স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/বারামুল্লার পথে
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বারামুল্লার পথে
ব্যক্তিগণ: শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ, তদীয় গুরুভ্রাতৃবুল এবং শিল্পমণ্ডলী একদল ইউরোপীয় নরনারী, ধীরা মাতা, জয়া এবং নিবেদিতা তাঁহাদের অন্যতম।}}
স্থান: বেরিলী হইতে কাশ্মীরান্তঃপাতী বারামুলা পর্য়্যন্ত।
সময়: ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দের ১০ই হইতে ২৪শে জুন পর্য়্যন্ত।
১৪ই জুন। পরদিন আমরা পঞ্জাব প্রবেশ করিলাম; এই ঘটনায় স্বামিজী অতি উল্লসিত হইলেন। এই প্রদেশের প্রতি তাঁহার এরূপ ঘনিষ্ঠতা ও এত প্রীতি ছিল যে, উহা ঠিক যেন তাঁহার জন্মভূমি বলিয়া প্রতীতি হইত। স্বামিজী বলিলেন, “সেখানে মেয়েরা চরকা কাটিতে কাটিতে তাহার সোহহং, সোহহং ধ্বনি শুনিয়া থাকে।” বলিতে বলিতে সহসা বিষয়ান্তর গ্রহণ করিয়া তিনি সুদূর অতীতে চলিয়া গেলেন এবং আমাদের নয়নসমক্ষে যবনগণের সিন্ধুনদতীরে অভিযান, চন্দ্রগুপ্তের আবির্ভাব এবং বৌদ্ধসাম্রাজ্যের বিবৃদ্ধি—এই সকল মহান্ ঐতিহাসিক দৃশ্যাবলী একে একে উদ্ঘাটন করিতে লাগিলেন। এই গ্রীষ্মে তিনি যেমন করিয়া হউক আটক পর্য়্যন্ত গিয়া যেখানে বিজয়ী সেকেন্দর প্রতিহত হইয়াছিলেন, সেই স্থানটা স্বচক্ষে দর্শন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন। তিনি আমাদের নিকট গান্ধার-ভাস্কর্য্যের বর্ণনা করিলেন (তিনি নিশ্চয়ই সেগুলিকে পূর্ব্ব বৎসর লাহোরের যাদুঘরে দেখিয়া থাকিবেন) এবং “কলাবিদ্যাসম্বন্ধে ভারতবর্ষ চিরকাল যবনগণের শিষ্যত্ব করিয়াছে”–ইউরোপীয়গণের এই অর্থহীন অন্যায় দাবী নিরাকরণ করিতে করিতে তিনি যারপরনাই উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। তৎপরে কতিপয় চির-প্রত্যাশিত নগর—কোনও কোনও বিশ্বাসী ইংরেজ শিষ্যের শৈশবের বাসভূমি লুধিয়ানা, যেথায় স্বামিজীর ভারতীয় বক্তৃতার অবসান হইয়াছিল সেই লাহোর এবং অন্যান্য নগর—চকিতের ন্যায় দৃষ্টিপথে পতিত হইয়া আবার দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল। আমরা অনেক শুষ্ক কঙ্করময় নদীগর্ভের উপর দিয়াও চলিতেছিলাম। শুনিলাম, দুইটী নদীর মধ্যবর্তী স্থানের নাম দো-আব এবং সমস্ত নদীগুলি যে ভূখণ্ডের অন্তর্গত তাহার নাম পঞ্জাব। গোধূলির আলোকে এই সকল পার্বত্য ভূখণ্ডের কোন একটী অতিক্রমকালে স্বামিজী আমাদিগকে তাঁহার সেই বহুদিন পূর্ব্বের অপূর্ব্ব দর্শনের কথা বলিলেন। তিনি তখন সবেমাত্র সন্ন্যাসজীবনে পদার্পণ করিয়াছেন এবং পরে তাঁহার বরাবর এই বিশ্বাস ছিল যে, সংস্কৃতে মন্ত্র-আবৃত্তি করিবার প্রাচীন রীতি তিনি এই ঘটনা হইতেই পুনঃপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
