জাতি ছিল। কবিকঙ্কন কালকেতুর মুখ দিয়া ভাড়ুদত্তকে গালাগালি দেওয়াইতেছেন:
“হয়্যা তুই রাজপুত, বলাসি কায়স্থ সুত
নীচ হয়্যা উচ্চ অভিলাষ।”
এতদ্বারা আমরা এই সংবাদ পাই যে বাঙ্গলায় ‘রাজপুত্র' বা ‘রাজপুত' নামে একটী জাতি ছিল। 'সেখ শুভোদয়া' ও 'বল্লালচরিত' গ্রন্থে ‘রাজপুত্র’ জাতির উল্লেখ আছে। কিন্তু শেষোক্ত গ্রন্থে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ন্যায় রাজপুতকে অনুলোমজাত “বর্ণ-সঙ্কর” জাতি বলা হইয়াছে। কোন অজ্ঞাত কারণে এই জাতি বাঙ্গলায় সম্মান পায় নাই। পূর্ব্বোক্ত নারায়ণদেবে “জাতমরা রাজপুত” উক্তি আছে। এই যুগেই বৃহস্পতি বলিতেছেন
“রাজপুত্র সহদান আর গ্রহণ সম্বন্ধ যে জন করে।
নিশীথে নলিনী নাশ পায় যেমতি তেমভি তার কুল হরে”
(‘বঙ্গজ কায়স্থ কারিকা’- ৺নগেন্দ্র বসুর রাজন্য কাণ্ড, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৯৮)।
পুনঃ, নুলাপঞ্চানন বলিয়া গিয়াছেন,
“রাজপুত ক্ষত্র হতে বদ্ধ পরিকর।
আদি শুদ্ধ ক্ষত্র নাই, বর্ণের সঙ্কর”
মিথিলা বা উত্তর বিহারেও ‘রাজপুত’ আদৃত নয়। তথাকার ক্ষত্রিয় বর্ণের লোকেরা নিজেদের ‘ছত্রি’ বলেন।
এক্ষণে কথা উঠে বাঙ্গলার সমাজে এই জাতি কোথায় গেল! আজ যাহারা ‘রাজপুত' বলিয়া বাঙ্গলায় পরিচয় প্রদান করেন, তাঁহারা পশ্চিমা জাত ঔপনিবেশিক, তাঁহাদের অনেক গুষ্ঠির সহিত পশ্চিমের আদান প্রদান আজিও চলে এবং তাঁহারা মিতাক্ষরা আইন দ্বারা শাসিত। কিন্তু উত্তর-ভারতের অন্যান্য স্থানের ন্যায় বাঙ্গলায় ও একটা “রাজপুত্র” জাতির উদ্ভব হইয়াছিল বলিয়া এই সব সাহিত্যিক সাক্ষ্য দ্বারা অনুমিত হয়। পরে, সপ্তদশ শতাব্দীর ‘প্রেম-বিলাসে’ ‘ব্রহ্ম ক্ষেত্রি’ (সেন রাজবংশের জাতি) জাতিরও উল্লেখ আছে। এই সব সামাজিক জাতি বাঙ্গলার হিন্দু সমাজ-শরীর হইতে গেল কোথায়? যখন রঘুনন্দন বলিলেন, বাঙ্গলায় কেবল ব্রাহ্মণ ও শূদ্র আছেন, তখন এই জাতি উদ্ভূত বংশ সমূহের সামাজিক পদ-মর্যাদা কি ছিল এবং পরে কি হইল? আমরা স্পষ্টই দেখি ‘প্রেম-বিলাস’ রঘুনন্দনের বহু পরে রচিত হয়। কুলজী গ্রন্থ হইতেই ইহার উত্তর বাহির করিতে হবে।
দ্বিজ বাচস্পতির বঙ্গজ কুলজীসার গ্রন্থে লিখিত আছে:— “এতে সপ্তবিংশতি কায়স্থাঃ বংশহেতুঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ। এতদ্ভিন্না রাজপুত্রাঃ ন কায়স্থাঃ কদাচন” (৺নগেন্দ্র বসুর রাজন্য কাণ্ড ১ম খণ্ড পৃঃ ৯৪)। এই শ্লোকের যে অর্থই বৈয়াকরণিকেরা করুন, ইহার সরল অর্থ—কায়স্থদের মধ্যে কেবল সাতাইস ঘর কায়স্থ, বাকি সব রাজপুত! (লেখকের কাছে নগেন্দ্র বাবু এই অর্থই গ্রহণ করিয়াছিলেন)। লেখককে দুইজন বিশিষ্ট লোক বলিয়াছেন, বীরভূম জেলার ‘রাজপুত’ নামধারী কতকগুলি বংশ আছে, তাঁহারা উপবীতধারী নন, পূর্ব্বে তাঁহাদের সহিত কায়স্থেরা বিবাহ করিতেন না, এক্ষণে তাঁহারা মৌলিক শ্রেণীর কায়স্থ বলিয়া পরিচয় দিতেছেন! পুনঃ, সিংহ উপাধিধারী পশ্চিমাগত রাজপুত জাতীয় বংশ সমূহ বাঙ্গলার সর্ব্বত্র কায়স্থ সমাজে প্রবেশ করিয়াছেন। কায়স্থ কুল পঞ্জিকাসমূহ। (মালাধর ঘটকের দক্ষিণ রাঢ়ীয় কারিকা দ্রষ্টব্য) এবং জনশ্রুতি তাহার সমর্থন করে। এক্ষণে সাহিত্যের মধ্য হইতে দুই চারিটী কথা দ্বারা আমাদের সামাজিক চিত্রের পুনরাঙ্কন করিতে হইবে। টডের “রাজস্থান” বাঙ্গলার পাঠকদের এই ধারণা উৎপাদন করিয়াছে যে “রাজপুত” বলিলে রাজপুতানা বা নিকটস্থ মধ্যদেশের “সিংহ” উপাধিধারী গোঁপদাড়ীওয়ালা একজন ব্যক্তি (নধর কাস্তি বাঙ্গালী রাজপুত হওয়া এদেশের লোকের মনে বোধ হয় বিসদৃশ ঠেকে)। হর্ষবদ্ধনের পরে যখন উত্তরভারতে সর্ব্বত্র “রাজপুত” জাতির উদ্ভব হয়, বাঙ্গলা তখন যে সেই বিবর্ত্তনের বাহিরে ছিল, তাহারই বা প্রমাণ কি? সব রাজপুত “ছত্রিশকুল” অন্তর্গত নহে। তৎপর, পাল রাজাদের সামন্তদের মধ্যে ও “সিংহ” উপাধিধারী নাম প্রাপ্ত হওয়া যায়। পুনশ্চ, রাজপুতানার রাজপুতদের মধ্যে সাধারণতঃ উপবীত ধারণ করা প্রথা নাই (লেখকের কোন পূর্ণবয়স্ক রাজপুত বন্ধু বলেন, তাঁহার এখনও উপনয়ন ক্রিয়া হয় নাই)। তদ্রূপ বৈশ্যদেরও উপবীত ধারণ করার প্রথা নাই। তবে আজকাল এই সব জাতির মধ্যে পৈতা পরার প্রথা প্রচলিত হইতেছে। বাঙ্গলার উপবীতের অভাবে যখন রঘুনন্দন বাঙ্গলার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের শূদ্র মধ্যে গণিলেন, তখন তিনি কেবল কতকগুলি পুরাতন স্মৃতি পুস্তকের নির্দেশ অনুযায়ী অভিমত প্রকাশ করিয়াছিলেন। বাস্তব সমাজতত্ত্বকে তিনি উপেক্ষা করিয়াছিলেন। বাঙ্গলায় এক সময়ে ব্রাহ্মণদের সর্বদা উপবীত ধারণ করার প্রথা ছিল না। এই বিষয় ৺দীনেশ চন্দ্র সেন বলিয়াছেন “ব্রাহ্মণদের গলায় উপবীত সর্ব্বদা থাকার কোন বাঁধাবাঁধি নিয়ম ছিল না, অনেক সময় বস্ত্রাদির ন্যায় উহা টাঙ্গাইয়া রাখা হইত, বাহিরে যাইবার সময় তাহা ব্যবহারের প্রয়োজন হইত। এই রীতি মহাপ্রভুর সময় পর্য্যন্ত ছিল তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কোন কোন পরিবার যে উপবীত-বিরহিত হইয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ স্বরূপ বহুদিনের প্রবাদবাক্যে রহিয়াছে—‘পৈতা ছাড়ি পৈতা লয় বৈদিকে দেয় পাতি' (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য—হিন্দু—বৌদ্ধ যুগ, পৃঃ ৬৪) এই সব ভাব দৃষ্ট হইয়াছে। রঘুনন্দন শ্রেণী স্বার্থ প্রণোদিত হইয়া কাল্পনিক সমাজ ব্যবস্থা প্রদান করেন।
এই সব উক্তিদ্বারা আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য যে বাঙ্গলার একটা রাজপুত বা রাজপুত্র নামে জাতি ছিল। বোধ হয় তাহারা সমাজে শক্তিশালী হইতে পারেনি। আর, পৌরাণিক গল্পের উপর ভিত্তি করিয়া পণ্ডিতেরা তাহাদের অনুলোমজাত বর্ণ-সঙ্কর বলিয়া দোষযুক্ত করেন। পরে, তাহারা কায়স্থ জাতির মধ্যে মিশিয়া যায়। বাঙ্গলা সাহিত্যে ইহার কোন চিহ্নই নাই। বল্লালচরিতোক্ত ক্ষত্রিয় বংশগুলিই বা গেল কোথায়? হিন্দু-রাজত্বের পতনের পর, হিন্দু শাসক শ্রেণীর অন্তর্গত জাতিগুলির অনেক পদমর্য্যাদার পরিবর্ত্তন হয়। এই যুগের সাহিত্যে আমরা বাঙ্গালীকে সৈন্যশ্রেণীর মধ্যে দেখিতে পাই। “মাধবাচার্য্যের চণ্ডীতে আমরা ব্রাহ্মণ পাইক, কর্ম্মকার পাইক, চামার পাইক, নট পাইক, বিশ্বাস পাইক ও বাঙ্গাল পাইকদের বিবরণ দেখি (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, পূঃ ৪৩২) কিন্তু এই সঙ্গে সাহিত্যে বাঙ্গালী সিপাহীর যে বর্ণনা আছে তাহাতে তাহাকে অরিন্দম ও দুর্দ্ধর্ষ বলিয়া চিত্রিত করা হয় নাই! মাধবের চণ্ডীতে উক্ত আছে,
“যতেক ব্রাহ্মণ পাইক পৈতা করি করে।
দন্তে তৃণ করি তারা সন্ধ্যামন্ত্র পড়ে”।
