স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/আলমোড়ায় প্রাতঃকালীন কথোপকথন
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আলমোড়ায় প্রাতঃকালীন কথোপকথন
প্রথম দিন সকালের কথোপকথনের বিষয় ছিল: সভ্যতার মূল আদর্শ—প্রতীচ্যে সত্য, প্রাচ্যে ব্রহ্মচর্য্য। হিন্দু-বিবাহরীতিগুলিকে তিনি এই বলিয়া সমর্থন করিলেন যে, তাহারা এই আদর্শের অনুসরণে জন্মিয়াছে এবং সর্ব্ববিধ সংহতিগঠনেই স্ত্রীলোকের রক্ষাবিধানের প্রয়োজন আছে। সমস্ত বিষয়টীর অদ্বৈতবাদের সহিত কি সম্বন্ধ, তাহাও তিনি বিশ্লেষণপূর্বক দেখাইলেন।
আর একদিন সকালে তিনি এই বলিয়া কথা আরম্ভ করিলেন যে, যেমন জগতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারিটী মুখ্য জাতি আছে, তেমনি চারিটী মুখ্য জাতীয় কার্য্যও আছে: ধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় কার্য্য অর্থাৎ পৌরোহিত্য, যাহা হিন্দুরা নিষ্পন্ন করিতেছে; সামরিক কার্য্য যাহা রোমক সাম্রাজ্যের হস্তে ছিল; বাণিজ্যবিষয়ক কার্য, যাহা আজকালকার ইংলণ্ড করিতেছে এবং প্রজাতন্ত্রমূলক কার্য্য, যাহা আমেরিকা ভবিষ্যতে সম্পন্ন করিবে। এই স্থলে তিনি কিরূপে আমেরিকা অতঃপর শূদ্রজাতির স্বাধীনতা এবং একযোগে কার্য্যকারণরূপ সমস্যাগুলি পূরণ করিবে, এতদ্বিষয়ে কল্পনাসহায়ে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল চিত্র-অঙ্কনে প্রবৃত্ত হইলেন এবং যিনি আমেরিকাবাসী নন, এরূপ একজন শ্রোতার দিকে ফিরিরা উক্ত জাতি কিরূপ বদান্যতার সহিত তত্রত্য আদিম অধিবাসিগণের নিমিত্ত বন্দোবস্ত করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে বর্ণনা করিলেন।
হয়ত বা তিনি উল্লাসপূর্ব্বক ভারতবর্ষের অথবা মোগলবংশের ইতিহাসের সার-সঙ্কলন করিয়া দিতেন। মোগলগণের গরিমা স্বামিজী শতমুখে বর্ণনা করিতেন। এই সারা গ্রীষ্ম-ঋতুটিতে তিনি প্রায়ই মধ্যে মধ্যে থাকিয়া থাকিয়া দিল্লী ও আগ্রার বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইতেন। একবার তিনি তাজমহলকে ‘একটা ক্ষীণালোক স্থান, তৎপরে আর একটা ক্ষীণালোক স্থান, আবার সেখানে একটী সমাধি!’—এইরূপ বর্ণনা করেন। আর একবার তিনি সাজাহানের কথা বলিতে বলিতে সহসা উৎসাহভরে বলিয়া উঠিলেন, “আহা, তিনিই মোগলকুলের ভূষণস্বরূপ ছিলেন। অমন সৌন্দর্য্যানুরাগ ও সৌন্দর্য্যবোধ ইতিহাসে আর দেখা যায় না। আবার নিজেও একজন কলাবিদ্ লোক ছিলেন। আমি তাঁহার স্বহস্তচিত্রিত একথানি পাণ্ডুলিপি দেখিয়াছি, সেখানি ভারতবর্ষের কলাসম্পদের অঙ্গ বিশেষ। কি প্রতিভা!” তিনি আকবরের প্রসঙ্গ আরো বেশী করিয়া করিতেন। আগ্রাসন্নিকটে সেকেন্দ্রার সেই গম্বুজবিহীন অনাচ্ছাদিত বাতাতপোক্ত সমাধির পাশে বসিয়া আকবরের কথা বলিতে বলিতে স্বামিজীর কণ্ঠ যেন অশ্রুগদগদ হইয়া আসিত এবং তাঁহার অন্তর্নিহিত বেদনা কাহারও বুঝিতে আর বাকি থাকিত না।কিন্তু সর্ব্ববিধ বিশ্বজনীন ভাবও আচার্য্যদেবের হৃদয়ে উদিত হইত। একদিন তিনি চীনদেশকে জগতের কোষাগার বলিয়া বর্ণনা করিলেন, এবং বলিলেন, তত্রত্য মন্দিরগুলির দ্বারদেশের উপরিভাগে প্রাচীন বাঙ্গলালিপি খোদিত দেখিয়া তাঁহার রোমাঞ্চ হইয়াছিল। তাঁহার জনৈক শ্রোতা অসত্যপরায়ণতা উক্ত জাতির একটা সর্ব্বজন-পরিচিত দোষ বলিয়া অভিযোগ করেন—প্রাচ্য জাতিগণসম্বন্ধে পাশ্চাত্ত্যগণের কিরূপ ভাসা ভাসা জ্ঞান, এই উক্তিই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চীনাগণ যুক্তরাজ্যে—যেখানে তাহারা ব্যবসায়পটু লোক বলিয়া পরিচিত—অদ্ভুত বাণিজ্যসম্বন্ধীয় সাধুতার জন্য বিখ্যাত, এমন কি তাহাদের সাধুতা, পাশ্চাত্ত্যগণ উক্ত শব্দ বলিতে সাধারণতঃ যাহা বুঝিয়া থাকেন তদপেক্ষা অনেক অধিক। সুতরাং এই অভিযোগটী অযথা বর্ণনের লজ্জাকর উদাহরণস্থল হইলেও এরূপ অযথা বর্ণন ত সচরাচর যথেষ্ট পরিমাণেই ঘটিয়া থাকে। কিন্তু স্বামিজী কোনমতেই ইহার নামগন্ধ পর্য্যন্ত সহ্য করিলেন না। তিনি উত্তেজিত হইয়া বলিতে লাগিবেন, “অসত্যপরায়ণতা! সামাজিক কঠোরতা! এগুলি অত্যন্ত আপেক্ষিক শব্দ ব্যতীত আর কি? বিশেষতঃ অসত্যপরায়ণতার কথা ধরিতে গেলে যদি মানুষকে বিশ্বাস না করিত, তাহা হইলে বাণিজ্য বা সমাজ বা অন্য সর্ব্ববিধ সংহতি একটী দিনও টিকিতে পারিত কি? শিষ্টাচারের খাতিরে অসত্যপরায়ণ হইতে হয়, বলিতেছ? তাহা হইলে, পাশ্চাত্ত্যগণের এ বিষয়ে যে ধারণা তাহার সহিত ইহার পার্থক্য কোথায়? ইংরেজ কি সকল সময়েই যথাকথিত স্থানে সুখবোধ এবং যথাকথিত স্থানে দুঃখবোধ করিয়া থাকে? তবুও মাত্রাগত তারতম্য আছে, বলিতেছ? হয়ত আছে, কিন্তু শুধু মাত্রাগত।
অথবা তিনি কথাপ্রসঙ্গে সুদূর ইটালি দেশ পর্য্যন্ত গমন করিতেন। ইটালি তাঁহার নিকট “ইউরোপের সকল দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়, ধর্ম্ম ও শিল্পের একাধারে সাম্রাজ্যসংহতি ও ম্যাট্সিনির জন্মভূমি এবং উচ্চভাব, সভ্যতা ও স্বাধীনতার প্রস্তুতি!”