তিনি বলিলেন, “সন্ধ্যা হইয়াছে; আর্য্যগণ সবেমাত্র সিন্ধুনদতীরে পদার্পণ করিয়াছেন, ইহা সেই যুগের সন্ধ্যা। দেখিলাম, বিশাল নদের তীরে বসিয়া এক বৃদ্ধ। অন্ধকার-তরঙ্গের পর অন্ধকার-তরঙ্গ আসিয়া তাঁহার উপর পড়িতেছে, আর তিনি ঋগ্বেদ হইতে আবৃত্তি করিতেছেন। তার পর আমি সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হইলাম এবং আবৃত্তি করিয়া যাইতে লাগিলাম। বহু প্রাচীনকালে আমরা যে সুর ব্যবহার করিতাম, ইহা সেই সুর।”অনেক মাস পরে শ্রোতৃগণের মধ্যে একজন স্বামিজীর মুখে পুনরায় এই দর্শনটীর কথা শুনেন এবং তাঁহার (স্বামিজীর) চিন্তাপ্রণালীর ঘনিষ্টতর পরিচয় পাওয়ায় এই শিষ্যের মনে হইয়াছিল যে, অপরোক্ষ অনুভূতি হিসাবে ইহার মূল্য খুব বেশী। অতীন্দ্রিয় জগতে আধ্যাত্মিক অনুভূতিসকলের যে একটা পারম্পর্য্য থাকে এবং যুগ-যুগান্তরের ব্যবধান ও জীবনমূত্রের মুহুর্মুহুঃ বিচ্ছেদ সত্ত্বেও যে তাহার ব্যত্যয় হয় না, হয়ত এই দর্শন স্বামিজীর নিকট ইহাই সূচিত করিয়াছিল। যদি তাহাই হয়, তবে কেহই তাঁহার নিকট এ বিষয়ের বিশদ বর্ণনা আশা করিতে পারেন না। কেন না, যে সকল লোক দিনরাত নিজ নিজ অতীত জীবনের কল্পনা লইয়াই ব্যস্ত থাকে, স্বামিজী তাহাদিগকে চিরকাল অত্যন্ত হীনবুদ্ধি জ্ঞান করিতেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় বার গল্পটা-উল্লেখের সময় তিনি ইহার একটু আভাস এক সম্পূর্ণ নূতন দিক হইতে দিয়াছিলেন।
তিনি বলিতেছিলেন, “শঙ্করাচার্য্য বেদের ধ্বনিটীকে ঠিক ধরিতে পারিয়াছিলেন, উহাই আমাদের জাতীয় তান। বলিতে কি, আমার চিরন্তন ধারণা—” বলিতে বলিতে হঠাৎ তাঁহার কণ্ঠস্বর যেন আবেগময় হইয়া আসিল এবং দৃষ্টি যেন সুদূরে ন্যস্ত হইল—“আমার চিরন্তন ধারণা এই যে, তাঁহারও শৈশবে আমার মত কোন এক অলৌকিক দর্শনলাভ নিশ্চয়ই ঘটিয়াছিল এবং তিনি ঐরূপে সেই প্রাচীন তানকে ধ্বংসমুখ হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন। ইহা সত্য হউক বা না হউক, কিন্তু তাঁহার সমগ্র জীবনের কার্য্যই ঐ—বেদ এবং উপনিষৎসমূহের সৌন্দর্য্যের স্পন্দন মাত্র।”অবশ্য এই প্রকারের উক্তিগুলি সম্পূর্ণরূপে কল্পনামূলক এবং আবেগে কখনও কখনও তিনি হঠাৎ যেসকল মত প্রকাশ করিয়া ফেলিতেন, তৎসম্বন্ধে কেহ মনে পড়াইয়া দিলে তিনি নিজেও তাহা আদৌ গ্রাহ্য করিতে পারিতেন না। কিন্তু অন্যের নিকট সেই মতগুলি অনেক সময় মূল্যবান বলিয়াই বিবেচিত হইত।
একবার সুদুর পাশ্চাত্ত্যে তাঁহার ভক্তগণের মধ্যে একজন উৎসাহভরে বলিয়াছিলেন, “বিবেকানন্দ যদি সর্ব্ববিধ বন্ধনের অপনোদক না হন, তবে তিনি কি আর হইলেন!” এই দিনের একটী সামান্য ঘটনাতে কথাগুলি মনে পড়িল। পঞ্জাব-প্রবেশের পর কোন এক ষ্টেসনে তিনি এক মুসলমান খাবারওয়ালাকে ডাকিয়া তাহার হাত হইতে খাবার কিনিয়া খাইয়াছিলেন।