মুসলমানদের লিখিত ফার্সী ইতিহাসে বাঙ্গালী পাইকের নিন্দা আছে।কথিত আছে তাহাদের অকর্ম্মণ্যতা দেখিয়া বাদশাহ হুসেন সাহ তাহাদের পল্টন সমূহ ভাঙ্গিয়া দেন। অবশ্য ইহা এক তরফের কথা। এতদ্বারা আমাদের ইহাই বোধগম্য হয় যে, স্বাধীনতার অভাবে বাঙ্গালার সৈনিকের কী মানসিক অবনতি হইয়াছিল। গ্রীসের পতন পর সে দেশের সৈনিকেরও এই অবস্থা হইয়াছিল। পালযুগের দেবপাল দেবের ব্যাঘ্রতটী মণ্ডলের (রাজসাহী জেলা) সামন্ত বলবর্ম্মা সর্ব্বদাই শত্রুকে যুদ্ধ দিতে প্রস্তুত ছিলেন।(নালন্দা তাম্র লিপি—Ep-Ind-vol. 17)। পুনঃ, দেবপালের অনুজ কামরূপ বিজয়ী জয়পাল ও ধর্ম্মপালের মন্ত্রী কেদার মিশ্র ও তাহার পূর্ব্বজ দর্ভপাণি মিশ্রের যুগ বাঙ্গলায় তখন অন্তর্হিত হইয়াছিল। আবার, পালযুগের শেষে ঢেকরীর মহামান্ডলিক ঈশ্বর ঘোষের পূর্ব্বজ ধবল ঘোষ—যাঁহার বীরত্ব গাথা সূতেরা গাহিত (সূতো জগতি গীত মহাপ্রতাপ—Inscriptions of Bengal vol. ও No. 17), সেই প্রকারের বীর-গাথার যুগ আর বাঙ্গলায় ছিলনা। পরাধীনতার যুগে সাহিত্যিকেরা অন্যরস ও রূপ অঙ্কিত করিতে থাকেন।
মোগল যুগের পূর্ব্বের ও সমসাময়িক কুলগ্রন্থ সমূহ সাহিত্য মধ্যে গণ্য না হইলেও তন্মধ্যে অনেক সামাজিক সংবাদ পাওয়া যায়। দেবীবরের ‘মেলবন্ধনের’ পুস্তকে দৃষ্ট হয় যে, ‘জাত মারামারি' অন্ততঃ ব্রাহ্মণদের মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়া গিয়াছিল এবং তাহার ফলে হিন্দুসমাজ বিপর্য্যস্তও হইয়াছিল। পুনঃ, রাঢ়দেশে ব্রাহ্মণদের স্বহস্তে লাঙ্গল পরিচালনা করিতে দেখিয়া সেই দেশকে গালাগালি দিয়া তিনি প্রত্যাবর্ত্তন করেন। তখনকার সামাজিক অবস্থার চিত্র আমরা নিম্ন পুঁথিতে পাই:
“কাজীর বেটা জাফর আলী নবাই বান্দারে।
নন্দবন্দ্যোস্থতা ঘরে আফিং বিহরে”॥
(“দোযচন্দ্র—প্রকাশ” কুমুদবন্ধু মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনীতে’ উদ্ধৃত)
“কাশীশ্বরসুত হরিহর ফুলিয়ার মুথৈটী।
ভাল বিভা হৈল তোমায় জুনিখানের বেটী”॥
“কুলতত্ত্ব প্রকাশিণী”—৺নগেন্দ্র বস্তুর ব্রাহ্মণকাণ্ড ২য় খণ্ড, পৃঃ ৮২ উদ্ধৃত)
পুনঃ, “বৃহম্পতিজ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে ত্বকচ্ছেদ দোষঘটে।”
এতদ্বারা এই সূচিত হয় যে এই ব্রাহ্মণ এক সময়ে মুসলমান হইয়াছিলেন। দেবীবর ঘটক ১৪৮০ খৃঃ মেলবন্ধন করিয়া জাতে ঠেকোদের পারস্পারিক বিবাহের সুবিধা করিয়া দেন।
যাঁহারা হিন্দুসমাজ সনাতন বলেন এবং বর্ত্তমানের সামাজিক বাতাবরণ বেদে আবিষ্কার করিবার প্রয়াস পান, আর সব অনুষ্ঠানই ‘ব্যাদে আছে’ বলিয়া দাবী করেন, এবং বলেন হিন্দুসমাজ অপরিবর্ত্তনীয় আদর্শে পরিচালিত হইতেছে, তজ্জন্য যুগোচিত যে কোন সংস্কার প্রচেষ্টার পরিপন্থী হইয়া তাঁহারা ‘ধর্ম্ম ও সমাজ গেল’ বলিয়া চিৎকার করেন, তাঁহাদের অবগতির জন্যই সাহিত্য হইতে এই সব ঘটনা এই স্থলে যৎকিঞ্চিৎ উদ্ধৃত হইল। হিন্দুসমাজ অপরিবর্ত্তনীয়ও নহে এবং সমাজও একস্থানে স্থানুবৎ নিশ্চল হইয়া থাকে না।