একদিন শিবাজী ও মহারাষ্ট্রজাতি-সম্বন্ধে এবং কিরূপে শিবাজী সাধুবেশে বর্ষব্যাপী ভ্রমণের ফলে রায়গড় গৃহস্বরূপে লাভ করেন, তৎসম্বন্ধে কথা হইল। স্বামিজী বলিলেন, “আজও পর্য্যন্ত ভারতের কর্তৃপক্ষ সন্ন্যাসীকে ভয় করেন, পাছে তাহার গৈরিক বসনের নীচে আর একজন শিবাজী লুক্কায়িত থাকে।”
অনেক সময় ‘আর্য্যগণ কাহারা এবং তাঁহাদের লক্ষণ কি?’—এই প্রশ্ন তাঁহার পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণ করিত। তাঁহাদের উৎপত্তি-নির্ণয় এক জটিল সমস্যা—এইরূপ মত প্রকাশ করিয়া তিনি কিরূপে সুইজারলণ্ডেও থাকিয়াও জাতিদ্বয়ের আকৃতিগত সাম্যপ্রযুক্ত যেন চীনদেশে রহিয়াছেন, এইরূপ বোধ করিয়াছিলেন, তাহার গল্প আমাদের নিকট করিতেন। নরওয়ের কতক অংশের সম্বন্ধেও এটী সত্য বলিয়া তাঁহার ধারণা ছিল। তার পর দেশভেদে আকৃতিভেদ-সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য এবং সেই হুঙ্গারীদেশীয় পণ্ডিতের মর্ম্মস্পর্শী গল্প (যিনি ‘তিব্বতই হুনদিগের জন্মভূমি’ এই আবিষ্কার করিয়াছিলেন এবং দার্জিলিংএ যাঁহার সমাধি আছে)—এইরূপ নানা কথা শুনিতে পাইতাম।
এই প্রকারের প্রশ্নে শুধু স্বামিজী কেন, যাঁহাদিগকে ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার দৃষ্টান্তস্থল বলিয়া বিবেচনা করা যাইতে পারে, তাঁহারাও সকলে কিরূপ মুগ্ধ হইতেন, আমরা এই সমগ্র গ্রীষ্ম ঋতুটিতে তাহাই লক্ষ্য করিয়া আনন্দ উপভোগ করিতাম। মনে হইত, যেন প্রাচ্যের চিন্তাজগতে শ্রেণী, আচারব্যবহার এবং জাতি-তত্ত্ববিষয়ক প্রশ্ন—এ সকলের উৎপত্তি কোথা হইতে এবং ইহারা কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে, এই সকল আলোচনার যে স্থান, পাশ্চাত্ত্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রতি লক্ষ্য রাখা সেই স্থান অধিকার করিয়াছে। স্বতঃই মনে হইল যে, যখন প্রাচ্যে পুরাতত্ত্বের পণ্ডিত এবং রাজনীতিবিদ্গণ তাঁহাদের নিজ নিজ সমস্যাগুলির আলোচনা করেন তখন তাঁহারা এই তত্ত্বটীর সাহায্য অবশ্যই লইবেন, অধিকন্তু সম্ভবত্তঃ ইহার উপর এক অতি উচ্চদরের বিচার-প্রণালী প্রয়োগ করিতে পারিবেন।
কখনও কখনও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের ব্যবধানের আলোচনা-প্রসঙ্গে স্বামিজী ভারতবর্ষের সমগ্র ইতিহাসকে এতদুভয়ের সংঘর্ষ মাত্র বলিয়া বর্ণনা করিতেন এবং জাতির উন্নতিশীল ও শৃঙ্খল-অপনয়নকারী প্রেরণাসমূহ ক্ষত্রিয়গণের মধ্যেই চিরকাল নিহিত ছিল, তাহাও বলিতেন। আধুনিক বাঙ্গালার কায়স্থগণই যে মৌর্যরাজত্বের পূর্ব্বর্তন ক্ষত্রিয়কুল, তাঁহার এই বিশ্বাসের অনুকূলে তিনি উৎকৃষ্ট যুক্তির অবতারণা করিতে পারিতেন। তিনি এই দুই পরস্পরবিরোধী সভ্যতাদর্শের এইরূপ চিত্র অঙ্কিত করিতেন―“একটী প্রাচীন, গভীর এবং পরস্পরাগত আচারব্যবহারের প্রতি চিরবর্দ্ধমান শ্রদ্দাসম্পন্ন; অপরটী স্পর্দ্ধাশীল, চঞ্চল প্রকৃতি এবং উদার-সম্মুখপ্রসারিত-দৃষ্টি। রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান্ বুদ্ধ ইহারা সকলেই ব্রাহ্মণকুলে না জন্মিয়া যে ক্ষত্রিকুলে উৎপন্ন হইয়াছিলেন, সেটী ঐতিহাসিক উন্নতির এক গভীর নিয়মেরই ফলস্বরূপ। এবং এই আপাত-বিসংবাদী সিদ্ধান্তে ব্যাখ্যাত হইবামাত্র বৌদ্ধধর্ম্ম এক জাতিভেদধ্বংসী সূত্ররূপে প্রতীয়মান হইত—‘ক্ষত্রিয়কুল কর্তৃক উদ্ভাবিত ধর্ম্ম’ ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের সাংঘাতিক প্রতিপক্ষস্বরূপ হইয়া দাড়াইত।”
বুদ্ধ সম্বন্ধে স্বামিজী যে সময় কথা কহিতেছিলেন, সেটী এক মাহেন্দ্রক্ষণ; কারণ জনৈক শ্রোত্রী স্বামিজীর একটা কথা হইতে বৌদ্ধধর্ম্মের ব্রাহ্মণ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবটিই তাঁহার মনোগত ভাব, এই ভ্রমাত্মক সিদ্ধান্ত করিয়া বলিলেন, “স্বামিজী, আমি জানিতাম না যে আপনি বৌদ্ধ!” উক্ত নামশ্রবণে তাঁহার মুখমণ্ডল দিব্যভাবে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে ফিরিয়া তিনি বলিলেন, “আমি বুদ্ধের দাসানুদাসগণের দাস। তাঁহার মত কেহ কখনও জন্মিয়াছেন কি? স্বয়ং ভগবান হইয়াও তিনি নিজের জন্য একটি কাজও করেন নাই—আর কি হৃদয়! সমস্ত জগৎটাকে তিনি ক্রোড়ে টানিয়া লইয়াছেন। এত দয়া যে, রাজপুত্র এবং সাধু হইয়াও একটি ছাগশিশুকে বাঁচাইবার জন্য প্রাণ দিতে উদ্যত! এত প্রেম যে, এক ব্যাঘ্রীর ক্ষুধাতৃপ্তির জন্য স্বীয় শরীর পর্য্যন্ত দান করিয়াছিলেন এবং আশ্রয়দাতা এক চণ্ডালের জন্য আত্মবলি দিয়া তাহাকে আশীর্ব্বাদ করিয়াছিলেন! আর আমার বাল্যকালে এক দিন তিনি আমার গৃহে আসিয়াছিলেন এবং আমি তাঁহার পাদমূলে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হইয়াছিলাম! কারণ আমি জানিয়াছিলাম যে ভগবান বুদ্ধই স্বয়ং আসিয়াছেন!”অনেক বার কখনও বেলুড়ে অবস্থানকালে এবং কখনও তাহার পরে তিনি এই ভাবে বুদ্ধদেবের কথা বলিয়াছিলেন। একদিন তিনি আমাদিগকে, যিনি বারযোষা হইয়াও বুদ্ধকে পরিতোষপূর্ব্বক ভোজন করাইরাছিলেন, সেই রূপসী অশ্বপালীর উপাখ্যান এরূপ প্রাণস্পর্শিনী ভাষায় বর্ণনা করেন যে, রসেটী-রচিত মেরী মড্লীনের আকুল-ক্রন্দনাত্মক বিখ্যাত অর্দ্ধ সনেটটীর[১] কথা স্বতঃই আমাদের স্মৃতিপথে উদিত হইল:
“ওগো, আমায় ছাড়িয়া দাও! দেখিতেছ না, আমার প্রিয়তমের মুখকলম আমার নিকটে আকর্ষণ করিতেছে? আজ তিনি তাঁহার শ্রীচরণের জন্য আমার চুম্বন, আমার কেশপাশ, আমার অশ্রু মাগিতেছেন? ওগো, কে বলিয়া দিবে আবার কবে, কোথায় তাঁহার ঐ শোণিতলিপ্ত পদযুগল আমি আলিঙ্গন করিতে পাইব? তিনি যে আমায় ভালবাসিয়াছেন, আমায় চাহিতেছেন, আমায় ডাকিতেছেন; যাই, আমি যাই!”
