স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/কাশ্মীর উপত্যকা
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
কাশ্মীর উপত্যকা
“ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়!”—অতি উল্লাসের সহিত এই কথা বলিতে বলিতে স্বামিজী আমাদের ডাকবাঙ্গলার কামরাটিতে ফিরিয়া আসিলেন এবং ছাতাটী জানুদ্বয়ের উপর রাখিয়া উপবেশন করিলেন; কোন সঙ্গী না লইয়া আসায় তাঁহাকে স্বয়ংই পুরুষমানুষের অনুষ্ঠেয় সাধারণ ছোট-খাট কাজগুলি সম্পাদন করিতে হইতেছিল এবং তিনি ডোঙ্গা-ভাড়া ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কার্য্যের জন্য বাহির হইয়াছিলেন। কিন্তু যাহির হইয়াই তাঁহার হঠাৎ একজন লোকের সহিত সাক্ষাৎ হয়, তিনি স্বামিজীর নামশ্রবণে কাজের সমস্ত ভার নিজের উপর লইয়া তাঁহাকে নিশ্চিন্ত মনে ফিরিয়া যাইতে কহিয়াছিলেন। সুতরাং দিনটা আমাদের আনন্দে কাটিয়াছিল। আমরা সামাবারে তৈরী কাশ্মীরী চা পান করিলাম এবং ঐ দেশের মোরব্বা ভক্ষণ করিলাম। পরে প্রায় চারিটার সময় আমরা তিন-ডোঙ্গা-বিশিষ্ট এক ক্ষুদ্র নৌ-বহর অধিকার করিলাম এবং আর বিলম্ব না করিয়া শ্রীনগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম। প্রথম সন্ধ্যাটীতে আমরা স্বামিজীর জনৈক বন্ধুর বাগানের পাশে নঙ্গর করিলাম এবং সেখানে শিশুগণের সহিত খেলা করিলাম, ফর্গেট্-মি-নট্, ফুল তুলিলাম এবং সবে ফসল-কাটা ক্ষেতগুলিতে একদল কৃষক কোনও সময়োচিত আমোদ-প্রমোদ উপলক্ষে গান করিতেছে, দেখিতে লাগিলাম। স্বামিজী প্রায় এগারটার সময় অন্ধকারে নিজ নৌকার ফিরিবার পথে আমাদের কাছ দিয়া যাইতে যাইতে গ্রাম্য লোকদের মধ্যে মুদ্রা-প্রচলনের ফলাফল সম্বন্ধে আমাদের ঘোর তর্কের শেষাংশটী শুনিতে পাইয়াছিলেন।
পরদিন আমরা তুষারমণ্ডিত পর্বতরাজি দ্বারা পরিবেষ্টিত এক মনোরম উপত্যকার উপস্থিত হইলাম। ইহাই কাশ্মীর উপত্যকা নামে পরিচিত; কিন্তু হয়ত শ্রীনগর উপত্যকা বলিলে ইহার ঠিক ঠিক পরিচয় দেওয়া হয়। ইসলামাবাদ নগরের নিজের একটী উপত্যকা আছে সেটী নদীর আরও উপরিভাগে এবং তথায় পৌঁছিতে আমাদিগকে পর্ব্বতগুলির মধ্য দিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া যাইতে হইয়াছিল। উপরে সুনীল গগন, আর যে জলপথ বাহিয়া যাইতেছিলাম তাহাও নীল। সে পথে মাঝে মাঝে হরিদ্বর্ণ-পত্রসমন্বিত মৃণালের বড় বড় দল, হেথা-সেথা দু-একটা কোকনদ এবং উভয় তীরে ক্ষেতের পর ক্ষেত—আসিবার সময় তাহাদের মধ্যে কতকগুলিতে কৃষকগণ ফসল কাটিতেছে, দেখিলাম। সমস্ত দৃশ্যটীতে নীল হরিৎ এবং শ্বেতের অপরূপ নিখুঁত সমন্বয়ে কি এমন একটা খোল্তাই হইয়াছিল যে, ক্ষণকালের জন্য ইহার সৌন্দর্য্য সম্যক্রূপে উপভোগ করিতে যাইয়া হৃদয় একরূপ করুণ-রসে আপ্লুত হইল।
