স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/শ্রীনগর-বাস

সপ্তম পরিচ্ছেদ

শ্রীনগর-বাস

স্থান: শ্রীনগর।
সময়: ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে জুন হইতে ১৫ই জুলাই পর্য়্যন্ত।

 প্রতিদিন প্রাতঃকালে স্বামিজী পূর্ব্বের ন্যায় আমাদের নিকট দীর্ঘকাল কথাবার্ত্তা কহিতেন—কখনও কাশ্মীর যে সকল বিভিন্ন ধর্ম্মযুগের মধ্য দিয়া চলিয়া আসিয়াছে তাহাদের সম্বন্ধে, কখনও বা বৌদ্ধধর্ম্মের নীতি, কখনও বা শিরোপাসনার ইতিহাস, আবার হয়ত বা কনিষ্কের সময়ে শ্রীনগরের অবস্থা—এই সকল বিষয়ের কথোপকথন চলিত।

 একদিন তিনি আমাদের মধ্যে একজনের সহিত বৌদ্ধধর্ম্ম সম্বন্ধে কথা কহিতে কহিতে হঠাৎ বলিলেন, “আসল কথা এই যে, বৌদ্ধধর্ম্ম অশোকের সময়ে এমন একটী মহদনুষ্ঠানে উদ্যোগী হইয়াছিল, যাহার জন্য জগৎ সবেমাত্র আজকালই উপযুক্ত হইয়াছে!” তিনি সর্বধর্ম্ম-সমন্বয়ের কথা কহিতেছিলেন। কিরূপে অশোকের ধর্ম্মবিষয়ক একচ্ছত্রত্ব বার বার ঈশাহী এবং মুসলমান ধর্ম্মের তরঙ্গের পর তরঙ্গ দ্বারা চূর্ণীকৃত হইয়াছিল, কিরূপে আবার এতদুভয়ের প্রত্যেকেই মানবজাতির ধর্ম্মবুদ্ধির উপর একচেটিয়া অধিকার দাবী করিত এবং অবশেষে কিরূপে এই মহাসমন্বয় আজ স্বল্পকালমধ্যেই সম্ভবপর হইবে বলিয়া অনুমিত হইতেছে—এই সকল বিষয়ের অবতারণা করিয়া তিনি এক মহদদ্ভূত চিত্র আমাদের সমক্ষে উপস্থিত করিলেন।

 আর একবার মধ্য-এসিয়োদ্ভর দিগ্বিজয়ী বীর জেঙ্গিজ অথবা চেঙ্গিজ খাঁ সম্বন্ধে কথা হইল। তিনি উত্তেজিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, “লোকে তাঁহাকে একজন নীচ, পরপীড়ক বলিয়া উল্লেখ করে তোমরা শুনিয়া থাক, কিন্তু তাহা সত্য নহে। এই মহামনাগণ কখনও কেবলই ধনলোলুপ বা নীচ হন না। তিনি একরকম অখণ্ডভাবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার জগৎকে তিনি এক করিতে চাহিয়াছিলেন। নেপোলিয়নও সেই ছাঁচে গড়া লোক ছিলেন এবং সেকন্দরও এই শ্রেণীর আর একজন। মাত্র এই তিন জন—অথবা হয়ত একই জীবাত্মা তিনটী পৃথক্ দিগ্বিজয়ে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল!” এবং তৎপরে যে একমাত্র অবতার-আত্মা ঐশী শক্তি দ্বারা পূর্ণ হইয়া জীবের ব্রহ্মৈকসংস্থাপনের নিমিত্ত বারংবার ধর্ম্মজগতে আবির্ভূত হইয়া আসিতেছেন বলিয়া তিনি বিশ্বাস করিতেন, তাঁহারই সম্বন্ধে তিনি বর্ণনা করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ মাদ্রাজ হইতে নব প্রতিষ্ঠিত মায়াবর্তী আশ্রমে স্থানান্তরিত হওয়ায় আমরা সকলে প্রায়ই ইহার কথা ভাবিতাম।