কিন্তু স্বদেশপ্রেমই যে প্রত্যহ আলোচ্য বিষয় হইত, এমত নহে। কারণ একদিন প্রাতঃকালে এক সর্ব্বাপেক্ষা অধিক নূতনত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা হইয়াছিল। সেদিনকার দীর্ঘ আলোচনার বিষয় ছিল ভক্তি—প্রেমাস্পদের সহিত সম্পূর্ণ তাদাত্ম্য, যাহা চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ভূম্যধিকারী ভক্তবীর রায় রামানন্দের মুখে এরূপ সুন্দরভাবে প্রকাশ পাইয়াছে—
“পহিললি রাগ নয়নভঙ্গ ভেল;
অনুদিন বাঢ়ল অবধি না গেল।
না সো রমণ না হাম্ রমণী;
দুঁহ মন মনোভাব পেশল জানি।” ইত্যাদি
—শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ৮ম পরিচ্ছেদ
সেই দিন প্রাতঃকালেই তিনি পারস্যের বাব নামক দেবতার পূজকগণের কথা বলিয়াছিলেন—সেই পরার্থে আত্মবলিদানের যুগের কথা, যখন স্ত্রীজাতিকর্ত্তৃক অনুপ্রাণিত হইয়া পুরুষগণ কার্য্য করিত এবং তাহাদিগকে ভক্তির চক্ষে দেখিত। এবং নিশ্চিত সেই সময়েই তিনি বলিয়াছিলেন যে প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা না রাখিয়া ভালবাসিতে পারে বলিয়াই তরুণবয়স্থগণের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠতা এবং তাহাদের মধ্যে ভারী মহৎকার্য্যের বীজ সূক্ষ্মভাবে নিহিত থাকে—ইহাই তাঁহার ধারণা।
আর একদিন অরুণোদয়কালে যখন ঊষার আলোকরঞ্জিত চিরতুষাররাশি উদ্যান হইতে দৃষ্টিগোচর হইতেছিল, সেই সময় স্বামিজী আসিয়া শিব ও উমা সম্বন্ধে দীর্ঘ বার্তালাপ করিতে করিতে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিলেন, “ঐ যে ঊর্দ্ধে শ্বেতকায় তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গরাজি উহাই শিব, আর তাঁহার উপর যে আলোকসম্পাত হইয়াছে তাহাই জগজ্জননী!” কারণ এই সময়ে এই চিন্তাই তাঁহার মনকে বিশেষভাবে অধিকার করিয়াছিল যে, ঈশ্বরই জগৎ—তিনি জগতের ভিতর বা বাহিরে নহেন, আর জগৎও ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিমা নহে, পরন্তু তিনিই এই জগৎ এবং যাহা কিছু আছে সব।
সারা গ্রীষ্মঋতুটি ধরিয়া তিনি কখনও কখনও আমাদের নিকট অনেকক্ষণ বসিয়া গল্প করিতেন এবং হিন্দুধর্ম্মের সেই সকল ছেলেভুলান উপকথা বলিতেন, যাহাদের উদ্দেশ্য আদৌ আমাদের শিশুমহলে প্রচলিত গল্পগুলির মত নহে, কিন্তু অনেক বেশী—কেন না প্রাচীন গ্রীকজগতের পৌরাণিক উপকথাগুলির ন্যায় তাহারা চরিত্রগঠনের সহায়ক। ইহাদের মধ্যে শুকের আখ্যানটি আমার সর্ব্বাপেক্ষা ভাল লাগিয়াছিল। একদিন সন্ধ্যাকালে যখন আমরা ইহা প্রথম শুনিয়াছিলাম, তখন তুষারপর্ব্বতরূপী মহাদেব এবং আলমোড়ার ঊষর দৃশ্যাবলী আমাদের দৃষ্টিপথ অধিকার করিয়াছিল।
পরমহংসকুলাগ্রণী শুরু পঞ্চদশ বৎসর ভূমিষ্ঠ হইতে চাহেন নাই; কারণ তিনি জানিতেন যে, তাঁহার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার জননীর মৃত্যু ঘটবে।[২] তখন তাঁহার পিতা জগন্মাতা উমার কৃপাভিক্ষা করিলেন। জগন্মাতা ক্রমাগত গর্ভস্থ ঋষির সম্মুখ হইতে মায়ার আবরণ অপসারিত করিয়া আসিতেছিলেন। ব্যাসদেব প্রার্থনা করিলেন, যেন তিনি এই কার্য্য হইতে বিরতা হন, নতুবা তাঁহার পুত্র কখনও ভূমিষ্ট হইবে না। মাত্র মুহূর্ত্তেকের জন্য উমা সম্মত হইলেন এবং সেই মুহূর্ত্তে শিশুর জন্ম হইল। তিনি ষোড়শবর্ষীয় নগ্ন বালকরূপে জন্মগ্রহণ করিলেন এবং পিতামাতা কাহাকেও না চিনিয়া সোজাসুজি বরাবর চলিতে লাগিলেন! ব্যাসও তাঁহার পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন। তৎপরে একটি গিরিসঙ্কটান্তরালে গমন করিবামাত্র শুকের দেহ তাঁহা হইতে পৃথক্ হইয়া লীন হইয়া গেল; কারণ ইঁহার জগদতিরিক্ত কোন সত্তা ছিল না; আর যেমন তাঁহার পিতা “হা পুত্র! হা পুত্র!” বলিয়া বিলাপ করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, অমনি পর্ব্বতশ্রেণীর মধ্য হইতে ‘ওঁ ওঁ ওঁ’ প্রতিধ্বনি আসিয়া তাঁহাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করিল। অনন্তর শুরু স্বীয় শরীর পুনগ্রহণ করিলেন এবং জ্ঞানপ্রাপ্তির নিমিত্ত পিতার নিকট আগমন করিলেন। কিন্তু ব্যাস দেখিলেন যে, পুত্রকে দিবার মত তাঁহার কোন জ্ঞানই নাই এবং যদি মিথিলারাজের তাঁহাকে দিবার মত কিছু জ্ঞান থাকে, এই ভাবিয়া তাঁহাকে সীতাদেবীর পিতা জনকের নিকট প্রেরণ করিলেন। তিন দিন তিনি রাজতোরণের বহির্দ্দেশে বসিয়া রহিলেন। কেহ তাঁহার তত্ত্ব লইল না, একবার বাক্যালাপ করিল না, বা চাহিয়াও দেখিল না। চতুর্থ দিবস তিনি সহসা মহাসমারোহে রাজসকাশে নীত হইলেন। তথাপি তাঁহার কোন বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইল না।
তৎপর রাজার প্রধানমন্ত্রি পদে বৃত প্রভাবশালী যোগিবর পরীক্ষার নিমিত্ত এক অনিন্দ্য-সুন্দর নারীরূপ ধারণ করিলেন—এত সুন্দরী যে, উপস্থিত সকলেই তাঁহার উপর হইতে দৃষ্টি অপসারিত করিয়া লইতে বাধ্য হইলেন এবং কেহই কথা কহিতে সাহসী হইলেন না। কিন্তু শুরু তাঁহার নিকট অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে আপন আসনে আনিয়া বসাইলেন এবং তাঁহার সহিত ঈশ্বরীয় কথা কহিতে লাগিলেন।
তখন মন্ত্রিবর জনকের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “রাজন্, যদি আপনি পৃথিবীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির অন্বেষণ করেন, তবে জানিবেন তিনি আপনার সম্মুখে!”
“শুকের জীবনী-সম্বন্ধে আর কিছু জানা নাই। তিনি আদর্শ পরমহংস ছিলেন। মানবগণের মধ্যে একমাত্র তিনিই সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দসাগরের এক গণ্ডুষ জল পান করিয়া কৃতার্থ হইয়াছিলেন! অধিকাংশ যোগীর ইহার তরঙ্গরাজির তটভূমে সংঘাতজনিত অশনি-নির্ঘোষ মাত্র শুনিয়াই মানবলীলা সংবরণ করেন। অল্প কয়েক জন ইঁহার দর্শনলাভ করেন এবং আরও অল্প কয়েক জন ইঁহার আস্বাদমাত্র গ্রহণ করিয়া থাকেন। কিন্তু শুক এই আনন্দপারাবারের জল পান করিয়াছিলেন!”