রাওলপিণ্ডি হইতে মরী পর্য্যন্ত আমরা টঙ্গায় যাইলাম এবং কাশ্মীরযাত্রার পূর্ব্বে তথায় কয়েক দিন অতিবাহিত করিলাম। এইখানে স্বামিজী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যদি তিনি প্রাচীনপন্থিগণকে—কোন ইউরোপীয়কে গুরুভাইরূপে বা স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ে প্রবর্ত্তকরূপে গ্রহণ করাইতে আদৌ চেষ্টা করেন, তাহা হইলে তাহা বাঙ্গালা দেশে করাই ভাল। পঞ্জাবে বিদেশীয়দিগের প্রতি অবিশ্বাস এত প্রবল যে, তথায় এরূপ কোন কার্য্যের সফলতার সম্ভাবনা নাই। মধ্যে মধ্যে এই সমস্যাটা তাঁহার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করিত এবং তিনি কখনও কখনও বলিতেন যে, বাঙ্গালীরা রাজনীতিবিষয়ে ইংরেজ-প্রতিযোগী, অথচ তাহাদের মধ্যে পরস্পর ভালবাসা ও বিশ্বাসের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি রহিয়াছে; ইহা আপাতবিরুদ্ধ হইলেও একটা সত্য ঘটনা।১৫ই জুন। বুধবার অপরাহ্ণে আমরা মরী পৌছিয়াছিলাম। ১৮ই জুন আমরা কাশ্মীর যাত্রা করিলাম, সেদিনও এক শনিবার।
১৮ই জুন। আমাদের মধ্যে একজন পীড়িত ছিলেন এবং এই প্রথম দিনটীতে আমরা অল্পদূর মাত্র গিয়া সীমান্তের অপর পারের প্রথম ডাকবাঙ্গলা ডুলাইএ বিশ্রাম করিলাম। একটী ধুলিকীর্ণ, আতপতাপে শুষ্ক পুল পার হইয়া যখন আমরা ইংরেজাধিকৃত ভারত পশ্চাতে ফেলিয়া চলিলাম, সে এক অপূর্ব্ব ক্ষণ। এই সীনারেখার অর্থ ঠিক কতটুকু বা কতখানি, তাহা আমাদের স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম হইতে অধিক দিন বিলম্ব নাই।
আমরা এখন বিতস্তা নদীর উপত্যকায়। কোহলা হইতে বারামুল্লা পর্য্যন্ত সমস্ত রাস্তা আমাদের এক সরু এঁকাবেঁকা গিরিসঙ্কট দিয়া যাইতে হইবে। এই নদীর উভয় পার্শ্বে একদম খাড়া পাহাড়। এই ডুলাইএ স্রোতের বেগ অতি ভীষণ এবং প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জলসংঘর্ষে মসৃণ পাথর একত্র করিয়া এক বিরাট স্তূপের সৃষ্টি করিয়াছে।
অপরাহ্ণের অনেকটা সময় আমরা ঝড়ের জন্য ঘরের মধ্যে কাটাইতে বাধ্য হইয়াছিলাম। ডুলাইএ আমাদের হিন্দুধর্ম্ম-বিষয়ক জ্ঞানলাভের এক নূতন পরিচ্ছেদ খুলিয়া গেল। কারণ স্বামিজী গম্ভীর ও বিশদ্ভাবে ইহার আধুনিক অধোগতির কথা আমাদিগকে বলিলেন এবং উহাতে যেসকল কুরীতি বামাচার নামে প্রচলিত রহিয়াছে, তাহাদের প্রতি স্বীয় চিরশত্রুতার কথাও উল্লেখ করিলেন।
