স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/কাঠগুদামের পথে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কাঠগুদামের পথে

 ১১ই জুন। শনিবার প্রাতে আমরা আলমোড়া পরিত্যাগ করিলাম। কাঠগুদাম পৌঁছিতে আমাদের আড়াই দিন লাগিয়াছিল। আহা! কি অপরূপ সৌন্দর্য্যের মধ্য দিয়াই পথটুকু অতিবাহিত হইয়াছিল। নিবিড় অরণ্যানী–গ্রীষ্ম প্রধান দেশেরই সব গাছপালা, দলে দলে বানর, আর চির-বিস্ময়কর ভারতের রজনী।

 রাস্তার এক স্থানে এক অদ্ভুত রকমের পুরাণ পানচাক্কীর এবং শূন্য কামারশালের কাছে আসিয়া স্বামিজী ধীরামাতাকে বলিলেন, “লোকে বলে, এই পার্ব্বত্য অংশে একজাতীয় গন্ধর্ব্বসদৃশ অশরীরী জীবের বাস। আমি একটি সত্য ঘটনা জানি, তাহাতে এক ব্যক্তি এইখানে প্রথমে ঐ সকল মূর্ত্তির দর্শন পান এবং তাহার বহু পরে এই জনশ্রুতির বিষয় অবগত হন।”

 এখন গোলাপের মরসুম উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু অপর একপ্রকার ফুল (কামিনী ফুল) ফুটিয়া রহিয়াছিল, স্পর্শমাত্রেই উহা ঝরিয়া পড়ে। ভারতীয় কাব্যজগতের সহিত ইহার স্মৃতি বিশেষভাবে জড়িত বলিয়া স্বামিজী উহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন।

 ১৩ই জুন। রবিবার অপরাহ্ণে আমরা সমতল ভূমির সন্নিকটে একটা হ্রদ ও জলপ্রপাতের উপরিভাগে একস্থানে বিশ্রাম করিলাম। সেই আমাদের নিকট এক অদ্ভুত ঢং-এর হোটেল বলিয়া মনে হইল। সেইখানে স্বামিজী আমাদের জন্য রুদ্র-স্তুভিটীর অনুবাদ করিলেন। “অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময়, আবিরাবির্ম এধি, রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্।”—অর্থাৎ আমাদিগকে অসৎ হইতে সতে লইয়া যাও, আমাদিগকে তমঃ হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাও, আমাদিগকে মৃত্যু হইতে অমৃতে লইয়া যাও, আমাদিগের নিকট আবির্ভূত হও, আবির্ভূত হও, আমাদিগের নিকট আগমন কর। হে রুদ্র, তোমার যে দক্ষিণ মুখ, তদ্দ্বারা আমাদিগকে নিত্য রক্ষা কর।

 ‘আবিরাধির্ম এধি’—এই অংশের অনুবাদে তিনি অনেকক্ষণ ইতস্ততঃ করিলেন, ভাবিতে লাগিলেন ইহার অনুবাদ এইরূপ দিবেন কি না: “আমাদের অন্তগুলে আসিয়া আমাদের সহিত মিলিত হও।” কিন্তু অবশেষে তিনি আমাদের নিকট তাঁহার চিন্তার কারণ ব্যক্ত করিয়া সঙ্কোচের সহিত বলিলেন, “ইহার আসল মানে এই—আমাদেরই ভিতর দিয়া আমাদের নিকট আইস।” তিনি স্পষ্টই ভয় করিয়াছিলেন যে, এই স্বল্পাক্ষর বাক্যটি অপূর্ব্ব গম্ভীরার্থ বলিয়া ইংরেজীতে ইহার ঠিক ঠিক অর্থবোধ হইবে না। কিন্তু সেদিন বৈকালে আমরা যাহা নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করিয়াছিলাম, সেই অর্থটীই পরে আমার নিজের চক্ষে খুব প্রামাণিক বলিয়া বোধ হইয়াছে। কারণ আমি বুঝিয়াছি যে, ইহার আরও আক্ষরিক অনুবাদ এইরূপ হইবে: “হে রুদ্র, তুমি কেবল তোমার নিজের নিকটেই প্রকাশিত আছ, তুমি আমাদের নিকটেও আত্মপ্রকাশ কর।” এক্ষণে আমি তাঁহার অনুবাদটীকে সমাধিকালীন অনুভূতিরই এক ক্ষিপ্র ও সাক্ষাৎ প্রতিরূপমাত্র বলিয়া মনে করি। উহা যেন সংস্কৃতের মধ্য হইতে সজীব হৃদয়টিকে পৃথক্ করিয়া লইয়া তাহাকেই পুনরায় ইংরেজী ভাষার আবরণে প্রকাশ করিতেছে।