বাস্তবিক, শুকই স্বামিজীর মনের মতন যোগী ছিলেন। তাঁহার নিকট শুক সেই সর্ব্বোচ্চ অপরোক্ষানুভূতির আদর্শরূপ, যাহার তুলনায় জীবজগৎ ছেলেখেলা মাত্র! বহুদিন পরে আমরা শুনিলাম যে, শ্রীরামকৃষ্ণ কিশোর স্বামিজীকে যেন ‘আমার শুকদেব’ এই বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন। “অহং বেদ্মি শুকো বেত্তি ব্যাসো বেত্তি ন বেত্তি বা”— গীতার প্রকৃত অর্থ আমি জানি এবং শুক জানে, আর ব্যাস জানিলেও জানিতে পারেন। ভগবদ্গীতার গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ এবং শুকের মাহাত্ম্য-দ্যোতক এই শিববাক্য দণ্ডায়মান হইয়া উচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহার মুখে যে অপূর্ব্ব ভাবের বিকাশ হইয়াছিল, তিনি যেন আনন্দ-সমুদ্রের সুদূর তলদেশ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিতেছিলেন—তাহা আমি কখনই ভুলিতে পারিব না।
আলমোড়ায় অবস্থানকালে আর একদিন স্বামিজী হিন্দু-সভ্যতার চিরন্তন উপকূলে আধুনিক চিন্তাতরঙ্গরাজির বহুদুরব্যাপী প্লাবনের প্রথম ফলস্বরূপ বঙ্গদেশে যে সকল উদারহৃদয় মহাপুরুষের আবির্ভাব হইয়াছিল, তাঁহাদিগের কথা বলিয়াছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের কথা আমরা ইতঃপূর্ব্বেই নৈনীতালে তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম। এক্ষণে বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে তিনি সাগ্রহে বলিলেন, “উত্তর ভারতে আমার বয়সের এমন একজন লোক নাই, যাহার উপর তাঁহার ছায়া না পড়িয়াছে!” এই দুই ব্যক্তি এবং শ্রীরামকৃষ্ণ যে একই স্থানে মাত্র কয়েক ক্রোশের ব্যবধানে জন্মিয়াছেন, ইহা মনে হইলে তিনি যারপরনাই আনন্দ অনুভব করিতেন।
স্বামিজী এক্ষণে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমাদের নিকট ‘বিধবাবিবাহ-প্ররর্তনকারী ও বহুবিবাহ-রোধকারী মহাবীর’ বলিয়া উল্লেখ করিলেন। কিন্তু তৎসম্বন্বন্ধে তাঁহার প্রিয় গল্প ছিল সেই দিনকার ঘটনাটী—যে দিন তিনি ব্যবস্থাপক সভা হইতে তাদৃশ স্থানবিশেষে সাহেবী পরিচ্ছদ পরিধান করা বিধেয় কি না, এই বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে গৃহে ফিরিলেন। এমন সময়ে তিনি দেখিলেন যে, ধীরে সুস্থে এবং গুরুগম্ভীর চালে গৃহগমনরত এক স্থূলকায় মোগলের নিকট এক ব্যক্তি দ্রুতপদে আসিয়া সংবাদ দিল, “মহাশয়, আপনার বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছে।” এই সংবাদে মোগলপ্রবরের গতির লেশমাত্রও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিল না; ইহা দেখিয়া সংবাদবাহক ইঙ্গিতে ঈষৎ বিজ্ঞজনোচিত বিস্ময় জানাইয়াছিল। তৎক্ষণাৎ তাঁহার প্রভু সক্রোধে তাহার দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “পাজি! খান করেক বাখারি পুড়িয়া যাইতেছে বলিয়া তুই আমায় আমার বাপ-পিতামহের চাল ছাড়িয়া দিতে বলিস্!” এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাঁহার পশ্চাতে আসিতে আসিতে দৃঢ় সঙ্কল্প করিলেন যে, ধুতি-চাদর এবং চটিজুতা কোনক্রমে ছাড়া হইবে না; ফলে দরবার যাত্রাকালে একটা জামা ও একজোড়া জুতা পর্যন্ত পরিলেন না।
“বালবিধবাগণের বিবাহ চলিতে পারে কি না?”—মাতার এইরূপ সাগ্রহ প্রশ্নে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রপাঠার্থ এক মাসের জন্য নির্জ্জন গমনের চিত্রটি খুব চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। নির্জ্জন বাসের পর তিনি “শাস্ত্র এরূপ পুনর্বিবাহের প্রতিপক্ষ নহেন”—এই নত প্রকাশ করিয়া এতদ্বিষয়ে পণ্ডিতগণের স্বাক্ষরযুক্ত সম্মতি-পত্র সংগ্রহ করিলেন। পরে কতিপয় দেশীয় রাজা ইহার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হওয়ায় পণ্ডিতগণ নিজ নিজ স্বাক্ষর প্রত্যাহার করিলেন; সুতরাং সরকার বাহাদুর এই আন্দোলনের স্বপক্ষে সাহায্য করিতে কৃতসঙ্কল্প না হইলে ইহা কখনই আইনরূপে পরিণত হইত না। স্বামিজী আরও বলিলেন, “আর আজকাল এই সমস্যা সামাজিক ভিত্তির উপর উপস্থাপিত না হইয়া বরং এক অর্থনীতিসংক্রান্ত ব্যাপার হইয়া দাড়াইয়াছে।” যে ব্যক্তি কেবল নৈতিক বলে বহুবিবাহকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তিনি যে প্রভূতআধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ছিলেন, তাহা আমরা অনুধাবন করিতে পারিলাম এবং যখন শুনিলাম যে, এই মহাপুরুষ ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষে, অনাহারে ও রোগে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক কালগ্রাসে পতিত হওয়ায় মর্ম্মাহত হইয়া ‘আর ভগবান মানি না’ বলিয়া সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞেয়বাদের চিন্তাস্রোতে গা ঢালিয়া দিয়াছিলেন, তখন ‘পোষাকী’ মতবাদের উপর ভারতবাসীর কিরূপ অনাস্থা, তাহা সম্যক উপলব্ধি করিয়া আমরা যারপরনাই বিস্ময়াভিভূত হইয়াছিলাম।
বাঙ্গালার আচার্য্যশ্রেণীর মধ্যে একজনের নাম স্বামিজী ইঁহার নামের সহিত উল্লেখ করিয়াছিলেন। তিনি ডেভিড হেয়ার—সেই বৃদ্ধ স্কটল্যাণ্ডবাসী নিরীশ্বরবাদী, মৃত্যুর পর যাঁহাকে কলিকাতার যাজকবৃন্দ ঈশাহীজনোচিত সমাধিদানে অস্বীকার করিয়া-ছিলেন। তিনি বিসূচিকারোগাক্রান্ত এক পুরাতন ছাত্রের শুশ্রূষা করিতে করিতে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁহার নিজ ছাত্রগণ তাঁহার মৃতদেহ বহন করিয়া এক সমতল ভূমিখণ্ডে সমাধিস্থ করিল এবং উক্ত সমাধি তাহাদের নিকট এক তীর্থে পরিণত হইল। সেই স্থানই আজ শিক্ষার কেন্দ্রস্বরূপ হইয়া কলেজস্কোয়ার নামে অভিহিত হইয়াছে, আর তাঁহার বিদ্যালয়ও আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত এবং আজিও কলিকাতার ছাত্রবৃন্দ তীর্থের ন্যায় তাঁহার সমাধিস্থান-দর্শনে গমন করিয়া থাকে।
এইদিন আমরা কথাবার্তার মধ্যে কোন সুযোগে স্বামিজীকে জেরা করিয়া বসিলাম—ঈশাহীধর্ম তাঁহার নিজের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে কি না। এইরূপ সমস্যা যে কেহ সাহস করিয়া উত্থাপন করিতে পারিয়াছে, ইহা শুনিয়া তিনি হাস্যসংবরণ করিতে পারিলেন না এবং আমাদিগকে খুব গৌরবের সহিত বলিলেন যে, তাঁহার পুরাতন স্কট্ল্যাণ্ডবাসী শিক্ষক হেষ্টি সাহেবের সহিত মিশা-মিশিতেই তাঁহার ঈশাহী প্রচারকগণের সহিত একমাত্র সংস্পর্শলাভ ঘটিয়াছিল। এই উষ্ণমস্তিষ্ক বৃদ্ধ অতি সামান্য ব্যয়ে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন এবং নিজ গৃহকে তাঁহার বালকগণেরই গৃহ বলিয়া মনে করিতেন। তিনি সর্ব্বপ্রথমে স্বামিজীকে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন এবং তাঁহার ভারত-প্রবাসের শেষভাগে বলিতেন, “হাঁ বাবা, তুমিই ঠিক বলিয়াছিলে! তুমিই ঠিক বলিয়াছিলে! সত্যই সব ঈশ্বর!” স্বামিজী সানন্দে বলিলেন, “আমি তাঁহার সম্পর্কে গৌরবান্বিত, কিন্তু তিনি যে আমাকে তেমন ঈশাহীভাবাপন্ন করিয়াছিলেন, একথা তোমরা বলিতে পার কি? আমার ত মনে হয় না।” প্রকৃতপক্ষে দেখা গেল যে, তিনি মাত্র ছয়মাস কাল তাঁহার কাছে পড়িয়াছিলেন; কারণ তিনি কলেজে এত অনুপস্থিত ছিলেন যে, জেনারেল এসেম্ব্লি (বর্ত্তমান স্কটিশ চার্চ্চ) কলেজের কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে বি, এ, পরীক্ষা দিতে অনুমতি দেন নাই; যদিও তিনি উহাতে নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হইবেন, এইরূপ ভরসা দিয়াছিলেন।