 স্বামিজী এই কাগজখানিকে বিশেষ ভালবাসিতেন। তৎপ্রদত্ত সুন্দর নামটাই তাহার পরিচয়। তাঁহার নিজের কয়েকখানি মুখপত্র থাকে, এইজন্য তিনি সদাই উৎসুক ছিলেন। বর্তমান ভারতে শিক্ষাবিস্তারকল্পে মাসিক পত্রের কি মূল্য, তাহা তিনি সম্যকূরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন এবং অনুভব করিয়াছিলেন যে, তাঁহার গুরুদেবের উপদেশাবলী বক্তৃতা ও লোকহিতকর কার্য্যের ন্যায় এই উপায় দ্বারাও প্রচার করা আবশ্যক। সুতরাং দিনের পর দিন তিনি যেমন বিভিন্ন কেন্দ্রের লোকহিতকর কার্য্যগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কল্পনা করিতেন, তাঁহার কাগজগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ঠিক সেইরূপই করিতেন। প্রতিদিন তিনি স্বামী স্বরূপানন্দের নব সম্পাদকত্বে আশু-প্রকাশোন্মুখ প্রথম সংখ্যাখানির উদ্দেশ্যে কথা পাড়িতেন; একদিন বৈকালে আমরা সকলে বসিয়া আছি এমন সময়ে তিনি একখণ্ড কাগজ আমাদের নিকট আনিলেন এবং বলিলেন যে, তিনি একখানি পত্র লিখিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু উহা এরূপ দাড়াইল:

প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি

জাগো আরো একবার!

মৃত্যু নহে, এ যে নিদ্রা তব,
জাগরণে পুন সঞ্চারিতে
নবীন জীবন, আরো উচ্চ
লক্ষ্যধ্যানতরে প্রদানিতে
বিরাম পঙ্কজ-আঁখি-যুগে।
হে সত্য! তোমার তরে হের
প্রতীক্ষায় আছে বিশ্বজন,
―তব মৃত্যু নাহি কদাচন!
হও পুন অগ্রসর,
তব সেই ধীর পদক্ষেপে

নাহি যাহে হরে শান্তি তার

নিরুদ্বেগে পথিপার্শ্বে স্থিত
দীনহীন ধূলিকণিকার;
শক্তিমান, তবু মতিস্থির
আনন্দমগন, মুক্ত, বীর;
হে সুপ্তিনাশন, চিরাগ্রণী!
ব্যক্ত কর তব বজ্রবাণী!
লুপ্ত সে জনমগৃহ,
যথা বহু স্নেহসিক্ত হিয়া
পালিলা শৈশবে, হর্ষভরে

নিরখিলা যৌবন-উন্মেষে:

কিন্তু হের নিয়তি সে ধরে
অমোঘ প্রভাব—সৃষ্ট যাহা
প্রক্বতি-নিয়মে সবে ফিরে
যথা স্থান উদ্ভব-কারণ
লভিবারে প্রাণশক্তি পুনঃ।
ঊরহ আবার তবে,
সেই তব জন্মস্থান হতে,
হিমস্তূপ অভ্রকটিহার
আশিসিবে যেথায় সতত,
—শক্তি দিবে করিয়া সঞ্চার
নব নব অসাধ্যসাধনে;
যেথা সুরনদী তব স্বর
বাঁধিবে অমরগীতিসুরে;
দেবদারুছায়া বিধানিবে
নিত্যশান্তি যেথা তব শিরে।
সর্ব্বোপরি, যিনি উমা
শান্তপুতা হিমগিরিসুতা—
শক্তিরূপে প্রাণরূপে আর
জননী যে সৰ্ব্বভূতে স্থিতা,
কাৰ্য্য যাহা সবি কার্য্য ধীর,
এক ব্রহ্ম করে প্রপঞ্চিত,
কৃপা যাঁর সত্যের দুয়ার
খুলি এক বাহুতে দেখায়,


দিবে শক্তি সে জননী তোমা
ক্লান্তিহীন, স্বরূপ যাঁহার
অসীম সে প্রেমপারাবার।
আশিসিবে তোমা তাঁরা
পরমর্ষি সবে, যাঁহাদের
কোন দেশ কোন কাল নারে
শুধু আপনার বলিবারে,
—এ জাতির জনয়িতৃগণ—
সত্যের মরম যাঁরা সবে
একইরূপ করি অনুভব
নিঃসঙ্কোচে প্রচারিল ভবে
ভালমন্দ যেমন ভাষায়,
তুমি দাস তাহাদের, তায়
লভিয়াছ রহস্য সে মূল
―বস্তু এক, ইথে নাহি ভুল।
হে প্রেম! কহ সে তব
শান্তস্নিগ্ধ বাণী, নায়াসৃষ্টি
যাহার স্পন্দনে লয় পায়,
স্তরে স্তরে ছায়াস্বপ্ন আর
হের সব শূন্তেতে মিলায়,
অবশেষে সত্য নিরমল
‘স্বে মহিম্নি’ বিরাজে কেবল।
কহ আর বিশ্বজনে―

উঠ, জাগ, স্বপ্ন নহে আর!