এক্ষণে মোগল যুগে প্রত্যাবর্ত্তন করা যাক। মুকুন্দরামের সময়ে বাঙ্গলার সামন্ত-সংঘের সহিত মোগলদের বাঙ্গলার আধিপত্য লইয়া ভীষণ যুদ্ধ চলিতেছিল। এই যুদ্ধে হিন্দু ও মুসলমান সামন্তেরা একযোগে মোগলের বিপক্ষতাচরণ করিয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্যের পিতাকে “আকবর নামা” পুস্তকে বলা হইয়াছে “Srihari, the other self of Daud Khan” (শ্রীহরি হইতেছে দাউদ খাঁর আর একটী আত্ম।)। এই সংযোগকে ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য মানসিংহ রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের উত্থান করান! তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা লাঙ্গল ধরিতেন তাঁহারা তাহা পরিত্যাগ করিলেন। মোগল যুগের বেশীর ভাগ জমিদারই রাঢ়ী ব্রাহ্মণ (কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় 'নবাবী আমলের বাঙ্গলা' দ্রষ্টব্য)। পশ্চিম বঙ্গে অনেক ব্রাহ্মণ মানসিংহের কাছ হইতে ব্রহ্মস্ব জমি প্রাপ্ত হন (কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়—‘মধ্যযুগের বাঙ্গলা’)। ইঁহারা ভূলিয়া গেলেন যে মানসিংহ মোগলের পক্ষ হইয়া বাঙ্গলার গলায় পরাধীনতার শৃঙ্খল পরাইতে আসিতেছিলেন। তাই মুকুন্দরামে আমরা দেখি তিনি তাঁহার পুস্তকে লিখিয়াছেন: “ধন্য রাজা মানসিংহ, বিষ্ণুপদাম্বুজে ভৃঙ্গ, গৌড়বঙ্গ উৎকল অধিপ।” হিন্দু সামন্তরা পরাজিত হইবার পর কায়স্থ জাতির পূর্ব্ব মর্য্যাদা আর রহিল না। পশ্চিমাগত ‘রাজপুত’ এক্ষণে বাঙ্গলায় বসবাস করিয়া উচ্চমর্য্যাদা প্রাপ্ত হইত লাগিল। এই স্থলে ইহাও জ্ঞাতব্য যে মানসিংহের দুইটি বাঙ্গালী স্ত্রী ছিলেন; প্রথমটি কুচবিহারের চিলারায়ের কন্যা, দ্বিতীয়টি অপর কোন রায়ের কন্যা (‘আকবর নাম।’ ও সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় যদুনাথ সরকারের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য! পূর্ব্বে কেহ অনুমান করিয়াছিলেন ইনি হয়ত কেদার রায়ের কন্যা (খৃঃ ১৯০৫-৬ সালের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা দ্রষ্টব্য)।
বাঙ্গলার এই রাজনীতিক ভাগ্য-বিপর্যয়ের কথা মুকুন্দরামে আমরা পাই না। আমরা ডিহিদার মামুদ সরিফের অত্যাচারের কথা পাই; আর পাই রাজা ও জমিদারদের কর্ম্মচারীদের দ্বারা প্রজাপীড়ণের কথা। আর সর্ব্বহারা গরীবদের সংবাদ আমরা বারমাস “অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা” দ্বারা বোধগম্য করি! কিন্তু আশ্চর্য্যর বিষয় এই যে, যদিও বাঙ্গলায় তখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান হইয়াছিল, তবুও প্রাচীনযুগ হইতে সংস্কৃত সাহিত্যে পণ্ডিতেরা যে খাত কাটিয়া দিয়াছেন, তাহার মধ্য দিয়া কবিকঙ্কণের চণ্ডীও প্রবাহিত হয়। সেই জন্য যেমন একদিকে ব্রাহ্মণ্য আদর্শের বিপক্ষাচরণ করিয়া চণ্ডীর মহিমা বাড়াইবার জন্য একজন অস্পৃশ্য ব্যাধকে রাজা সাজাইয়াছেন, তেমনই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ভাবধারা ধরিয়া কলিঙ্গ রাজাকেও খাড়া করিয়াছেন, আর কালকেতু হইয়াছে তাহার সামস্ত! পুনঃ, গোঁড়া বর্ণাশ্রমীয় হিন্দুসমাজের শ্রেণী লক্ষণও দেখাইয়াছেন, যথা:-
“হিংসামতি ব্যাধ আমি অতি নীচজাতি
কি কারণে মোর গৃহে আসিবে পার্ব্বতী।।
আবার শ্রেণী-লক্ষণ যে জাতি-লক্ষণের আকারে ভীষণ রূপধারণ করিয়াছিল তাহা আমরা কালকেতুর পুরোহিত অনুসন্ধানের সংবাদে পাই:—
“পুরোধ আমার কেবা হইবে ব্রাহ্মণ।
নীচ কি উত্তম হয় পাল্যে মহাধন॥”
“শুনিয়া সে বীরবর, কোপে কাঁপে থর থর,
শুন রানা আমার উত্তর। ...