এতদপেক্ষা লঘুতর প্রসঙ্গেও আমরা চমৎকার চমৎকার গল্প শুনিতাম। তাহার একটি এস্থলে উল্লিখিত হইল। আমেরিকায় এক নগরে স্বামিজী এক ভাড়াটিয়া বাড়ীতে বাস করিতেন। সেখানে তাঁহাকে স্বহস্তে রন্ধন করিতে হইত এবং রন্ধনকালে এক অভিনেত্রী এবং এক দম্পতীর সহিত তাঁহার প্রায়ই দেখা হইত। অভিনেত্রী প্রত্যহ একটি করিয়া পেরু কাবাব করিয়া খাইত এবং সেই দম্পতী লোকের ভূত নামাইয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিত। স্বামিজী ঐ লোকটীকে তাঁহার লোক-ঠকান ব্যবসায় হইতে নিবৃত্ত করিবার জন্য ভৎসনাসহকারে বলিতেন, “তোমার এরূপ করা কখনও উচিত নহে।” অমনি স্ত্রীটি পেছনে আসিয়া দাড়াইয়া সাগ্রহে বলিত, “হাঁ, মহাশয়! আমিও ত উহাকে ঠিক ঐ কথাই বলিয়া থাকি; কারণ উনিই যত ভূত সাজিয়া মরেন, আর টাকাকড়ি যা কিছু তা মিসেস্ উইলিয়াম্স্ই লইয়া যায়।”
তিনি আমাদিগকে এক ইঞ্জিনিয়ার যুবকের গল্পও বলিয়া-ছিলেন। লোকটি লেখাপড়া জানিত। একদিন ভূতুড়ে কাণ্ডের অভিনয়কালে স্থূলকায়া মিসেস্ উইলিয়াম্স্ পর্দার আড়াল হইতে তাহার ক্ষীণকায় জননীরূপে আবির্ভূতা হইলে সে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “মা, মা, তুমি প্রেতরাজ্যে গিয়া কি মোটাই হইয়াছ!” স্বামিজী বলিলেন, “এই দৃশ্য দেখিয়া আমি মর্ম্মাহত হইলাম; কারণ আমার মনে হইল যে, লোকটার মাথা একেবারে বিগড়াইয়াছে।” কিন্তু স্বামিজী হাটবার পাত্র নহেন। তিনি সেই ইঞ্জিনিয়ার যুবককে এক রুশদেশীয় চিত্রকরের গল্প বলিলেন। চিত্রকর এক কৃষকের মৃত পিতার আলেখ্য অঙ্কিত করিতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন এবং আকৃতির পরিচয়স্বরূপ এইমাত্র শুনিয়াছিলেন, “তোমায় ত, বাপু, কতবার বলিলাম যে তাঁর নাকের উপর একটী আঁচিল ছিল!” অবশেষে চিত্রকর এক সাধারণ কৃষকের চিত্র অঙ্কিত করিয়া ও তাহার নাসিকাদেশে এক বৃহৎ আঁচিল বসাইয়া দিয়া ‘ছবি প্রস্তুত’ বলিয়া সংবাদ দিলেন এবং কৃষকপুত্রকে আসিয়া উহা দেখিয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। সে আসিয়া ক্ষণেক চিত্রের সম্মুখে দাড়াইয়া রহিল, পরে শোকবিহ্বলচিত্তে বলিয়া উঠিল, “বাবা! বাবা! তোমার সঙ্গে শেষ দেখা হবার পর তুমি কত বদলে গেছ!” এই ঘটনার পরে ইঞ্জিনিয়ার যুবক আর স্বামিজীর সহিত বাক্যালাপ করিত না। ইহাতে অন্ততঃ এইটুকু বোঝা গিয়াছিল যে, সে একটা গল্পের মর্ম্ম গ্রহণ করিতে পারিত। কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসী তাহাকে রাগিয়া যাইতে দেখিয়া প্রকৃতই বিস্মিত হইয়াছিলেন।
যাহা হউক, এবম্প্রকার সাধারণভাবে মনোরঞ্জন করিবার নানা বিষয় সত্ত্বেও স্বামিজীর মনের ভিতর এই সময় একটা বিরক্তি প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল এবং আমাদের দলের মধ্যে যাঁহারা পুরাণ ছিলেন, তাঁহাদের একজনের মনে এইরূপ দৃঢ় ধারণা হইল যে, আচার্য্যদেবের বিশ্রাম এবং শান্তির প্রয়োজন। অনেকবার মানবজীবনের অশান্তি-নির্যাতনের কথা তিনি বিস্ময় প্রকাশপূর্ব্বক বলিয়াছিলেন এবং তাঁহার বিশ্রাম ও শান্তির যে একাস্ত প্রয়োজন হইয়া উঠিয়াছিল তাহার যে আরও কত নিদর্শন ছিল, তাহা কে বলিবে? এ বিষয়ে তিনি দুই-একটা কথা বলিয়াছিলেন বটে, অতি অল্প হইলেও তাহাই যথেষ্ট। তিনি কয়েক ঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “আমার নির্জ্জন বাসের নিমিত্ত বড়ই আকাঙ্ক্ষা হইয়াছে, আমি একাকী বনপ্রদেশে গমন করিয়া শান্তিলাভ করিব।”
তারপর ঊর্দ্ধে দৃষ্টিপাত করিয়া তিনি মাথার উপর বালশশী দীপ্তি পাইতেছে দেখিলেন এবং বলিলেন, “মুসলমানগণ শুক্লপক্ষীর শশিকলাকে যথেষ্ট আদরের চক্ষে দেখিয়া থাকেন। আইস, আমরাও নবীন শশিকলার সহিত নবজীবন আরম্ভ করি।” এই বলিয়া তিনি তাঁহার মানস কন্যাকে প্রাণ খুলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন এবং কন্যাও বুঝিলেন যে, স্বামিজীর সহিত তাঁহার দ্বন্দ্বভাবরূপ পুরাতন সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হইল। এক নূতন এবং গভীরতম সম্বন্ধ যে উহার স্থান অধিকার করিতেছিল তাহা তিনি ঘুণাক্ষরেও জানিতে পারিলেন না; কেবল এইমাত্র জানিলেন যে, সেই মুহূর্ত্তটি সম্পূর্ণ অভিনব এবং অপরূপ মাধুর্য্যময়।
এইরূপে সেই সংঘর্ষের অবসান হইল এবং উক্ত শিষ্যা এখন হইতে বরাবর স্বামিজীর সর্ব্ববিধ মতামত আপাতদৃষ্টিতে হাজার অসম্ভব বা অপ্রিয় বোধ হইলেও, পরীক্ষার্থ অবাধে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। তৎসম্বন্ধে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া—সে অবসরমত হইবে।
২৫শে মে। তিনি যেদিন যাত্রা করিলেন সেদিন বুধবার। শনিবারে তিনি ফিরিয়া আসিলেন। পূর্ব্বেও তিনি প্রতিদিন দশঘণ্টা করিয়া অরণ্যানীর নির্জ্জনতার মধ্যে বাস করিতেন বটে, কিন্তু রাত্রিকালে নিজ তাঁবুতে ফিরিয়া আসিলে চারিদিক হইতে এত লোক সঙ্গলাভের জন্য সাগ্রহে তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিত যে, তাঁহার ভাবভঙ্গ হইয়া যাইত এবং সেই জন্যই তিনি এইরূপে পলায়ন করিয়াছিলেন। এখন তাঁহার মুখমণ্ডলে জ্যোতিঃ ফুটিয়া উঠিয়াছে। তিনি দেখিয়াছেন যে, তিনি এখনও সেই পুরাতন, নগ্নপদে ভ্রমণক্ষম এবং শীতাতপ ও অন্নাহার-সহিষ্ণু সন্ন্যাসীই আছেন। প্রতীচ্যবাস তাঁহাকে বিকৃত করিতে পারে নাই। এই উপলব্ধি এবং অপর যাহা কিছু তিনি এই কয়দিনে লাভ করিয়াছিলেন, তাহাই এখনকার পক্ষে যথেষ্ট হইয়াছিল এবং আমরা সেভিয়ার সাহেবের উদ্যানে ইউকালিপ্টাস্গুলির তলে এবং চারা গোলাপ গাছগুলির মধ্যে তাঁহার কৃতজ্ঞতাপূর্ণ শান্ত মুখশ্রী দেখিয়া আসিলাম।
৩০শে মে হইতে ২রা জুন। পরবর্তী সোমবার তিনি যাঁহাদের আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই সেভিয়ার দম্পতির সহিত তিনি এক সপ্তাহের জন্য কোন একটী স্থান দেখিবার নিমিত্ত যাত্রা করিলেন এবং আমরা অলমোড়ার থাকিয়া অধ্যয়ন, অঙ্কন ও গাছপালা সংগ্রহ করিয়া উদ্ভিদ্বিদ্যার চর্চা করিতে লাগিলাম। সেই সপ্তাহের একদিন সন্ধ্যায় আমরা মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বসিয়া কথাবার্তা কহিতেছিলাম। কি জানি কেন আমাদের চিন্তা ‘ইন মেমোরিয়াম্’[৩] লইরা ব্যাপৃত ছিল এবং আমাদের মধ্যে একজন সর্ব্বসমক্ষে পাঠ করিলেন:
“তথাপি যতদিন শ্রবণশক্তি থাকিবে, ততদিন এই কর্ণদ্বয়ে একটী ঘণ্টা ধীরমন্থরভাবে ক্রমাগত বাজিতে থাকিবে এবং জানাইয়া দিবে যে, যে প্রিয়তম আত্মা মনুষ্যশরীরে ছিল, তাহা আর মরজগতে নাই। আমি এখনও উহা শুনিতেছি, অবিশ্রান্ত শুনিতেছি, উহা অবিরত গতাসুর উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানাইতেছে; বলিতেছে, তোমার মঙ্গল হউক! মঙ্গল হউক! বিদায়! চিরদিনের মত বিদায়!”