স্বপনরচনা শুধু ভবে―
কৰ্ম্ম হেথা গাঁথে মালা যার
নাহি সূত্র, বৃত্তমূলহীন
ভাল-মন্দ পুষ্প ভাবনার,
জন্ম লভে গর্ভে অসতের,
—সত্যের মৃদুল শ্বাসে ধায়
আদিতে যে শূন্য ছিল তায়!

অভী হও, দাঁড়াও নির্ভয়ে

সত্যগ্রাহী সত্যের আশ্রয়ে,
মিশি সত্যে যাও এক হয়ে,
মিথ্যা কৰ্ম্মস্বপ্ন ঘুচে যাক্—
কিম্বা থাকে স্বপ্নলীলা যদি
হের সেই, সত্যে গতি যার,
থাক্ স্বপ্ন নিষ্কাম সেবার

আর থাক্ প্রেম নিরবধি।

 ২৬শে জুন। আচার্য্যদেব আমাদের সকলকে ছাড়িয়া একাকী কোন শান্তিপূর্ণ স্থানে যাইবার জন্য উৎসুক হইয়াছিলেন। কিন্তু আমরা ইহা না জানিয়া তাঁহার সহিত ক্ষীরভবানী নামক শুভ্র প্রস্রবণগুলি দেখিতে যাইবার জন্য জেদ করিতে লাগিলাম। শুনিলাম, ইতঃপূর্ব্বে কখনও কোন ঈশাহী বা মুসলমান তথায় পদার্পণ করে নাই এবং আমরা ইহার দর্শনলাভে যে কতদূর কৃতার্থ হইয়াছি, তাহা বর্ণনাতীত; কারণ ভগবান যেন স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, পরে এই নামটাই আমাদের নিকট সর্ব্বাপেক্ষা পবিত্র হইয়া উঠিবে। এই সম্পর্কে একটা কৌতুকাবহ ঘটনা ঘটিয়াছিল। আমাদের মুসলমান মাঝিগণ আমাদিগকে জুতা পায়ে দিয়া নামিতে দিল না—কাশ্মীরের মুসলমানধর্ম্ম এত হিন্দু-ভাব-বহুল! ইহার আবার চল্লিশ জন ‘ঋষি’ আছেন এবং উপবাসী হইয়া তাঁহাদের মন্দিরদর্শন করিতে হয়।

 ২৯শে জুন। আর একদিন আমরা নিজেরাই বিনা আড়ম্বরে দুই-তিন সহস্র ফিট উচ্চ একটী ক্ষুদ্র পর্ব্বতের শিখরদেশে খুব ভারী ভারী উপকরণে গঠিত তক্ত-ই-মুলেমান নামক এক ক্ষুদ্র মন্দির দর্শন করিলাম। তথায় শান্তি ও সৌন্দর্য্য বিরাজ করিতেছিল এবং বিখ্যাত ভাসমান উদ্যানগুলি নিম্নে চতুষ্পার্শ্বে বহু ক্রোশ ব্যাপিয়া রহিয়াছে, দেখা গেল। মন্দির এবং স্মৃতিসৌধাদির নির্ম্মাণোপযোগী স্থাননির্ব্বাচনে হিন্দুগণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়, এই বিষয়টীর অনুকূলে স্বামিজী যে তর্ক করিতেন, তক্ত-ই-সুলেমান তাহার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণস্থল। তিনি যেমন একবার লণ্ডনে বলিয়াছিলেন যে, ঋষিগণ চতুর্দ্দিকের দৃশ্য উপভোগ করিবার উদ্দেশ্যেই গিরিশীর্ষে বাস করিতেন, তেমনি এখন একটীর পর একটী করিয়া ভূরি ভূরি দৃষ্টান্তসহকারে দেখাইয়া দিলেন যে, ভারতবাসিগণ চিরকাল অতি সুন্দর এবং মুখ্য মুখ্য স্থানগুলি পূজামন্দির নির্ম্মাণপূর্ব্বক পবিত্রতা-মণ্ডিত করিয়া তুলিতেন এবং ইহা অস্বীকার করিবার উপায় ছিল না যে, সেখান হইতে সমস্ত উপত্যকাটী দৃষ্টিগোচর হয় এমন একটী পাহাড়ের শিরোদেশে উক্ত ক্ষুদ্র তক্ত অবস্থিত থাকিয়া এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিতেছিল।