বলিদিব কলিঙ্গরায় তুষিব চণ্ডিকামায়,
আপনি ধরিব ছত্রদণ্ড”
তৎপরে ভাগ্য বিপর্যয়ে কালকেতু বন্দী হইয়া কলিঙ্গের রাজসভায় প্রবেশ করে, তখন—“রাজসভা দেখি বীর প্রণাম না করে।” এই কাহিনী সেই বৈদিক যুগের পর পুরুরাজের সহিত আলেকজাণ্ডারের সাক্ষাতের দৃশ্য আমাদের স্মৃতিপটে উদিত করিয়া দেয়! এই পার্থক্য কোথা হইতে আসে? উভয় কবির অবিদিত মনের পর্দ্দায় কোন সামাজিক ছবি লুক্কাইত ছিল তাহা আমরা জানি না, তবে মাধবাচার্য্যের চণ্ডী ১৫৭৯ খৃঃ প্রণীত হয়। কবি তাহাতে আত্মপরিচয় স্থলে লিখিয়াছেন:
“পঞ্চগৌড় নামে স্থান পৃথিবীর সার।
একাববর নামে রাজা অর্জ্জুন অবতার”॥
সেই সময়ে সপ্তগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যখন বাঙ্গলার হাওয়ায় মোগলের বিরুদ্ধে চারিদিকে প্রবল যুদ্ধ চলিতেছিল, যখন “মোগলমারী” যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙ্গালী হিন্দু, হাড়ীজাতীয় সৈনিকেরাও পাঠানদের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রণে কৃতিত্ব দেখাইতেছিল, যে যুগে প্রবাদানুসারে মানসিংহের দম্ভপূর্ণ পত্রের প্রত্যুত্তরে কেদার রায় বলিয়াছিলেন, “তথাপি সিংহ পশুরেব নান্য,” আবার সে যুগে এই ব্যক্তিরই দূতকে প্রতাপাদিত্য সদর্পে বলিয়াছিলেন,
"কহ গিয়ে অরে চর, মানসিংহ রায়ে।
বেড়ী দেউক আপনার মনিবের পায়ে॥
লইলাম তরবার কহ গিয়া তারে,
যমুনার জলে ধুব এই তলবারে।
বাঙ্গলার সেই ‘ঝটিকা ও অশনিপাতের’ যুগেই মাধবের বীর পরাজিত বাঙ্গালীর প্রতীক হইয়াছিলেন। তাই তিনি কয়েদী হইলেও গর্ব্ব ও আত্মসম্মান ত্যাগ করেন নি। কেদার ও প্রতাপের শেষ মুহূর্ত্তের সহিত তুলনা করুন। আর পরবর্ত্তী কালের মুকন্দরাম—তিনি দুই হাত তুলিয়া উপরোক্ত যোগল রাজকর্ম্মচারীকে বলিতেছেন, “ধন্য রাজা মানসিংহ, বিষ্ণুপদাম্বুজে”...। এই উক্তির পশ্চাতে কি তৎকালের রাঢ়ী ব্রাহ্মণের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হইতেছে, আর কালকেতুকে ভীরু সাজাইয়া কি তদানীস্তনের বাঙ্গালীর defeatist mentality-র পরিচয় প্রদান করা হইতেছেনা? কিন্তু কেবল সামন্ততন্ত্রীয় গল্পে ‘চণ্ডী’ কাব্য পর্য্যবসিত না হইয়া সমাজের সর্ব্বপ্রকারের লোকের চিত্র অঙ্কন করার জন্য এই কাজকে পূর্ব্বাপেক্ষা আপেক্ষিক প্রগতিশীল বলা যায়। মুকুন্দরামের সময় হইতে এবং সপ্তদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত একটি বিশাল বৈষ্ণব সাহিত্য সৃষ্ট হয়। কিন্তু ইহার প্রতিপাদ্য হইতেছে ধর্ম্মতত্ত্ব, যদিচ মধ্যে মধ্যে তৎসময়ের সামাজিক সংবাদ ইহার মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সাহিত্যের মধ্যে বিশিষ্ট লক্ষণীয় অনুষ্ঠান যে ব্রজভাষায় হিন্দী বৈষ্ণব কবিতা সমূহের ন্যায় ইহাতে ক্রন্দনের ও হা হুতাশের রোল বিশেষভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। সদ্য স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত হিন্দুর অবিদিত মনে যে হতাশা ও ক্রন্দনের ভাব লুক্কায়িত ছিল, তাহাই ইহার ‘মাথুরে’ প্রকাশ পাইয়াছে বলিয়া মনে হয়। এই সাহিত্যের আলোচ্য বস্তু দেখিয়া ইহাকে প্রগতিশীল সাহিত্য বলা যায় না, যদিচ প্রগতিপূর্ণ কবিতা (‘বৈষ্ণব বন্দনা’; দুঃখী কৃষ্ণদাসের পদ) ইহাতে আছে।
মুকুন্দরামের পরে, বড় কবি হইতেছেন ভারতচন্দ্র। সাহিত্যিকেরা বলেন, তাঁহার ‘বিদ্যাসুন্দর’ একটি পুরাতন পুস্তকের নূতন সঙ্কলন। ইহাতেও আমরা সেই প্রাচীন সামন্ততন্ত্রের ছাপ দেখিতে পাই। তাহাতে তৎকালীন মুসলমান দরবারী ছাপ অঙ্কিত আছে। ভারতচন্দ্র প্রতাপাদিত্যকে বড় করিয়া দেখাইয়াছেন এবং সেই সঙ্গে সেই সময়ের ঐতিহাসিক সংবাদও যৎকিঞ্চিৎ দিয়াছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সেই যুগের হিন্দুর defeatist mentalityও বাদ যায় নাই; তাই কবি বলিতেছেন:
পাতসাহি ঠাটে, কবে কেবা আঁটে
প্রতাপাদিত্য হারে ”।