সেইক্ষণেই সুদূর দক্ষিণে আমাদেরই একজন পরমাত্মীয় আমাদের এই ক্ষুদ্র পরিদৃশ্যমান জগদ্রূপ মন্দির হইতে কোন সূক্ষ্মতর জ্যোতির রাজ্যে প্রয়াণ করিতেছিলেন। এ সংসারের পরপারে সেই রাজ্যে ভগবৎসান্নিধ্য স্পষ্টতর হওয়াই সম্ভবপর এবং হয়ত সেই জন্যই সেখানে প্রকাশও উজ্জ্বলতর। কিন্তু আমরা এই দুঃসংবাদ এখন পর্য্যন্ত পাই নাই। আরও একদিবস আমাদের অজানিত কোন কিছুর মসিময়ী ছায়া আমাদিগকে আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছিল। তৎপরে শুক্রবার প্রাতঃকালে আমরা বসিয়া কাজ কর্ম্ম করিতেছিলাম, এমন সময়ে এক ‘তার’ আসিল। তারটী একদিন দেরীতে আসিয়াছিল। তাহাতে লেখা ছিল—‘কল্য রাত্রে উৎকণমন্দে গুড্উইনের দেহত্যাগ হইয়াছে।’ প্রকাশ পাইল যে, সে অঞ্চলে যে সান্নিপাতিকের মহামারীর সূত্রপাত হইতেছিল, আমাদের বন্ধু তাহারই করালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন এবং দেখা গেল যে, তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্য্যন্ত স্বামিজীর কথা কহিয়াছিলেন এবং তিনি যেন পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ান, সাগ্রহচিত্তে এইরূপ আকাঙ্ক্ষা করিয়াছিলেন।
৫ই জুন। রবিরার সন্ধ্যার সময় স্বামিজী স্বীয় আবাসে ফিরিয়া আসিলেন। আমাদের ফটক ও উঠান হইয়া তাঁহার রাস্তা গিয়াছিল। তিনি সেই রাস্তা ধরিয়া আসিলেন এবং সেই প্রাঙ্গণে আমরা মুহূর্ত্তেকের জন্য বসিয়া তাঁহার সহিত কথা কহিলাম। তিনি আমাদের দুঃসংবাদের বিষয় অবগত ছিলেন না, কিন্তু ইতঃপূর্ব্বেই তাঁহাকেও যেন এক গভীর বিষাদচ্ছায়ায় আচ্ছন্ন করিয়াছিল এবং অনতিবিলম্বেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া তিনি আমাদিগকে সেই মহাপুরুষের কথা স্মরণ করাইয়া দিলেন, যিনি গোখুরা সর্প কর্ত্তৃক দৃষ্ট হইয়া ‘প্রেমময়ের নিকট হইতে দ্রুত আসিয়াছে’ এইমাত্র বলিয়াছিলেন এবং যাহাকে স্বামিজী শ্রীরামকৃষ্ণের পরেই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভালবাসিতেন। তিনি বলিলেন, “এইমাত্র আমি এক পত্র পাইলাম, তাহাতে লেখা আছে—পত্তহারী বাবা নিজ দেহ দ্বারা তাঁহার যজ্ঞসমূহের পূর্ণাহুতি প্রদান করিয়াছেন। তিনি হোমাগ্নিতে স্বীয় দেহ ভস্মীভূত করিয়াছেন।” তাঁহার শ্রোতৃবৃন্দের মধ্য হইতে একজন বলিয়া উঠিলেন, “স্বামিজী! এটি কি অত্যন্ত খারাপ কাজ হয় নাই?”
স্বামিজী গভীরআবেগ-কম্পিতকণ্ঠে উত্তর করিলেন, “তাহা আমি জামি না। তিনি এত বড় মহাপুরুষ ছিলেন যে, আমি তাঁহার কার্য্যকলাপ বিচার করিবার অধিকারী নহি। তিনি কি করিতেছিলেন, তাহা তিনি স্বয়ংই জানিতেন।”
ইহার পর আজ প্রায় কোন কথাবার্ত্তা হইল না এবং সন্ন্যাসিগণ গন্তব্য স্থানে চলিয়া গেলেন। তখনও অপর সংবাদটির কথা তাঁহাদিগকে জানান হয় নাই।
৬ই জুন। পরদিন প্রাতে তিনি খুব সকাল সকাল আসিলেন। দেখিলাম, তিনি এক গভীর ভাবে ভাবিত। তিনি পরে বলিলেন যে, তিনি রাত্রি চারিটা হইতে উঠিয়াছিলেন এবং একজন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইয়া গুড্উইন সাহেবের মৃত্যুসংবাদ তাঁহাকে দিয়াছিল। আঘাতটি তিনি নীরবে সহিয়া লইলেন। কয়েক দিন পরে তিনি যে স্থানে ইহা প্রথম পাইয়াছিলেন, সে স্থানেই আর থাকিতে চাহিলেন না; বলিলেন, তাঁহার সর্ব্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত শিষ্যের আকৃতি রাতদিন তাঁহার মনে পড়িতেছে এবং ইহা যে দুর্ব্বলতা, একথাও জ্ঞাপন করিলেন। ইহা যে দোষাবহ, তাহা দেখাইবার জন্য তিনি বলিলেন যে, কাহারও স্মৃতি দ্বারা এইরূপে পীড়িত হওয়াও যা আর ক্রমবিকাশের উচ্চতর সোপানে মৎস্য কিংবা কুকুর-সুলভ লক্ষণগুলি অবিকল বজায় রাখাও তাই, ইহাতে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নাই। মানুষকে এই ভ্রম জয় করিতে হইবে এবং জানিতে হইবে যে, মৃতব্যক্তিগণ যেমন আগে ছিলেন, এখনও ঠিক তেমনি এইখানে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন। তাঁহাদের অনুপস্থিতি এবং বিচ্ছেদটাই শুধু কাল্পনিক। আবার পরক্ষণেই কোন ব্যক্তিবিশেষের (সগুণ ঈশ্বরের) ইচ্ছানুসারে এই জগৎ পরিচালিত হইতেছে, এইরূপ নির্ব্বুদ্ধিতামূলক কল্পনার বিরূদ্ধে তিনি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, “গুড্উইনকে মারিয়া ফেলার জন্য মনে কর কি এরূপ এক ঈশ্বরকে যুদ্ধে নিপাত করাটা যেন মানুষের অধিকার এবং কর্ত্তব্যের মধ্যে নহে!–গুড্উইন্ বাঁচিয়া থাকিলে কত বড় বড় কাজ করিতে পারিত!” অন্ততঃ ভারতবর্ষে মনের এইরূপ ভাবকে ধর্ম্মের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ভাব বলিয়া মানিয়া লইতে কাহারও কোন বাধা নাই, কারণ এই অবিচলিত ভাবই সর্ব্বোচ্চ সত্যের সর্ব্বাপেক্ষা অধিক অনুগামী।
স্বামিজীর এই উক্তিটির সহিত এক বৎসর পরে যে আর একটি উক্তি শুনিয়াছিলাম তাহার উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। আমরা যে সকল অলীক কল্পনাসহায়ে সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করি, তাহা দেখিয়া ঠিক এইরূপ ভীব্র বিস্ময়ের সহিত তিনি বলিয়া উঠিয়াছিলেন, “দেখ, প্রত্যেক ক্ষুদ্র শাসক এবং কর্ম্মচারীর জন্য ছুটির ও বিশ্রামের সময় নির্দিষ্ট আছে। আর সনাতন নিয়ন্তা ঈশ্বরই বুঝি শুধু চিরকাল বিচারাসনেই বসিয়া থাকিবেন, তাঁহার আর কখনও ছুটি মিলিবে না!”