যিনি কোন লোকের আশাভঙ্গ করিতে পারিতেন না, সেই শ্রীরামকৃষ্ণ এই সকলকে কিরূপ দৃষ্টিতে দেখিতেন, ইহা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, “ঠাকুর বলিতেন—হাঁ, তা বটে, কিন্তু প্রত্যেক বাড়ীরই একটা পাইখানার দুয়ারও ত আছে!” এই বলিয়া স্বামিজী দেখাইয়া দিলেন যে, সকল দেশেই যেসকল সম্প্রদায়ে কদাচারের ভিতর দিয়া ধর্ম্মলাভের চেষ্টা করা হয়, তাহারা এই শ্রেণীভুক্ত। এই সত্যোদঘাটন ভীষণ হইলেও আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক ছিল এবং ইহা যথাস্থানে এই উদ্দেশ্যে বর্ণিত হইল যেন কেহ একথা না বলিতে পারেন যে, স্বামিজী তাঁহার স্বদেশবাসিগণের শ্রেণীবিশেষের বা তাহাদের ধর্ম্মমতের বিরুদ্ধে যেসকল অতি অপ্রিয় কথা বলা যাইতে পারে, সেগুলিকে তাঁহার সরলবিশ্বাসী ভক্তগণের নিকট লুকাইয়া রাখিয়া তাহাদিগকে প্রতারণা করিয়াছিলেন।
আমরা স্বামিজীর সহিত পালা করিয়া টঙ্গায় যাইবার ব্যবস্থা করিলাম এবং এই পরবর্ত্তী দিনটী যেন অতীত স্মৃতির আলোচনাতেই পূর্ণ ছিল।
তিনি ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে—একমেবাদ্বিতীয়ম্ সত্তার সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে বলিতে লাগিলেন এবং প্রেমই যে পাপের একমাত্র ঔষধ তাহাও বলিলেন। তাঁহার একজন স্কুলের সহপাঠী ছিলেন। তিনি বড় হইয়া ধনশালী হইলেন কিন্তু তাঁহার স্বাস্থ্যভগ্ন হইল। রোগটীর ঠিক পরিচয় পাওয়া যাইতেছিল না; উহা দিন দিন তাঁহার সামর্থ্য ও জীবনীশক্তি ক্ষয় করিতেছিল এবং চিকিৎসকগণের নৈপুণ্য ইহার নিকট সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হইয়াছিল। অবশেষে ‘স্বামিজী চিরকাল ধর্ম্মাভ্যাসী’ ইহা জ্ঞাত থাকায় এবং মানুষ অন্য সব উপার বিফল হইলে ধর্ম্মের আশ্রয় লয় বলিয়া তিনি স্বামিজীকে একবার আসিতে অনুরোধ করিয়া লোক পাঠাইলেন। আচার্য্যদেব তথায় পৌঁছিলে একটী কৌতুককর ঘটনা ঘটিল।
“যিনি ব্রহ্মকে আপনা হইতে অন্যত্র জানেন, ব্রহ্ম তাঁহাকে পরাজয় করেন; যিনি ক্ষত্রিয়কে আপনা হইতে অন্যত্র জানেন, ক্ষত্রিয় তাঁহাকে পরাজয় করেন এবং যিনি লোকসকলকে আপনা হইতে অন্যত্র ভাবেন, লোকসকল তাঁহাকে পরাজয় করেন।” এই শ্রুতিবাক্য[১] * তাঁহার মনে পড়িল এবং রোগীও ইহার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়া রোগ হইতে মুক্ত হইলেন। পরে স্বামিজী বলিলেন, “সুতরাং যদিও আমি অনেক সময় তোমাদের মনের মত কথা কহি না, বা রাগিয়া কথা বলি, তথাপি মনে রাখিও যে, প্রেম ভিন্ন অন্য কিছু প্রচার করা আদৌ আমার হৃদ্গগত ভাব নহে। আমরা যে পরস্পরকে ভালবাসি, শুধু এইটুকু আমাদের হৃদয়ঙ্গম হইলেই এই সকল গণ্ডগোল মিটিয়া যাইবে।”
সম্ভবতঃ সেই দিনই (অথবা পূর্ব্বদিনও হইতে পারে) তিনি শ্রীমহাদেব-প্রসঙ্গে আমাদের নিকট বলিলেন যে, শৈশবে তাঁহার জননী পুত্রের দুষ্টামি দেখিয়া হতাশ হইয়া বলিতেন, “এত জপ, এত উপবাসের ফলে শিব কিনা একটী পুণ্যাত্মার পরিবর্ত্তে তোকে―ভূতকে পাঠাইলেন!” অবশেষে তিনি যে সত্য সত্যই শিবের একটী ভূত, এই ধারণা তাঁহাকে পাইয়া বসিল। তাঁহার মনে হইল যেন কোন সাজার নিমিত্ত তিনি কিছুদিনের জন্য শিবলোক হইতে নির্ব্বাসিত