সেই প্রথম প্রভাতটীতে ক্ষেতের উপর দিয়া লম্বা একচোট ভ্রমণের পর আমরা এক বিস্তৃত গোচারণ-ভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত একটী প্রকাণ্ড চেনার গাছের নিকট উপস্থিত হইলাম। সত্য সত্যই দেখিলাম, যেন এই গাছের কোটরে প্রবাদোক্ত বিশটা গরু স্থান পাইতে পারে! স্বামিজী কিরূপে ইহাকে এক সাধু-নিবাসের উপযোগী করিয়া লওয়া যাইতে পারে, এই স্থাপত্য-বিষয়ক আলোচনায় ব্যাপৃত হইলেন। বাস্তবিকই এই সজীব বৃক্ষটীর কোটরে একটা ক্ষুদ্র কুটীর নির্ম্মিত হইতে পারিত; তৎপরে তিনি ধ্যানের কথা বলিতে লাগিলেন; ফলে দাঁড়াইল এই যে, ভবিষ্যতে চেনার গাছ দেখিলেই ঐ কথার স্মৃতি উহাকে পবিত্রতায় মণ্ডিত করিয়া দিবে!
তাঁহার সহিত আমরা নিকটস্থ গোলাবাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। তথায় দেখিলাম, তরুতলে বসিয়া এক পরম সুশ্রী বর্ষীয়সী রমণী। তাঁহার মস্তকে কাশ্মীরী-স্ত্রী-সুলভ লাল টুপী এবং শ্বেত অবগুণ্ঠন। তিনি বসিয়া পশম হইতে সূতা কাটিতেছিলেন এবং তাঁহার চারি পাশে তাঁহার দুই পুত্রবধূ এবং তাঁহাদের ছেলেপিলেরা তাঁহাকে সাহায্য করিতেছেন। স্বামিজী পূর্ব্ব শরৎ-ঋতুতে আর একবার এই গোলাবাড়ীতে আসিয়াছিলেন এবং তদবধি এই স্ত্রীলোকটীর স্বধর্ম্মে আস্থা এবং গৌরব-বোধের কথা অনেকবার বলিয়াছিলেন। সেবার তিনি জল খাইতে চাহিয়াছিলেন এবং উক্তা স্ত্রীলোকটাও তৎক্ষণাৎ উহা তাঁহাকে দিয়াছিলেন। তৎপরে বিদায় লইবার পূর্ব্বে তিনি তাঁহাকে ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মা, আপনি কোন্ ধর্ম্মাবলম্বিনী?” সগৌরবে জয়োল্লাসিত উচ্চ কণ্ঠে বৃদ্ধা উত্তর দিয়াছিলেন, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! প্রভুর কৃপায় আমি মুসলমানী!” এক্ষণে এই মুসলমান পরিবার সকলে মিলিয়া স্বামিজীকে পুরাতন বন্ধুরূপে অভ্যর্থনা করিলেন এবং তিনি যে বন্ধুগণকে সঙ্গে আসিয়াছিলেন তাঁহাদের প্রতিও সর্ব্ববিধ সৌজ্য-প্রকাশে রত হইলেন। শ্রীনগর পৌছিতে দুই-তিন দিন লাগিয়াছিল এবং একদিন সন্ধ্যাকালে আহারের পূর্ব্বে ক্ষেতের উপর বেড়াইতে বেড়াইতে একজন (তিনি কালীঘাট দর্শন করিয়াছিলেন) আচার্য্যদেবের নিকট অভিযোগ করিলেন যে, সেখানকার ভক্তির অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস তাঁহার বিসদৃশ বোধ হইয়াছিল এবং বলিয়া উঠিলেন, “প্রতিমার সম্মুখে তাহারা ভূমিতে সাষ্টাঙ্গ হয় কেন?” স্বামিজী একটা তিলের ক্ষেতের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া (তাঁহার মতে ইংলণ্ডের dill নামক শস্যের উহা হইতেই উৎপত্তি) তিল আর্য্যগণের সর্ব্বাপেক্ষা প্রাচীন তৈলবাহী বীজ, এই কথা বলিতেছিলেন! কিন্তু এই প্রশ্নে তিনি হস্তস্থিত ক্ষুদ্র নীল ফুলটাকে ফেলিয়া দিলেন, পরে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া প্রশান্ত গম্ভীরস্বরে বলিলেন, “এই পর্ব্বতমালার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া আর সেই প্রতিমার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া, একই কথা নয় কি?”