লক্ষ্য করিবার কথা এই যে, এই যুগের সাহিত্যিকেরা বাঙ্গলা ভাষায় একটা স্বতন্ত্র সাহিত্য রচনা করিলেও সেই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যবাদের পাশমুক্ত হইতে পারেন নাই। তাঁহারা সংস্কৃত সাহিত্যের অলঙ্কার বাংলায় চালাইতে ছিলেন। তাই ভারতচন্দ্র প্রতাপাদিত্যের সহিত মোগলদের যুদ্ধে সৈন্যেরা “মুচড়িয়া, গোঁপে শূলশেললোফে” আর “রবি-চন্দ্র-বাণ” ব্যবহার করিতেছেন। আর একজন সাহিত্যিক সংস্কৃতে (নিখিলনাথ রায়ের ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’ দ্রষ্টব্য) প্রতাপাদিত্যের জীবনী রচনাকালে চন্দ্রবাণ, বায়ুবাণ প্রভৃতি উল্লেখ করিয়াছেন, এই কালের মাণিক গাঙ্গুলী তাঁহার ধর্ম্মপুরাণে লাউ সেনের কীর্ত্তি গাহিতে গিয়া সংস্কৃত মহাভারতের ঢং তাহাতে ঢুকাইয়াছেন। এতদ্বারা একদিকে যেমন চিন্তাশক্তির অনুর্ব্বরতার পরিচয় প্রদানকরে, অন্যদিকে সনাতন ধারাকে অক্ষুন্ন রাখিবার চেষ্টাও এই সব ব্রাহ্মণ লেখকদের মধ্যে ছিল বলিয়া অনুমান হয়। তাঁহাদের এই প্রকারের দৃষ্টিভঙ্গী জন্যই ওসওয়াল্ড স্পেংলারের উক্তি, যে গ্রীক, হিন্দু প্রভৃতি প্রাচীনেরা Space and time অগ্রাহ্য করিয়া চলিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ পথে আসে।
ভারতচন্দ্রের পর, ইংরেজ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রভাব বাঙ্গলায় বিস্তারিত হয়। ক্রমে এই কোম্পানী ভারতের শাসনতন্ত্র হস্তে গ্রহণ করে এবং ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপিত করিয়া এই দেশের বিপুল পরিবর্ত্তন সাধিত করে। এই যুগে ইহাদের দ্বারা ভারতে সর্ব্বপ্রথম একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী উদ্ভূত হয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের শাসনের যুগ এখনও চলিতেছে। এই শাসনাধীনে প্রথমে বাংলাতেই বুর্জ্জোয়া শ্রেণী বিবর্ত্তিত হয়। বাঙ্গলার সমাজের সর্ব্ব বিষয়ে কৃতিত্ব এই শ্রেণী দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত দোষ জন্য উনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যিকেরা সর্ব্ববিষয়ে সামন্ততান্ত্রিক যুগের মোহ কাটাইতে পারে নাই। তাই এই যুগের লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকদের নায়কেরা কেহ হন ভূস্বামী; তিনি কেল্লার মধ্যে থাকেন এবং তাঁহার অন্তপুঃরের স্ত্রীলোকেরা কক্ষ, গবাক্ষ ও আম্রবাগানে ‘সখী-সংবাদ’ করিতেছেন; না হয় তিনি একজন তাঁহার স্থলাভিষিক্ত জমিদার যিনি বলেন, “আমার কাছে পুলিশ ম্যাজিষ্টর কি? আমিই জজ ম্যাজিষ্টর”। এই সাহিত্যের লেখকেরা ভুলিয়া যান যে বর্ত্তমানকালের বুর্জ্জোয়া অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক সভ্যতার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী বা মোগল আমলের ভূস্বামীর স্থান আর নাই। আর, আজকালকার জমিদারেরা ইংরেজের জন্য প্রজার কাছে খাজনা আদায়কারী এজেণ্ট মাত্র।
এই প্রকারের বাঙ্গলা সাহিত্যে একটা কাল-ব্যতিক্রম (anachronism) থাকিয়া গিয়াছে। আমরা আছি একযুগে, কিন্তু সাহিত্যের চিত্র হইয়াছে অন্য এক যুগের! ইহা সত্য বটে যে, ভারতীয় সমাজ সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিক ভিত্তিতে এখনও প্রতিষ্ঠিত আছে। কিন্তু ইংরেজ শাসনের জন্য এবং কলকারখানার জন্য যে মধ্যশ্রেণী বা বুর্জ্জোয়া শ্রেণী সর্ব্বত্র উদ্ভূত হইয়াছে এবং যাহারা ভারত শাসনে ইংরেজের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহাদের অস্তিত্বের চিহ্ন এই সাহিত্যে কোথায়? তৎপর, আজকাল যে ভারতের সর্ব্বত্র শ্রমিক ও কৃষক জাগরণ হইতেছে, এবং তাহারাই স্বরাজ-শাসনের ভার লইবার অধিকারী বলিয়া দাবী করিতেছে তাহারও নিদর্শন সাহিত্যে কৈ? ইহার বদলে আমরা দেখি যে, হঠাৎ মাথায় টিকি ও একহাতে মনু ও রঘুনন্দন, অন্য হাতে কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চুক্তিপত্র নিয়া লোকসমাজে আবির্ভূত হইয়াছেন “বিপ্রদাস”! সমগ্র ভারতে আজ গণশক্তির জাগরণ, সর্ব্বত্র কায়েমী স্বার্থ (Vested interest) উঠাইয়া দিবার কথা ও আন্দোলন চলিতেছে, সাম্যস্থাপনের কথা উঠিতেছে, এমন সময়ে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য ও জমিদারের উচ্চ আদর্শ দেখাইবার জন্য এই Commercial–industrial যুগে বিপ্রদাসের আক্রমণের রাজনীতিক চালবাজী ওয়াকিবহাল মহলে ঢাকা থাকে নাই। আমরা জানি বনিয়াদী বা কায়েমীস্বার্থ নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখিবার জন্য বড় বড় অধ্যাপক দিয়া প্রচার কার্য্য চালাইতেছেন, সেই জন্য এই যুগে বিপ্রদাস একাধারে ব্রাহ্মণ ও জমিদাররূপে আবির্ভূত হইয়া এই দুই বনিয়াদী স্বার্থের পক্ষে ওকালতী করাতে আমরা আশ্চর্য্য হই নাই, যদিচ ইহাও বাঙ্গলা সাহিত্যের কাল ব্যতিক্রমতার আর একটী প্রমাণ। আমরা বিপ্রদাসকে শ্রেণী-সংগ্রামেরই প্রতীক বলিয়া গণ্য করি। সাহিত্যকে এইরূপ ব্যবহার করার উপায় ফ্যাশিস্ট দেশসমূহেও গৃহীত হইয়াছে। এই জন্য এই প্রকারের সাহিত্য প্রতিক্রিয়াশীল বলিয়া গণ্য হয়।