 সেই সময়ের অনেক সুন্দর সুন্দর খণ্ডস্মৃতি মনে পড়িতেছে, যথা—

“তুলসী জগৎমে আইয়ে,
সব সে মিলিয়া ধায়।
ন জানে কৌন্‌ ভেক্‌সে
নারায়ণ মিল্‌ যায়।।”

—তুলসী জগতে আসিয়া সকলের সহিত মিলিয়া মিশিয়া বাস করে। কে জানে, কোন্ রূপে নারায়ণ দেখা দেন!

“একো দেবঃ সৰ্ব্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বভূতান্তরাত্মা।
কৰ্ম্মাধ্যক্ষঃ সৰ্ব্বভূতাধিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ।।”

—একমাত্র দেব সর্ব্বভূতে লুকাইয়া আছেন, তিনি সর্ব্বব্যাপী, সর্ব্বভূতের অন্তরাত্মা, কর্ম্মনিয়ামক, সর্ব্বভূতের আধার, সাক্ষী, চৈতন্যবিধায়ক, নিঃসঙ্গ এবং গুণরহিত।

 “ন তত্র সূর্য্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং”―সেখানে সূর্য্য প্রকাশ পান না, চন্দ্র-তারকা ও নহে।

 কিরূপে একজন রাবণকে রামরূপ ধারণ করিয়া সীতাকে প্রতারণা করিবার পরামর্শ দিয়াছিল, আমরা সে গল্প শুনিলাম। রাবণ উত্তর দিয়াছিলেন, “আমি কি একথা ভাবি নাই? কিন্তু কোন লোকের রূপ ধারণ করিতে হইলে তাঁহাকে ধ্যান করিতে হইবে; আর রাম স্বয়ং ভগবান। সুতরাং যখন আমি তাঁহার ধ্যান করি, তখন ব্রহ্মপদও খড়কুটা হইয়া যায়; তখন পর-স্ত্রীর কথা কিরূপে ভাবিব?”—“তুচ্ছ ব্রহ্মপদং পরবধূসঙ্গঃ কুতঃ?”

 পরে স্বামিজী মন্তব্যস্বরূপে বলিলেন, “সুতরাং দেখ, অত্যন্ত সাধারণ বা অপরাধী জীবনেও এই সব উচ্চ ভাবের আভাস পাওয়া যায়।” পরদোষ-সমালোচনা সম্বন্ধে এইরূপই বরাবর হইত। তিনি চিরকাল মানবজীবনকে ঈশ্বরের প্রকাশ বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন এবং কখনও কোনও ঘোর দুষ্কার্য্যের বা দুষ্ট লোকের খারাপ ভাগটা লইয়া টানাটানি করিতেন না।

“যা নিশা সৰ্ব্বভূতানাং তস্যাং জাগৰ্ত্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পণ্যতো মুনেঃ।।”

—যাহা সর্ব্বলোকের নিকট রাত্রি, সংযমী ব্যক্তি তাহাতে জাগরিত থাকেন; যাহাতে সকল লোক জাগরিত থাকে, তাহা তত্ত্বদর্শী মুনির নিকট রাত্রি (নিদ্রা)-স্বরূপ।

 একদিন টমাস-আ-কেম্পিসের কথা এবং কিরূপে তিনি নিজে গীতা এবং ‘ঈশানুসরণ’ মাত্র সম্বল করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে ভ্রমণ করিতেন তাহা বলিতে বলিতে বলিলেন যে, এই পাশ্চাত্ত্য সন্ন্যাসিবরের নামের সহিত দুশ্ছেদ্যভাবে জড়িত একটী কথা তাঁহার মনে পড়িল:

 “ওহে লোকশিক্ষকগণ, চুপ কর! হে ভবিষ্যদ্বক্তৃগণ, তোমরাও থাম! প্রভো, শুধু তুমিই আমার অন্তরে অন্তরে কথা কও।”

 আবার আবৃত্তি করিতেন—

“তপঃ ক্ব বৎসে ক্ব চ তারকং বপুঃ।
পদং সহেত ভ্রমরস্য পেলবং
শিরীষপুষ্পং ন পুনঃ পতন্ত্রিণঃ।।” —কুমারসম্ভব

—কঠোর দেহসাধ্য তপস্যাই বা কোথায়, আজ তোমার এই সুকোমল দেহই বা কোথায়? সুকুমার শিরীষপুষ্প ভ্রমরেরই চরণপাত সহিতে পারে, কিন্তু পক্ষীর ভার কদাচ সহ্য করিতে পারে না।–(অতএব উমা, মা আমার, তুমি তপস্যয় যাইও না) এবং গাহিতেন—

“এস মা, এস মা, ও হৃদয়রমা পরাণপুতলী গো,
হৃদয়-আসনে হও মা আসীন, নিরখি তোরে গো,

আছি জন্মাবধি তোর মুখ চেয়ে, জান গো জননী কি যাতনা সয়ে,
একবার হৃদয়-কমল বিকাশ করিয়ে প্রকাশ তাহে আনন্দময়ী।”

 প্রায়ই মধ্যে মধ্যে গীতা সম্বন্ধে (“সেই বিস্ময়কর কবিতা, যাহাতে দুর্ব্বলতা বা কাপুরুষত্বের এতটুকু চিহ্নমাত্র নাই!”) দীর্ঘ কথোপকথন হইত। একদিন তিনি বলিলেন যে, স্ত্রীগণের এবং শূদ্রের জ্ঞানচর্চায় অধিকার নাই—এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ, সকল উপনিষদের সারভাগ গীতায় নিহিত। বাস্তবিকই গীতা ব্যতীত তাহাদিগকে বুঝা এক প্রকার অসম্ভব এবং স্ত্রীগণ ও সকল জাতিই মহাভার-পাঠে অধিকারী ছিল।

 ৪ঠা জুলাই। অতি উল্লাসের সহিত গোপনে স্বামিজী এবং তাঁহার এক শিষ্যা (শিষ্যগণের মধ্যে কেবল তিনিই আমেরিকাবাসী নহেন) ৪ঠা জুলাই তারিখে একটী উৎসব করিবার আয়োজন করিলেন। আমাদের আমেরিকার জাতীয় পতাকা নাই এবং থাকিলে তদ্বারা আমাদের দলের অপর যাত্রিগণকে তাঁহাদের জাতীয় উৎসব উপলক্ষে প্রাতরাশকালে অভিনন্দন করা যাইতে পারিত, এই বলিয়া একজন দুঃখ করিতেছেন—ইহা তাঁহার কর্ণগোচর হয়। ৩রা তারিখ অপরাহ্ণে তিনি মহা ব্যস্ততার সহিত এক কাশ্মীরী পণ্ডিত দরজীকে লইয়া আসিলেন এবং বুঝাইয়া দিলেন যে, যদি এই ব্যক্তিকে পতাকাটী কিরূপ করিতে হইবে বলিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সে সানন্দে সেইরূপ করিয়া দিবে। ফলে তারকা ও ডোরা দাগগুলি (Stars and Stripes) অত্যন্ত আনাড়ীর মত একখণ্ড বন্ধে আরোপিত হইল এবং উহা evergreen গাছের (চিরশ্যামল) কয়েকটা শাথার সহিত ভোজনাগাররূপে ব্যবহৃত নৌকাখানির শিরোভাগে পেরেক দিয়া আঁটিয়া দেওয়া হইল। এমন সময়ে আমেরিকাবাসিগণ স্বাধীনতালাভের দিবসে (Independence Day) প্রাতঃকালীন চা পান করিবার জন্য নৌকাখানিতে পদার্পণ করিলেন। স্বামিজী এই ক্ষুদ্র উৎসববাটীতে উপস্থিত থাকিবার জন্য আর এক জায়গায় যাওয়া স্থগিত করিয়াছিলেন এবং তিনি অনান্য অভিভাষণের সহিত নিজে একটী কবিতা উপহার দিলেন। সেগুলি এক্ষণে স্বাগতস্বরূপে সর্ব্বসমক্ষে পঠিত হইল:

“৪ঠা জুলাইয়ের প্রতি

 “ঐ দেখ, কৃষ্ণবর্ণ মেঘগুলি অন্তর্হিত হইতেছে, রজনীতে পুঞ্জীকৃত হইয়া তাঁহারা ধরাপৃষ্ঠ কি অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছিল! তোমার ঐন্দ্রজালিক স্পর্শে জগৎ জাগরিত হইতেছে। বিহঙ্গগণ সমস্বরে গান করিতেছে, কুসুমনিচর তাহাদের শিশির-খচিত তারকাপ্রতিম মুকুটগুলি উর্দ্ধে তুলিয়া তোমাকে স্বাগত সম্ভাষণ করিতেছে, বাপীসকল প্রেমভরে তাহাদের শতসহস্র কমলনয়ন বিস্ফারিত করিয়া তোমাকে হৃদয়ের অন্তস্তম তল হইতে অভিনন্দন করিতেছে।

 “হে ত্বিষাম্পতে, স্বাগত! আজ তোমাকে নূতন করিয়া সন্তাষণ করিতেছি। হে তপন! আজ তুমি স্বাধীনতা বিকিরণ করিতেছ। ভাবিয়া দেখ, জগৎ কিরূপে তোমার প্রতীক্ষায় রহিয়াছিল, কত দেশদেশান্তর যুগ-যুগান্তর ধরিয়া তোমার সন্ধান করিয়া আসিয়াছে?—কেহ কেহ বা গৃহ পরিজন ছাড়িয়া ভীষণ জলধি ও গহন অরণ্য অতিক্রম করিয়া প্রতি পাদক্ষেপে জীবন-মরণের সহিত সংগ্রাম করিয়া তোমার অন্বেষণে স্বেচ্ছায় নির্ব্বাসনদণ্ড গ্রহণ করিয়াছে!

 “তার পর এক শুভ দিনে সেই শুভ কর্মের ফল ফলিল এবং উপাসনা, প্রেম ও ত্যাগব্রত সর্ব্বাঙ্গ হইয়া উদ্‌যাপিত এবং গৃহীত হইল। আর, তখন তুমি প্রসন্ন হইয়া মানবজাতির উপর স্বাধীনতালোক বিকিরণ করিবার জন্য উদিত হইলে!

 “চল, প্রভো, তোমার নির্দিষ্ট পথে অমোঘ গতিতে চলিতে থাক, যতদিন না তোমার মধ্যাহ্ন-কিরণ সমগ্র পৃথিবীকে ছাইয়া ফেলে, যতদিন না প্রতি দেশ তোমার আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে, যতদিন না নরনারী নিজ নিজ দাসত্বশৃঙ্খল উন্মোচিত দেখিতে পায় এবং সগর্ব্বে মাথা তুলিয়া অনুভব করে যে, তাহাদের মধ্যে যে নব আনন্দের সঞ্চার হইয়াছে, উহা নবজীবনেরই সঞ্চার!”

 ৫ই জুলাই। সেই দিন সন্ধ্যাকালে একজন পাশ্চাত্ত্যসমাজে প্রচলিত মেয়েলিশাস্ত্রানুযায়ী পরিহাসচ্ছলে কবে তাঁহার বিবাহ হইবে দেখিবার জন্য নিজ থালায় কয়টী চেরী ফলের বীচি অবশিষ্ট আছে, গণিয়া দেখেন। স্বামিজী ইহাতে দুঃখিত হন। কি জানি কেন, স্বামিজী এই খেলাটীকে সত্য বলিয়া ধরিয়া লন এবং পরদিন প্রাতঃকালে যখন তিনি আসিলেন, তখন দেখিলাম আদর্শ-ত্যাগের প্রতি তাঁহার প্রবল অনুরাগ উথলিয়া পড়িতেছে।