হইয়াছেন, আর তাঁহার জীবনের একমাত্র চেষ্টা হইবে তথায় ফিরিয়া যাওয়া। তিনি একদিন বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রথম আচার-মর্য্যাদালঙ্ঘন পাঁচ বৎসর বয়সে হইয়াছিল। সেই সময় তিনি খাইতে খাইতে ডান হাত এঁটো-মাখা থাকিলে বাঁ হাতে জলের গেলাস তুলিয়া লওয়া কেন অধিক পরিচ্ছন্নতার কাজ হইবে না, এই মর্ম্মে তাঁহার মাতার সহিত এক তুমুল তর্কে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এই দুষ্টামি অথবা এবংবিধ অপর সব দুষ্টামির জন্য জননীর অমোঘ ঔষধ ছিল—বালককে জলের কলের নীচে বসাইয়া দেওয়া এবং তাঁহার মস্তকে শীতল জলধারা পড়িতে থাকিলে ‘শিব! শিব!’ উচ্চারণ করা। স্বামিজী বলিলেন যে এই উপায়টী কখনও বিফল হইত না। মাতার জপ তাঁহাকে তাঁহার নির্ব্বাসনের কথা মনে পড়াইয়া দিত এবং তিনি মনে মনে “না, না, এবার আর নয়!” বলিয়া পুনর্ব্বার শান্ত এবং বাধ্য হইতেন।
মহাদেবের প্রতি তাঁহার যৎপরোনাস্তি ভালবাসা ছিল এবং একদা তিনি ভারতের ভাবী স্ত্রীজাতি-সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন যে, যদি তাহারা তাহাদের নূতন নূতন কর্তব্যের মধ্যে শুধু মনে করিয়া মধ্যে মধ্যে ‘শিব! শিব!’ বলে, তাহা হইলেই তাহাদের পক্ষে যথেষ্ট পূজা করা হইবে। তাঁহার নিকট হিমালয়ের বাতাস পর্য্যন্ত সেই অনাদি অনন্ত ধ্যানের বিষণ্নীভূত মূর্ত্তি দ্বারা ওতপ্রোত, যে ধ্যান সুখচিন্তার দ্বারা ভগ্ন হইবার নহে এবং তিনি বলিলেন যে, এই গ্রীষ্ম ঋতুতেই তিনি প্রথম সেই প্রাকৃতিক কাহিনীর অর্থ বুঝিলেন, যাহাতে মহাদেবের মস্তকে এবং সমতল প্রদেশে অবতরণের পূর্ব্বে শিবের জটার মধ্যে সুরধুনীর ইতস্ততঃ সঞ্চরণ কল্পিত হইয়াছে। তিনি বলিলেন যে, তিনি বহুদিন ধরিরা পর্ব্বতমধ্যবাহিনী নদী ও জলপ্রপাতসকল কি কথা বলে, ইহা জানিবার জন্য অনুসন্ধান করিয়াছিলেন এবং অবশেষে জানিয়াছিলেন যে, ইহা সেই অনাদি অনন্ত ‘হর হর বম্ বম্’ ধ্বনি! তিনি একদিন শিবের প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন, “হাঁ, তিনিই মহেশ্বর, শান্ত, সুন্দর এবং মৌন। আর আমি তাঁহার পূজক বলিয়া শ্লাঘ্য।”
আর একবার তাঁহার বক্তব্য বিষয় ছিল―বিবাহ কিরূপে ঈশ্বরের সহিত জীবাত্মার সম্বন্ধেরই আদর্শস্বরূপ। তিনি উৎসাহভরে বলিলেন, “এই জন্যই যদিও মাতার স্নেহ কতকাংশে এতদপেক্ষা মহত্তর, তথাপি পৃথিবীশুদ্ধ লোক স্বামী-স্ত্রীর প্রেমকেই আদর্শ বলিয়া ধরিয়া থাকে। আর কোন প্রেমেই এরূপ মনের মতন করিয়া গড়িয়া লইবার অপূর্ব্ব শক্তি নাই। প্রেমাস্পদকে যেমনটী কল্পনা করা যায়, সত্য সত্যই সে ঠিক তেমনটাই হইয়া উঠে, এই প্রেমে প্রেমাস্পদকে রূপান্তরিত করিয়া দেয়।”