এইরূপ আমরা দেখি যে, বুর্জ্জোয়া যুগে বাংলায় একটা বুর্জ্জোয়া সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছে না। তবে আজকালকার অনেক লেখক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নায়ক ও নায়িকাকে কেন্দ্র করিয়া নভেল নাটক লিখিতেছেন। কিন্তু কেবল মধ্যশ্রেণীর নায়ক ও নায়িকার গল্প নিয়া একটা বুর্জ্জোয়া সাহিত্য গড়িয়া উঠে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসী ও আমেরিকার সাহিত্যকে যেমন আমরা সম্পূর্ণরূপে বুর্জ্জোয়া সাহিত্য বলিয়া গণ্য করিতে পারি, সেই প্রকারে সামন্ততন্ত্রীয় যুগের প্রভাব হইতে মুক্ত হইয়া মধ্যবিত্তশ্রেণীর লোক ও তাহার কৃষ্টিকে কেন্দ্র করিয়া যে সাহিত্য গড়িয়া উঠে তাহাকেই বুর্জ্জোয়া সাহিত্য বলে। রোমাঁ রোলাঁর ও জোলার পুস্তক সমূহে, আমেরিকার এমারসন, হুইটিয়ার, লংফেলো, ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রভৃতি এই সাহিত্যিক যুগের প্রতীক। সমাজ সম্পূর্ণরূপে মধ্যবিত্তশ্রেণীর স্বার্থোদ্দেশে চালিত হইলে সেই সমাজের সাহিত্যও নিজের নূতন খাত সৃষ্টি করে।
অবশ্য বাঙ্গলার সমাজ এখনও সম্পূর্ণভাবে “বুর্জ্জোয়াত্ব” প্রাপ্ত হয় নাই। সেই জন্য আমরা একটা খাঁটি বুর্জ্জোয়া সাহিত্য এখনও উদ্ভূত হইতে দেখি না। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাহিনী নিয়া যে সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছে তাহা এখনও প্রাচীনের প্রভাব কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। বুর্জ্জোয়া সাহিত্যে সাধারণত: আধুনিক লোকের চরিত্র অঙ্কিত হয়। তাহারা প্রাচীনের মোহ কাটাইয়া আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৌশলে জগতের ধনসম্পদ ভোগ করিবার জন্য ব্যস্ত! এই জন্য প্রাচীন আইন, বিধিনিষেধ, সমাজ-বন্ধনচ্ছিন্ন করিয়া সমাজকে নূতন ছাঁচে গড়িতে চায়! দৃষ্টান্তস্বরূপ: আমেরিকা, ফ্রান্স, কেমালের তুর্কি প্রভৃতি। কিন্তু আমাদের হালের সাহিত্যে সামাজিক আবর্ত্তনের সেই সুর কোথায়? তাই “পণ রক্ষার” মধ্যে দেখি যে, নায়ক যৌবনে সমাজ সংস্কার কর্ম্মে উৎসাহ প্রকাশ করিলেও যখন তাঁহার “তেতালা বাড়ী হইল” তখন কোন মতে পারিবারিক পূর্ব্ব ইতিহাসের এই অধ্যায়কে বিলুপ্ত করিয়া দিয়া সমাজে উঠিবার জন্য তাঁহার রোখ চাপিয়া উঠিল। নিজের মেয়েটিকে সমাজে বিবাহ দিবেন এই তাঁর জেদ...শিক্ষিত সৎপাত্র না হইলেও চলে, কন্যার চিরজীবনের সুখ বলিদান দিয়াও তিনি সমাজ-দেবতার প্রসাদ লাভের জন্য উৎসুক হইয়া উঠিলেন। আবার ‘হালদার গোষ্ঠী’ পুস্তকে পড়ি—“বড় ঘরের দাবী কি সামান্য দাবী! তাহার যে নিষ্ঠুর হইবার অধিকার আছে। তাহার কাছে কোনো তরুণী স্ত্রীর কিংবা কোনো দুঃখী কৈবর্ত্তের সুখ দুঃখের কতটুকুই বা মূল্য?” ইহাতে আমরা সেই পুরাতন সামস্তযুগেরই প্রতিধ্বনি শুনি। আবার, “চোখের বালি”র মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঘরের কথা পাই, “এডিপুস কমপ্লেক্স” তথায় বিরাজ করিতেছে। তাহার অনুসরণ ও পশ্চাৎ অনুসরণের পর, victim (বলি) ঝিনোদিনী বলিতেছে, “ছি ছি, এ কথা মনে করিতে লজ্জা হয়। আমি বিধবা, আমি নিন্দিতা, সমস্ত সমাজের কাছে আমি তোমাকে লাঞ্ছিত করিব, এ কখন হইতে পারে না! ছি, ছি, এ কথা তুমি মুখে আনিও না।” আবার সে বলিতেছে, “ছি, ছি, বিধবাকে তুমি বিবাহ করিবে! তোমার ঔদার্য্যে সব সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু আমি যদি ওকাজ করি, তোমাকে সমাজে নষ্ট করি, তবে ইহজীবনে আমি আর মাথা তুলিতে পারি না।” এই পুস্তকে এডিপুসের victim স্ত্রীলোক হইল কাশীবাসিনী আর পুরুষ গোঁফে চাড়া দিয়া সমাজে মাননীয় হইয়া রহিল। এই নভেলেও পুরুষ-প্রাধান্যযুক্ত সমাজের (androcentric theory of society) ছবি প্রদত্ত হইয়াছে, যদিচ এই পুস্তকের যুগেই নরতাত্ত্বিক ও জীবতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিকগণ স্ত্রীলোক ও পুরুষের সমানাধিকারের তথ্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন।