 ৬ই জুলাই। অপরাধীর সহিত যেন এক চিন্তা-ক্ষেত্রে দাড়াইবার যে সহৃদয় বাসনা তাঁহাতে প্রায়ই পরিলক্ষিত হইত, সেই ইচ্ছা-প্রণোদিত হইর। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “এই সব গার্হস্থ্য এবং বিবাহিত জীবনের ছায়া আমার মনে পর্য্যন্ত মাঝে মাঝে দেখা দেয়!” কিন্তু এই প্রসঙ্গে তিনি, যাহারা গার্হস্থ্য জীবনের জয়গান করে, তাহাদের প্রতি দারুণ অবজ্ঞাভরে ত্যাগাদর্শের উপর জোর দিবার সময় যেন বহু উচ্চে উঠিয়া গেলেন। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “জনক হওয়া কি এত সোজা?―সম্পূর্ণরূপে অনাসক্ত হইয়া রাজসিংহাসনে বসা? ধনের বা যশের অথবা স্ত্রী-পুত্রের জন্য কোন খেয়াল না রাখা?—পাশ্চাত্যে আমাকে বহু লোকে বলিয়াছে যে, তাহারা এই অবস্থায় উপনীত হইয়াছে। কিন্তু আমি এইটুকুমাত্র বলিতে পারিয়াছিলাম এইরূপ সব মহাপুরুষ ত ভারতবর্ষে জন্মান না!”

 এবং তৎপরে তিনি অন্য দিকটীর কথা কহিতে লাগিলেন।

 শ্রোতৃগণের মধ্যে একজনকে তিনি বলিলেন, “একথা মনে মনে বলিতে এবং তোমার সন্তানদিগকে শিখাইতে কখনও ভুলিও না যে,

মেরুসর্ষপয়োর্যদ্‌ যৎ সূর্য্যখদ্যোতয়োরিব।
সরিৎসাগরয়োর্যদ্‌ যৎ তথা ভিক্ষুগৃহস্থয়োঃ।।

—মেরু এবং সর্ষপে যে প্রভেদ, প্রচণ্ড সূর্য্য এবং খাদ্যোতে যে প্রভেদ, অনন্ত সমুদ্র এবং ক্ষুদ্র গোষ্পদে যে প্রভেদ, সন্ন্যাসী এবং গৃহীতেও সেই প্রভেদ।”

“সৰ্ব্বং বস্তু ভয়ান্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবভয়ম্।”—

পৃথিবীতে সকল বস্তুতেই ভয় আছে, শুধু মানবের বৈরাগ্যই ভয়রহিত।

 “ভণ্ড সাধুরাও ধন্য এবং যাহারা ব্রত উদ্‌যাপন করিতে অক্ষম হইয়াছে তাহারাও ধন্য; কারণ তাহারাও আদর্শের শ্রেষ্ঠতা-বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়াছে এবং এইরূপে কতকাংশে অপরের সফলতার কারণ।”

 “আমরা যেন কখনও আমাদের আদর্শ না ভুলি—কোন মতেই না ভুলি।”

 এই সব মুহূর্ত্তে তিনি প্রতিপাদ্য ভাবটীর সহিত সর্ব্বতোভাবে এক হইয়া যাইতেন এবং যে অর্থে একটা প্রাকৃতিক নিয়মকে নিষ্ঠুর অথবা বলদৃপ্ত ভাবা যাইতে পারে, সেই অর্থে তাঁহার ব্যাখ্যাকেও যেন ঐরূপ গুণসংযুক্ত বলিয়া ভাবা যাইতে পারিত। বসিয়া শুনিতে শুনিতে আমরা ইন্দ্রিয়ের অগোচর নির্ব্বিশেষ নির্ব্বিকল্প ভাব যেন সাক্ষাৎ উপলব্ধি করিতাম।

 এই সব কথাবার্ত্তা যখন হয় তখন আমরা ডালহ্রদ হইতে শ্রীনগরে ফিরিয়াছি। ডালহ্রদ দর্শনই আমাদের ৪ঠা জুলাইয়ের উৎসবের প্রকৃত আনন্দ-অনুষ্ঠান। সেখানে আমরা নুরমহলের শালিমার বাগ এবং নিশা‍ৎ বাগ অর্থাৎ আনন্দ-উদ্যান দেখিয়াছিলাম এবং বিপুলকায় চেনার গাছগুলির নীচে আইরিস্‌ (Iris)-সমূহের শ্যামল শোভার মধ্যে শান্তভাবে সূর্যাস্তের সময়টা অতিবাহিত করিয়াছিলাম।