তৎপরে কথাপ্রসঙ্গে জাতীয় আদর্শের কথা উঠিল এবং স্বামিজী বিদেশপ্রত্যাগত পান্থ কিরূপ আনন্দের সহিত আবার স্বদেশবাসী নরনারীগণকে স্বাগত করে তাহার উল্লেখ করিলেন। মানুষ সারা জীবন ধরিয়া অজ্ঞাতসারে এরূপ শিক্ষালাভ করিয়া আসে যে, সে স্বদেশবাসীর মুখে এবং আকৃতিতে ভাবের ক্ষীণতম লহরটী পর্য্যন্ত অনুধাবন করিতে পারে।
পথে যাইতে যাইতে আমাদের পুনরার একদল পাদচারী সন্ন্যাসীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাঁহাদের কৃচ্ছানুরাগ দেখিয়া স্বামিজী কঠোর তপ্যাকে ‘বর্ব্বরতা’ বলিয়া তীব্র সমালোচনা করিতে লাগিলেন। ভারতবর্ষের এই এক বিশেষত্ব যে, শুধু ধর্ম্মজীবনই সম্পূর্ণরূপে নিজ অবস্থাসম্বন্ধে সচেতন এবং উহাই সর্ব্বাঙ্গীন স্ফুর্ত্তিলাভ করিয়াছে। এই লোকগুলি সম্ভবতঃ যতটুকু কষ্ট স্বীকার করিতেছিলেন, ঠিক ততটুকু কষ্টই অন্যান্য দেশে লোকে ব্যবসায়ে বা কারবারে, এমন কি খেলাতেও উন্নতিলাভকল্পে স্বীকার করিবে। কিন্তু যাত্রিগণ তাহাদের আদর্শের নামে ধীরে ধীরে ক্রোশের পর ক্রোশ পথ অতিবাহন করিতেছে, এই দৃশ্যে তাঁহার মনে কষ্টকর স্মৃতি-পরম্পরার উদয় হইল এবং মানব-সাধারণের পক্ষ হইতে তিনি ধর্ম্মের উৎপীড়নে অধীর হইয়া উঠিলেন। তৎপরে আবার ঐ ভাব যেমন হঠাৎ আসিয়াছিল, তেমনই হঠাৎ চলিয়া গেল এবং তাহার পরিবর্তে এই ‘বর্ব্বরতা’ না থাকিলে যে বিলাস আসিয়া মানুষের সমুদয় মনুষ্যত্ব অপহরণ করিত, এই ধারণা ঠিক তেমনই দৃঢ়তার সহিত উল্লিখিত হইল।
সেদিন রাত্রে আমরা উরীর ডাক-বাঙ্গলায় অবস্থান করা স্থির করিলাম এবং গোধূলির সময় সকলে ক্ষেত ও বাজার বেড়াইয়া আসিলাম। আহা! কি সুন্দর স্থানটী! চলিবার রাস্তার উপরেই একটী ক্ষুদ্র মাটির কেল্লা—ঠিক ইউরোপীয় ফিউড্যাল[২] ছাঁচের—এবং অব্যবহিত পরেই উন্মুক্ত আকাশতলে ক্রমোচ্চভাবে সাজান ক্ষেত ও পাহাড়ের শ্রেণী। নদীর উপরে রাস্তার গায়েই বাজারখানি এবং আমরা যে পথ দিয়া ডাকবাঙ্গলায় ফিরিয়া আদিলাম, সেটী মাঠের উপর দিয়া কতকগুলি কুটীর পার হইয়া চলিয়াছে—কুটীরসংলগ্ন উদ্যানে বিস্তর গোলাপফুল ফুটিয়া রহিয়াছে। আমাদের আসিবার সময় এখানে-সেখানে অন্য সকলের চেয়ে কিছু বেশী সাহসী এক-আধটী শিশু আমাদের সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতূহলে মেলামেশা করিয়াছিল।
২০শে জুন। পরদিন গিরিসঙ্কটের সবচেয়ে সুন্দর অংশটীর মধ্য দিয়া চলিয়া এবং গির্জার আকারবিশিষ্ট পাহাড়গুলি ও একটা প্রাচীন সূর্য্যমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া আমরা বারামুল্লায় পৌঁছিলাম। প্রবাদ এই যে, কাশ্মীর-উপত্যকা এককালে একটী হ্রদ ছিল এবং এই স্থানটীতে ভগবান বরাহ স্বীয় দন্তাঘাতে পর্ব্বত বিদীর্ণ করিয়া দিয়া বিতস্তা নদীকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত করিয়া দেন। পুরাণাকারে আর একটী ভৌগোলিক তথ্য ইহাতে নিহিত অথবা ইহা ইতিহাস জন্মিবার পূর্ব্বেকার ইতিহাস।