এই প্রকারে দেখি যে, আমাদের হালের লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকেরা মধ্যবিত্তশ্রেণীর জীবন অঙ্কিত করিতে যাইয়া সনাতনী খাতে নিমজ্জিত হইতেছেন। এখনও এক ভাবে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে প্রাচীন “অবধূত গীতা” ও শঙ্করাচার্য্যের স্তোত্র বা “নরকস্য দ্বারং নারী” প্রতিধ্বনিত হইতেছে। তবে উপস্থিত যুগে যে এক প্রকার নূতন সাহিত্যের উদয় হইয়াছে তাহা কতকটা বুর্জ্জোয়া সাহিত্যের অভিমুখে যাইতেছে মনে হয়। কিন্তু ইহা যেন কেবল “এডিস কমপ্লেক্সের” অনুসরণ করিয়াই পরিশ্রান্ত হইতেছে। ইহাতে সমাজকে আধুনিক ছাঁচে গড়িয়া তুলিবার কোন আদর্শ ই প্রদত্ত হইতেছে না। ইহাতে ‘জনের’ সন্ধান বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না—‘গণের’ তো নয়ই। কেবল পাওয়া যায় যৌন–সম্বন্ধের কাহিনী। কিন্তু যৌন সম্বন্ধই সমাজের একমাত্র অনুষ্ঠান নয় । এই সাহিত্যে সমাজের বর্ত্তমান সমস্যাগুলির আলোচনা হইতেছে না। অনুমান হয় এক প্রকারের ইউরোপীয় ভাবধারা বাঙ্গালী সমাজে আরোপিত করিয়া একটা অস্বাভাভিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা গঠন করা হইতেছে । যৌন সম্বন্ধের শুধু বিচার করিলেই পুরুষ ও নারীর সব প্রশ্নের সমাধা হয় না। আবার নারীর ক্রমাগত স্বামী বা প্রণয়ী পরিবর্ত্তন করাই তাহার সামাজিক ‘শেষ প্রশ্ন’ নয়। অন্যপক্ষে কৌমগত বৈদিক বা উপনিষদের যুগের আদর্শ এই যুগের স্ত্রীলোকের সমস্যা বিষয়ের ‘শেষ উত্তর’ নহে। প্রথমোক্ত আদর্শটি কোন সমাজের আদর্শ তাহা অজ্ঞাত, অন্ততঃ সাম্যবাদী গণশ্রেণী সমাজে তাহা নয় ইহা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এই জন্য এই সাহিত্যকে পূর্ণভাবে বুর্জ্জোয়া সাহিত্য বলা যাইতে পারে না। খুব সম্প্রতি একটী নূতন ধরণের সাহিত্য উদিত হইতেছে——তাহা গণশ্রেণীর জীবনের বৃত্তান্ত অবলম্বন করিয়া লিখিত হইতেছে। এই বিষয়ে দু’একটী সুন্দর পুস্তিকাও প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে একটু realistic ছাপ আছে, কিন্তু ইহাকে গণসাহিত্য বলা যায় না। পুস্তকে গণশ্রেণীর জীবন সম্বন্ধে লিখিলেই তাহা গণ সাহিত্য হয় না ।
গণশ্রেণীর দুঃখ ও দারিদ্র্য, আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের কথা, হৃদয়ের বেদনা ও সুখেচ্ছার কথা নিয়া এবং তাহাকে সমাজের কেন্দ্রীভূত করিয়া তাহার দৃষ্টিকোণ নিয়া যে সাহিত্য গড়িয়া উঠিবে তাহাকে গণ সাহিত্য বলা যায়। ভারতে অর্থনীতিক কারণে একটা গণ-আন্দোলন চলিতেছে বটে, কিন্তু তাহার মধ্যেও একটা কাল-ব্যতিক্রম আছে। যে দিন গণ-শ্রেণীর লোক সমাজের চিত্র অঙ্কিত করিবে, সেইদিন একটা গণসাহিত্য উদ্ভূত হইবে। আমাদের সাহিত্যের পরিস্থিতির কথা যৎসামান্যভাবে এই স্থলে আলোচনা করা গেল । মোটের উপর দেখি যে আমাদের সাহিত্যে একদিকে সনাতনী খাত প্রবাহিত হইতেছে, অন্যদিকে বৈদেশিক ভাব আসিতেছে। ইহার কারণ আমাদের সাহিত্যে realism-এর অত্যন্ত অভাব রহিয়াছে। আমরা space and time-কে ঠিক ভাবে ধরিয়া চলিতেছি না। তাই একদল নূতন শ্রেণীর লেখকের প্রয়োজন, যাঁহারা বিভিন্ন স্তরের যথার্থ অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন ও তাহার পরিবেশন করিবেন এবং সাহিত্যকে কাল-ব্যতিক্রমের অসামঞ্জস্যের কবল হইতে রক্ষা করিবেন। সাহিত্যে প্রগতি আনিতে হইলেই এগুলির বিশেষ প্রয়োজন। যাহাতে সমাজ যথার্থই অগ্রগতিশীল হয় তাহাই প্রগতি লেখকদের লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।
- ↑ রঙ্গপুর জেলার সৈয়দপুদ ষ্টেশনের কাছে এক মাটির ঢিপিকে স্থানীয় মুসলমানেরা চাঁদ সদ্বাগরের জাহাজের ধ্বংসাবশেষ বলিয়া প্রদর্শন করান।
- ↑ শ্রীযতীন্দ্রনাথ মজুমদার—'কবি নারায়ণ দেবের সময় ও সমাজ’ মাতৃভূমি আশ্বিন ১৩৫১। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রকাশিত পুস্তকে শেষোক্ত এই দুই পদ নাই। কিন্তু বিধবার পুনঃ বিবাহের ইঙ্গিত তথায়ও আছে।