কিন্তু এই প্রথম কয় ঘণ্টা স্বামিজী তাঁহার বিয়োগদুঃখে অটল রহিলেন এবং আমাদের সহিত বসিয়া ধীরভাবে নানা কথা কহিতে লাগিলেন। সেদিন প্রাতঃকালে তিনি ক্রমাগত ভক্তির পরিণত ফলস্বরূপ যে ত্যাগ তাহারই কথা বলিতে লাগিলেন—কিরূপে প্রগাঢ় ভগবৎ-প্রেমের খরতর প্রবাহ মনুষ্যগণকে ব্যক্তিত্বের সীমানা ছাড়াইয়া বহুদূর ভাসাইয়া লইয়া যাইলেও আবার তাহাকে এমন এক স্থানে ছাড়িয়া দিয়া যায়, যেখানে সে ব্যক্তিত্বের মধুর পাশবন্ধন হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য ছট্ফট্ করে।
সেদিন সকালের ত্যাগসম্বন্ধীয় উপদেশসমূহ শ্রোতৃবর্গের মধ্যে এক জনের নিকট অতি কঠিন বলিয়া বোধ হইল এবং তিনি পুনরার আসিলে উক্ত মহিলা তাঁহাকে বলিলেন, “আমার ধারণা, অনাসক্ত হইয়া ভালবাসায় কোনরূপ দুঃখোৎপত্তির সম্ভাবনা নাই এবং ইহা স্বয়ংই সাধ্যস্বরূপ।”
হঠাৎ গভীরভাব ধারণ করিয়া স্বামিজী তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিতে লাগিলেন, “এই যে ত্যাগ-রহিত ভক্তির কথা বলিতেছি, এটা কি? ইহা অত্যন্ত হানিকর!” এবং প্রকৃতপক্ষে অনাসক্ত হইতে হইলে কিরূপ কঠোর আত্মসংযমের অভ্যাস আবশ্যক, কিরূপে স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলির আবরণ উন্মোচন করা চাই এবং অতি কুসুমসুকুমার হৃদয়েরও যে, যে কোন মুহূর্তে সংসারের পাপ-কালিমায় কলুষিত হইবার আশঙ্কা বর্ত্তমান, এই সম্বন্ধে তিনি সেইখানে এক ঘণ্টা বা ততোধিক কাল দাঁড়াইয়া বর্ণনা করিতে লাগিলেন। তিনি সেই ভারতবর্ষীয়া সন্ন্যাসিনীর কথা উল্লেখ করিলেন, যিনি মানুষ কথন ধর্ম্মপথে আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ জ্ঞান করিতে পারে, এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া এক খুরি ছাই উত্তরস্বরূপে প্রেরণ করিয়াছিলেন। কারণ রিপুগণের বিরূদ্ধে সংগ্রাম সুদীর্ঘ ও ভয়ঙ্কর এবং যে কোন মুহূর্ত্তেই বিজেতার বিজিত হইবার আশঙ্কা রহিয়াছে।
তাঁহার কথা শুনিতে শুনিতে মনে হইতে লাগিল, যেন এই ত্যাগের পতাকা এক মহান্ বিজয়ের পতাকা, যেন “চিরন্তন বধূস্বরূপ শ্রীভগবানকে বিবাহেচ্ছু আত্মার নিকট দৈন্য এবং আত্মজয়ই একমাত্র উপযুক্ত আভরণ এবং জীবনটা যেন দানযজ্ঞের এক সুদীর্ঘ সুযোগ, আর আমাদের আমার বলিতে যদি এমন কিছু থাকে যাহার প্রার্থী আমরা পাই না, সেইটাই শুধু নষ্ট হইল মনে করিয়া দুঃখপ্রকাশ করা উচিত।” বহু সপ্তাহ পরে কাশ্মীরে যখন তিনি পুনরায় এই ভাবের কথা কহিতেছিলেন, সেই সময় আমাদের মধ্যে একজন সাহস করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল যে, তিনি এইরূপে যে ভাবের উদ্রেক করিয়া দিতেছেন, উহা ইউরোপে যে দুঃখোপাসনাকে রোগীর লক্ষণ বলিয়া অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখে, তাহাই কি না।
মুহূর্ত্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া স্বামিজী উত্তর করিলেন, “আর সুখের পুজাটাই বুঝি ভারী উঁচুদরের জিনিস?” তারপর একটু থামিয়া পুনরায় বলিলেন, “কিন্তু আসল কথা এই যে, আমরা দুঃখেরও পূজা করি না, সুখেরও পূজা করি না। এই উভয়ের মধ্য দিয়া যাহা সুখ-দুঃখের অতীত, তাহাই লাভ করা আমাদের উদ্দেশ্য।”
৯ই জুন। এই বৃহস্পতিবার প্রভাতে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে কথাবার্তা হইল। স্বামিজীর মনের তাঁহার জন্মগত হিন্দুশিক্ষাদীক্ষাসুলভ এক বিশেষত্ব এই ছিল যে, তিনি হয়ত একদিন কোন একটী ভাবে ভাবিত হইয়া সেই ভাবের গুণব্যাখ্যা করিলেন, আবার পর দিনই হয়ত তাহাকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করিয়া একেবারে নির্জ্জীব করিয়া ছাড়িয়া দিতে পারিতেন। তিনি তাঁহার স্বজাতিসুলভ এই বিশ্বাসের এত পূর্ণমাত্রার অধিকারী ছিলেন যে, যদি কোন ভাব আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সত্য এবং যুক্তিসহ হয়, তাহা হইলে উহার বাস্তব সত্তা থাকুক বা না থাকুক, তাহাতে কিছুই আসে যায় না। এইরূপ চিন্তা প্রণালীর প্রথম আভাস তিনি বাল্যকালে তাঁহার আচার্য্যদেবের নিকট প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। কোন এক ধর্ম্মেতিহাসে প্রামাণিকতা বিষয়ে সন্দিহান হওয়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “কি! তাহা হইলে তুমি কি মনে কর না যে, যাহারা এরূপ সব ভাবের ধারণা করিতে পারিত, তাহারা নিশ্চিত সেই সব ভাবেরই যেন মূর্ত্তিমান্ বিগ্রহ ছিল?”
সুতরাং, যেমন খ্রীষ্টের অস্তিত্ব বিষয়ে তেমনই শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও তিনি কখনও কখনও তাঁহার স্বভাবসুলভ সাধারণ সন্দেহের ভাবেও কথাবার্ত্তা বলিতেন। “ধর্ম্মাচার্য্যগণের মধ্যে কেবল বুদ্ধ ও মহম্মদের ভাগ্যেই ‘শত্রু-মিত্র উভয়’-লাভই ঘটিয়াছিল, সুতরাং তাঁহাদের জীবনের ঐতিহাসিক অংশে সন্দেহের লেশমাত্র নাই। আর শ্রীকৃষ্ণ, তিনি ত সকলের চেয়ে বেশী বাস্তবতাশূন্য। কবি, রাখাল, শক্তিশালী শাসক, যোদ্ধা এবং ঋষি―হয়ত এই সব ভাবগুলি একত্রীকৃত হইয়া গীতাহস্তে এক সুন্দরমূর্ত্তিরূপে পরিণত হইয়াছিল।”
কিন্তু আজ শ্রীকৃষ্ণ সকল অবতারগণের মধ্যে আদর্শস্থানীয় বলিয়া বর্ণিত হইলেন এবং তারপরই ভগবান সারথিবেশে অশ্বগুলিকে সংযত করিয়া রণক্ষেত্রের চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন এবং নিমেষে ব্যুহসংস্থান লক্ষ্য করিয়া লইয়া শিষ্যস্থানীয় রাজপুত্রকে গীতার গভীর আধ্যাত্মিক সত্যগুলি শুনাইতে আরম্ভ করিলেন—এই মর্ম্মের এ অদ্ভুত চিত্র অঙ্কিত হইল।
বাস্তবিকই এই গ্রীষ্মঋতুতে উত্তরভারতের এক অংশ হইতে অংশান্তরে গমনকালে আমরা এই কৃষ্ণলীলা লোকের উপর কিরূপ আধিপত্য বিস্তার করিয়াছে, তাহা লক্ষ্য করিবার অনেক সুযোগ পাইয়াছিলাম। রাস্তার ধারে গ্রামগুলিতে নর্ত্তকগণ নৃত্যকালে যে সকল গান গাহিত, তাহা সব রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক। এতদ্ভিন্ন স্বামিজী একটা কথা বারংবার বলিতেন (অবশ্য ইহার সম্বন্ধে আমাদের কোন মতামতই ছিল না) যে, ভারতবর্ষীয় বৈষ্ণবগণ কল্পনামূলক গীতিকাব্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন।
তবে কি গোপীগণের সেই অপূর্ব্ব পুরাতন কাহিনী সত্য সত্যই কোন পশুপালকগণের মধ্যে প্রচলিত পুজার অংশবিশেষ, যাহা অপেক্ষাকৃত আধুনিক কোন প্রথার অঙ্গীভূত হইয়া এই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম আলোকেও নিজ নাট্যোচিত কোমলতা ও আনন্দটুকু বজায় রাখিয়া অব্যাহতভাবে বাঁচিয়া রহিয়াছে?