 সেই দিনই (৬ই জুলাই) ধীরামাতা এবং জয়া কোন ব্যক্তিগত কার্য্য উপলক্ষে গুলমার্গ যাত্রা করিলেন এবং স্বামিজীও পথের কিয়দংশ তাঁহাদের সহিত গমন করিলেন।

 পরবর্তী রবিবার, ১০ই জুলাই রাত্রি নয়টার সময় প্রথমোক্ত দুইজন হঠাৎ ফিরিয়া আসিলেন এবং অনতিবিলম্বেই বিভিন্ন সূত্রে আমরা সংবাদ পাইলাম যে, আচার্য্যদেব সোনমার্গের রাস্তা দিয়া অমরনাথ গিয়াছেন এবং অপর একটী পথ দিয়া ফিরিবেন। তিনি কপর্দ্দকমাত্র না লইয়া যাত্রা করিয়াছিলেন, কিন্তু হিন্দুশাসিত দেশীয় রাজ্যে এই ব্যাপার তাঁহার বন্ধুবর্গের কোন উদ্বেগের কারণ হয় নাই।

 ইহার দু-এক দিন পরে একটী অপ্রিয় ঘটনা ঘটিল। হঠাৎ শিষ্যত্বগ্রহণোৎসুক এক যুবক আসিয়া উপস্থিত হইল এবং স্বামিজীর নিকট যাইবার জন্য জিদ করিতে লাগিল। আমরা বুঝিলাম যে তিনি যে নিঃসঙ্গত্বের উদ্দেশ্যে গিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার ঘোর ব্যাঘাত উপস্থিত হইবে এবং তাহা কোন ক্রমেই হইতে দেওয়া উচিত নহে; কিন্তু লোকটা কিছুতেই না ছাড়ায়, আমাদিগকে তাহার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিতে হইল। আমাদের জীবনস্রোতও দুই-এক দিনের জন্য পুরাতন খাতেই বহিতে লাগিল।

 ১৫ই জুলাই। আমরা কি উদ্দেশ্যে আজ বাহির হইতেছিলাম? শুক্রবার অপরাহ্ণ পাঁচটার সময় আমরা নদীর অনুকূল স্রোতে কিয়দ্দূর যাইবার জন্য সবেমাত্র নৌকা খুলিয়াছিলাম, এমন সময় ভৃত্যগণ দূরে তাহাদের কয়েকজন বন্ধুকে চিনিতে পারিল এবং আমাদের সংবাদ দিল যে, স্বামিজীর নৌকা আমাদের অভিমুখে আসিতেছে।

 এক ঘণ্টা পরেই তিনি আমাদের সহিত মিলিত হইলেন এবং বলিলেন, ফিরিয়া আসিয়া তিনি আনন্দ অনুভব করিলেন। এবারকার গ্রীষ্ম ঋতুতে অস্বাভাবিক গরম পড়িয়াছিল, এবং কয়েকটি তুষারবর্ত্ম (glacier) ধসিয়া যাওয়ায় সোনমার্গ হইয়া অমরনাথ যাইবার রাস্তাটী দুর্গম হইয়া গিয়াছিল। এই ঘটনায় তিনি ফিরিয়া আসেন।

 কিন্তু আমাদের কাশ্মীরবাসের কয়েক মাসে আমরা স্বামিজীর যে তিনটী মহান্ দর্শন ও তজ্জনিত আনন্দাতিরেকের পরিচয় পাইয়াছিলাম, তাহার প্রথমটীর সূত্রপাত এই সময় হইতেই। যেন আমরা স্বচক্ষে তাঁহার গুরুদেবের সেই উক্তির যাথার্থ্য অনুভব করিতে পারিতেছিলাম—

 “খানিকটা অজ্ঞান রহিয়াছে বটে। সেটুকু আমার ব্রহ্মময়ী মা-ই উহার মধ্যে রাখিয়া দিয়াছেন, তাঁহার কাজ হইবে বলিয়া। কিন্তু উহা ফিন্‌ফিনে কাগজের পর্দার মত, নিমেষের মধ্যেই ছিঁড়িয়া ফেলা যায়।”