 বাস্তবিকই সে অপরাহ্ণটি যেন শুধু অনুবাদের শুভলগ্ন বলিয়া মনে হইল এবং তিনি হিন্দুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অঙ্গীভূত অতি সুন্দর মন্ত্রগুলির অন্যতম ত্রিসুপূর্ণ মন্ত্রটীর[] কতিপয় স্থল আমাদের নিকটে অনুবাদ করিয়া দিলেন:

 আমি পরব্রহ্মকে লাভ করিতে ইচ্ছা করিতেছি; বায়ুসকল আমার অনুকূল হউক, নদীসকল অনুকূল হউক, ঔষধিসকল অনুকূল হউক, রাত্রি ও ঊষা আমাদের অনুকূল হউক, পৃথিবীর ধূলি আমাদের অনুকূল হউক; আমাদের দ্যৌরূপী পিতা অনুকূল হউন, বনস্পতিসকল আমাদের অনুকূল হউক, সূর্য্য অনুকূল হউন। গোসকলও আমাদের অনুকূল হউক। ওঁ মধু, ওঁ মধু, ওঁ মধু।

 পরে স্বামিজী খেতড়ীর নর্ত্তকীর্‌ নিকট যে সুরদাসের গানটী শুনিয়াছিলেন, তাহাই আমাদের নিকট পুনরায় গাহিলেন:

প্রভু মেরা অবগুণ চিত ন ধরো,
সমদরণী হৈ নাম তিহারো,

চাহে তো পার করো॥
এক লোহা পূজা মে রখত
এক রহত ব্যাধ ঘর পর,
পরশ কে মন দ্বিধা নহী হৈ,
দুহুঁ এক কাঞ্চন করো॥
ইক নদীয়া ইক নার কহাবত মৈলী নীর ভরো।
জব্‌, মিলি দোনো এক বরণ ভয়ো সুরসুরি নাম পর;
ইক মায়া ইক ব্রহ্ম কহাবত সুরদাস ঝগেরো।
অজ্ঞানসে ভেদ হোবে, জ্ঞানী কাহে ভেদ করো॥

 সম্ভবতঃ সেই দিন কি আর এক দিন তিনি আমাদের নিকট কাশীর সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর কথা বলিলেন, যিনি তাঁহাকে একপাল বানর কর্তৃক উত্যক্ত দেখিয়া এবং তিনি পশ্চাদ্‌পদ হইয়া ফিরিয়া পলাইতে পারেন এই আশঙ্কা করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিয়াছিলেন, “সর্ব্বদা জানোয়ারগুলির সম্মুখীন হইও।”

 বড় আনন্দেই আমরা উক্ত কয়দিন পথ চলিয়াছিলাম। প্রতিদিনই চটিতে পৌঁছিলাম বলিয়া দুঃখবোধ হইত। এই সময়ে রেলযোগে তরাই নামক সেই ম্যালেরিয়াগ্রস্ত ভূখণ্ড অতিক্রম করিতে আমাদের একটা সারা বিকাল লাগিয়াছিল এবং স্বামিজী আমাদের স্মরণ করাইয়া দিলেন যে, ইহাই বুদ্ধের জন্মভূমি। পার্ব্বত্য পথ দিয়া অবতরণকালে আমরা দেখিলাম যে, সমতলবাসিগণ দলে দলে সপরিবারে ও সমস্ত জিনিষ পত্র লইয়া বর্ষার প্রারম্ভে যে জ্বরের প্রাদুর্ভাব হইবে, তাহার আক্রমণ হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য উচ্চতর পাহাড়-অঞ্চলে পলায়ন করিতেছে। এক্ষণে রেলগাড়ীতে যাইতে যাইতে গাছ-পালার ক্রমিক পরিবর্ত্তন আমাদের নজরে পড়িতে লাগিল, আর আমাদিগকে বন্য ময়ুরের ঝাঁক অথবা এখানে সেখানে এক আধটা হাতী বা একসারি উট দেখাইতে দেখাইতে স্বামিজীর কি আনন্দ! তাহাদের মালিকদেরও বুঝি এগুলিকে দেখাইয়া এত আনন্দ হইত না।

 অনতিবিলম্বেই আমরা তালবনের রাজ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। Yucca এবং ফণীমনসার এলাকা আমরা পূর্ব্বদিনেই ছাড়াইয়া আসিয়াছি এবং সুদূর আচ্ছাবল না পৌঁছান পর্য্যন্ত আমরা আর দেবদারুজাতীয় বৃক্ষগুলি দেখিতে পাইব না।

  1. “মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। মাধ্বীর্নঃ সত্ত্বোষধীঃ। মধু নক্তমুতোষসি মধুমৎপার্থিবং রজঃ। মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা। মধুমান্নো বনস্পতিমধুমাৎ অস্ত সূর্য্যঃ। মাধ্বীগাবে। ভবত্ত নঃ। ওঁ মধু ওঁ মধু ওঁ মধু।”
     ইংরেজী অনুবাদের বাঙ্গালা না দিয়া একটা স্বতন্ত্র অনুবাদ উপরে দেওয়া হইল।