কিন্তু এই কয় দিবস যাবৎ স্বামিজী কোথাও গিয়া একাকী বাস করিবার জন্য ছট্ ফট্, করিতেছিলেন। যে স্থানে তিনি গুড্উইনের মৃত্যুসংবাদ পাইয়াছেন, সেই স্থান তাঁহার নিকট অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল এবং পত্র-আদান-প্রদানে সেই ক্ষত ক্রমাগত নূতন হইয়া উঠিতেছিল। একদিন তিনি বলিয়াছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ বাহির হইতে কেবল ভক্তিময় বলিয়া মনে হইলেও প্রকৃতপক্ষে ভিতরে ভিতরে পূর্ণ জ্ঞানময় ছিলেন, কিন্তু তিনি (স্বামিজী) নিজে বাহ্যতঃ কেবল জ্ঞানময় বলিয়া মনে হইলেও ভিতরে ভিতরে ভক্তিতে পূর্ণ এবং সেইজন্য তিনি কখনও কখনও স্ত্রীলোকের ন্যায় দুর্ব্বল হইয়া পড়িতেন।
একদিন তিনি কোন একজনের লেখার কয়েকটী দোষযুক্ত পংক্তি হইয়া গেলেন এবং উহাকে একটী ক্ষুদ্র কবিতারূপে ফিরাইয়া আনিলেন। সেটা স্বামিহীনা গুড্উইন্-জননীকে তাঁহার পুত্রের স্মরণে স্বামিজী-প্রদত্ত চিহ্নস্বরূপে প্রেরিত হইল।
তাহার শক্তিলাভ হউক![৪]
“হে আত্মন্, তোমার তারকা-বিকীর্ণ পথে ছুটিয়া চল। হে আনন্দস্বরূপ, সেই লোকে দ্রুত গমন কর যথায় চিন্তাস্রোত সদাই স্বাধীনভাবে বহিয়া থাকে, যথায় মানবের দৃষ্টি কাল ও ইন্দ্রিয়গ্রাম দ্বারা আর অবরুদ্ধ হয় না। শাশ্বত শান্তি ও আশীর্ব্বাদ তোমার উপর বর্ষিত হউক।
“তোমার সেবা প্রকৃত সেবা ছিল, তোমার আত্মত্যাগযজ্ঞ পূর্ণ হইয়াছে। এখন অতীন্দ্রিয় আনন্দঘন তোমার আবাসস্বরূপ হউক, দেশকালের ব্যবধান যাহা লোপ করিয়া দেয়, সেই মধুর স্মৃতি বেদীর উপর স্থাপিত গোলাপস্তবকের মত জগতে তোমার স্থান পূর্ণ করুক।
“তোমার বন্ধনসকল টুটিয়াছে, পরম নিবৃত্তিলাভ করার আর তোমার প্রাপ্তব্য কিছুই নাই; যাহা জন্ম ও মৃত্যুরূপে আসিয়া থাকে, সেই বস্তুর সহিত তুমি তাদাত্ম্য প্রাপ্ত হইয়াছ। তুমি চিরকাল অপরকে সাহায্য করিয়াই আসিয়াছ; জগতে তোমার প্রতি কার্য্যই নিঃস্বার্থ ছিল এখন ঐ পথেই অগ্রসর হও, এই দ্বন্দ্বপূর্ণ জগৎকে চিরকাল প্রেমদানে সাহায্য করিতে থাক।”
তৎপরে আসল কবিতাটীর কিছুই রহিল না বলিয়া এবং যাঁহার লেখা সংশোধিত হইল (উক্ত লেখিকার পংক্তিগুলি ত্রিপদী ছন্দে ছিল) তিনি ক্ষুণ্ন হইবেন এইরূপ আশঙ্কা করিয়া, তিনি আগ্রহসহকারে অনেকক্ষণ ধরিয়া কেবল ছন্দ ও মাত্রা মিলাইয়া কথা গাঁথা অপেক্ষা কবিত্বপূর্ণভাবে অনুভব করা কত বড় জিনিস, তাহাই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করিতে লাগিলেন। কোন সহানুভূতি বা মত তাঁহার চক্ষে ভাবপ্রবণ বা অযথার্থ বোধ হইলে তিনি তাহার প্রতি খুব কঠোর হইতে পারিতেন, কিন্তু কেহ চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য্য হইলে আচার্য্যদেব সর্ব্বদা আগ্রহ এবং কোমলতার সহিত তাঁহার পক্ষ সমর্থন করিতেন।
আর পুত্রহারা জননীও কত আনন্দের সহিত তাঁহার কবিতার প্রাপ্তিস্বীকার করিয়াছিলেন এবং শোকভারাক্রান্তা হইলেও সুদূর প্রবাসে পরলোকগত স্বীয় পুত্রের উপর স্বামিজী যে সৎ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন, তজ্জন্য তাঁহাকে ধন্যবাদ দিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন।
১০ই জুন। আলমোড়া-বাসের শেষদিন অপরাহ্ণে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের সেই প্রাণঘাতিনী পীড়ার গল্প শুনিলাম। ডাক্তার শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রলাল সরকার আহূত হইয়াছিলেন। তিনি আসিয়া রোগীকে রোহিণী নামক ব্যাধি (Cancer) বলিয়া নির্দ্দেশ করেন এবং ফিরিবার পূর্ব্বে ইহা যে সংক্রামক রোগ, তাহা শিষ্যগণকে বহুবার বুঝাইয়া দেন। অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে ‘নরেন্দ্র’ (তখন তাঁহার ঐ নাম ছিল) আসিলেন এবং দেখিলেন, উহারা একত্র হইয়া রোগের বিপজ্জনকত্বের আলোচনা করিতেছেন। তিনি ডাক্তার কি বলিয়া গিয়াছেন নিবিষ্টচিত্তে শুনিলেন এবং তৎপরে মেজের দিকে তাকাইয়া পায়ের গোড়ায় শ্রীরামকৃষ্ণের পীতাবশিষ্ট পায়সের বাটিটা দেখিতে পাইলেন। গলদেশের খাদ্যবহা নলীটীর সঙ্কোচবশতঃ শ্রীরামকৃষ্ণ উক্ত পায়স গলাধঃকরণ করিতে অনেকবার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়াছিলেন, সুতরাং উহা তাঁহার মুখ হইতে বার বার বাহির হইয়া পড়িয়াছিল এবং ঐ দুঃসাধ্য রোগের বীজাণুপূর্ণ শ্লেষ্মা ও পুজ নিশ্চয়ই তাহার সহিত ছিল। ‘নরেন্দ্র’ বাটিটা উঠাইয়া লইয়া সর্ব্বসমক্ষে উহা নিঃশেষে পান করিয়া ফেলিলেন। ক্যান্সারের সংক্রামকতার কথা আর কখনও শিষ্যগণের মধ্যে উত্থাপিত হয় নাই।
- ↑
“Oh loose me! Seest thou not my Bridegroom's face,
That draws me to him? For His feet my kiss,
My hair, my tears, He craves to-day―And oh!
What words can tell what other day and place
Shall see me clasp those blood-stained feet of His?
He needs me, calls me, loves me, let me go!” - ↑ শুকোপাখ্যানের এইরূপ বর্ণনায় পাঠকের খট্কা লাগিতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে হয়, সিষ্টার নিবেদিতা এখানে ইচ্ছাপূর্ব্বক এইরূপেই ঘটনাগুলিকে বর্ণনা করিয়াছেন–হয় ইহাকে অধিকতর স্বাভাবিকভাবে অঙ্কিত করিবার জন্য, নয়ত শুকের হৃদয়ে যে গভীর প্রেম বিদ্যমান ছিল তাহারই আভাস দিবার জন্য; কারণ শুক জানিতেন যে জন্মিবামাত্রই তিনি পিতামাতা, পরিজন, গৃহ এবং সর্ব্বস্ব ভগবংপ্রেমের উদ্দেশ্যে বিসর্জ্জন দিবেন এবং তাহাতে সকলের বিশেষতঃ তাঁহার জননীর মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হইবে। আখায়িকাটির শেষাংশ পড়িবার সময়ও পাঠক এই বিষয়টা স্মরণ রাখিবেন।
- ↑ In Memorium―ইংরেজ কবি টেনিসন-প্রণীত প্রসিদ্ধ শোকগীতিকাব্য। তাঁহার প্রিয় বন্ধু আর্থার হেনরী হালামের মৃত্যুতে রচিত।
- ↑ ‘বীরবাণী’র Requiescat in Peace-শীর্ষক কবিতা দ্রষ্টব্য।