আচার্য্যদেব আমাদিগের নিকট প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন যে, গ্রীষ্মাবসানের পূর্ব্বেই তিনি আমাদিগকে কোন শান্তিপূর্ণ স্থানে লইয়া গিয়া ধ্যান শিক্ষা দিবেন। আমাদের চিঠিপত্র বহু দিন ধরিয়া জমিতেছিল; সেগুলি আনিবার নিমিত্ত আমাদিগকে এক্ষণে শ্রীনগর যাইতে হইবে এবং অবকাশটী কিরূপে কাটাইতে হইবে, এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠিল। নির্দ্ধারিত হইল যে, আমরা প্রথমে দেশটী দেখিব এবং তৎপরে নির্জ্জনবাস করিব।
শ্রীনগরের প্রথম রজনীতে আমরা কতিপয় বাঙ্গালী রাজকর্ম্মচারীর গৃহে ভোজন করিয়াছিলাম এবং নানা কথার প্রসঙ্গে পাশ্চাত্ত্য অভ্যাগতগণের মধ্যে একজন মত প্রকাশ করিলেন যে, প্রত্যেক জাতির ইতিহাস কতকগুলি আদর্শের উদাহরণ এবং বিকাশস্বরূপ; উক্ত জাতির সকল লোকেরই সেইগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া থাকা উচিত। আমরা এই দেখিয়া কৌতুক অনুভব করিলাম যে, উপস্থিত হিন্দুগণ ইহাতে আপত্তি উত্থাপন করিলেন। তাঁহাদের পক্ষে ইহা ত স্পষ্টই একটী বন্ধন এবং মানবমন কখনই চিরকাল ইহার অধীন হইয়া থাকিতে পারে না। উক্ত মতের বন্ধনাত্মক অংশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া তাঁহারা সমগ্র ভাবটীর প্রতিই অবিচার করিলেন বলিয়া মনে হইল। অবশেষে স্বামিজী মধ্যস্থ হইয়া বলিলেন, “তোমরা বোধ হয় স্বীকার করিবে যে, মানবপ্রকৃতির ক্ষেত্রে যদি কোন চূড়ান্ত শ্রেণীভাগসূত্র থাকে ত উহা আধ্যাত্মিক; আধিভৌতিক বা ভৌগোলিক নহে। প্রণালী হিসাবে এই ভাবগত সাদৃশ্যগ্রহণকে একেদেশবর্ত্তিতামূলক সাদৃশ্যগ্রহণ অপেক্ষা চিরস্থায়ী করা যায়।” এবং তৎপরে তিনি আমাদের সকলেরই পরিচিত দুই জনের কথার উল্লেখ করিলেন; তন্মধ্যে একজনকে তিনি জীবনে যত ঈশাহী দেখিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে আদর্শস্থানীয় বলিয়া বরাবর মনে করিতেন অথচ তিনি একজন বঙ্গরমণী এবং আর একজনের জন্মভূমি পাশ্চাত্ত্যে; কিন্তু তিনি বলিতেন যে ঐ ব্যক্তি তাঁহার (স্বামিজীর) অপেক্ষাও ভাল হিন্দু। সব দিক ভাবিয়া দেখিলে, এ অবস্থায় ইহাই সর্ব্বাপেক্ষা বাঞ্ছনীয় ছিল না কি যে, উভয়েই প্রত্যেকে পরস্পরের দেশে জন্মিয়া নিজ নিজ আদর্শের যথাসম্ভব প্রসার বিধান করেন?