টুনটুনির বই/বাঘের পালকি চড়া

বাঘের পালকি চড়া

 বাঘ কিনা মামা আর শিয়াল কিনা ভাগ্নে, তাই দুজনের মধ্যে বড্ড ভাব।

 শিয়াল একদিন বাঘকে নিমন্ত্রণ করল, কিন্তু তার জন্যে খাবার কিছু তয়ের করল না। বাঘ যখন খেতে এল, তখন তাকে বললে, ‘মামা, একটু বস। আর দু-চারজনকে নিমন্ত্রণ করেছি, তাদের ডেকে নিয়ে আসি।’

 এই বলে শিয়াল চলে গেল, আর সে রাত্রে বাড়ি ফিরল না। বাঘ সারারাত বসে থেকে, সকালবেলা শিয়ালকে বকতে-বকতে বাড়ি চলে গেল।

 তারপর একদিন বাঘ শিয়ালকে নিমন্ত্রণ করল। শিয়াল এলে তাকে খেতে দিল মস্ত-মস্ত মোটা-মোটা হাড়। তার এক-একটা লোহার মতো শক্ত। শিয়াল বেচারার চারটে দাঁত ভেঙে গেল, তবু সেই হাড়ের একটুও সে চিবিয়ে ভাঙতে পারল না। বাঘ ঐ রকম হাড় খেতেই খুব ভালোবাসে। সে মনের সুখে পেট ভরে সব হাড় চিবিয়ে খেলে, আর বললে, ‘কি ভাগ্নে, পেট ভরল তো?’

 শিয়াল হাসতে-হাসতে বললে, ‘হ্যাঁ মামা, আমার বাড়িতে তোমার যেমন পেট ভরেছিল, তোমার বাড়িতেও আমার তেমনি পেট ভরেছে।’ মনে-মনে কিন্তু তার ভয়ানক রাগ হল, আর সে বললে, ‘যদি বাঘমামাকে জব্দ করতে পারি, তবে দেশে ফিরব, নইলে আর দেশে ফিরব না।’

 এই মনে করে শিয়াল সে-দেশ ছেড়ে আর এক দেশে চলে গেল। সে নতুন দেশে অনেক আখের ক্ষেত ছিল। শিয়াল সেই আখের ক্ষেতে থাকত আর খুব করে আখ খেত। যা খেতে পারত না, ভেঙে রেখে দিত।

 চাষীরা বললে, ‘ভালো রে ভালো, এমন করে আমাদের আখ কোন দুষ্ট শিয়াল ভেঙে রেখে দেয়? বেটাকে এর সাজা দিতে হবে।’ বলে তারা ক্ষেতের পাশে এক খোঁয়াড় তয়ের করল।

 কাঠ দিয়ে ছোট ঘরের মতন করে খোঁয়াড় তয়ের করতে হয়। তার ভিতরে কোনো জন্তু ঢুকলে তার দরজা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। তাতেই সেই জন্তু খোঁয়াড়ের ভিতর আটকা পড়ে।

 চাষীরা যখন খোঁয়াড় তয়ের করছে, শিয়াল তখন হাসছে আর বলছে, ‘আমার জন্যে, না মামার জন্যে? এমন সুন্দর ঘরে মামা থাকলেই ভালো হয়।’

 তার পরদিনই সে বাঘকে গিয়ে বললে, ‘মামা, একটি বড় নিমন্ত্রণ তে। এসেছে। রাজার ছেলের বিয়ে, সেখানে আমি গান গাইব, আর তুমি বাজাবে। আর খাব যা, তার তো কথাই নেই! তারা পালকি পাঠিয়েছে, যাবে মামা?’

 বাঘ বললে, ‘তা আর যাব না! এমন নিমন্ত্রণটা কি ছাড়তে আছে! আবার তারা পালকিও পাঠিয়েছে!’

 শিয়াল বললে, ‘সে কি যে-সে পালকি? এমন পালকিতে আর কখনো চড়নি মামা।’ এমনি কথাবার্তা বলে দুজনে সেই আখের ক্ষেতের ধারে এল, যেখানে সেই খোঁয়াড় রয়েছে। খোয়াড় দেখে বাঘ বললে, ‘খালি পালকি পাঠিয়েছে, বেয়ারা পাঠায়নি যে?’

 শিয়াল বললে, ‘আমরা উঠে বসলেই বেয়ারা আসবে এখন।’

 বাঘ বললে, ‘পালকির যে ডাণ্ডা নেই, বেয়ারা কি করে বইবে।’

 শিয়াল বললে, ‘ডাণ্ডা তারা সঙ্গে আনবে।’

 একথা শুনে বাঘ যেই খোঁয়াড়ের ভিতর ঢুকেছে, অমনি ধড়াস করে তার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তখন শিয়াল বললে, ‘মামা, দরজাটা যে বন্ধ করে দিলে, আমি ঢুকব কি করে?’

 বাঘ বললে, তোমার ঢুকে কাজ নেই। এবারের নিমন্ত্রণটা আমিই খাইগে।’

 শিয়াল বললে, ‘বেশ কথা মামা!! খুব ভালো করে পেট ভরে নিমন্ত্রণ খেও। কম খেও না যেন!’

 এই বলে শিয়াল হাসতে হাসতে তার দেশে চলে গেল।

 তারপর চাষীরা এসে দেখল যে বাঘমশাই খোঁয়াড়ের ভিতর বসে আছেন। তখন তারা কি খুশী যে হল, কি বলব!

 তারা সকলকে ডেকে বললে, ‘আন খন্তা, আন বল্লম, আন যে যা পারিস! খোঁয়াড়ে বাঘ পড়েছে। আয় তোরা কে কোথায় আছিস।’

 অমনি সকলে ছুটে এসে বাঘকে মেরে শেষ করল।